ঊনিশ

 দীনেশচন্দ্র প্রথমে বিখ্যাত হন “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” রচনা ক’রে। এই বৃহৎ ও মূল্যবান গ্রন্থখানি যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশে যে বিস্ময় ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখনো আমার মনে আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যে কত মহার্ঘ রত্নের আকর, দীনেশচন্দ্রই সেদিকে প্রথম আকৃষ্ট করেন বাঙালীর দৃষ্টি। তিনি দরিদ্র ছিলেন, তবু এই সুকঠিন সাহিত্য-ব্রত উদ্‌যাপনের জন্যে দীর্ঘকালব্যাপী যে বিপুল শ্রমস্বীকার করেছিলেন তাও স্মরণ ক’রে রাখবার মত। যথেষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাঁকে কর্তব্য পালন করতে হয়েছিল; কারণ এ শ্রেণীর গ্রন্থ যে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন ক’রে লেখকের শ্রম সার্থক করতে পারবে, তখনকার দিনে এ কথা জোর ক’রে বলবার উপায় ছিল না।

 ময়মনসিংহ-গীতিকা”-কেও দীনেশচন্দ্রের আর এক আরিষ্কার বলা যেতে পারে। পরিণত বয়সে “বৃহৎ বঙ্গ” রচনা ক’রেও তিনি বাঙালীর চোখের সামনে তুলে ধরেছিলেন তার গৌরবদীপ্ত অতীতকে। প্রধানতঃ এই তিনখানি গ্রন্থের জন্যেই বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি অক্ষয় যশের অধিকারী হয়েছেন। এ ছাড়া “রামায়ণী কথা”, “বেহুলা” ও “ফুল্লরা” প্রভৃতি আরো কয়েকখানি জনপ্রিয় পুস্তক তিনি রচনা ক’রে গিয়েছেন।

 দীনেশচন্দ্রের রচনাভঙ্গি বা “ষ্টাইল” উল্লেখযোগ্য ছিল না। তাই সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ঠাট্টা ক’রে বলতেন, ‘দীনেশবাবুর ভাষা এখনো হামাগুড়ি দেয়, হাঁটতে শেখেনি।’ কিন্তু তাঁর ভাষার মধ্যে এমনি মিষ্ট প্রাঞ্জলতা ও আন্তরিকতা আছে, প্রত্যেক পাঠককেই যা আকৃষ্ট না ক’রে পারে না।

 প্রথম জীবনটা দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে পরে তিনি যশ, অর্থ ও রাজসম্মান প্রভৃতি মানুষের যা-কিছু কাম্য, সমস্তই লাভ করেছিলেন, অধিকাংশ সাহিত্য-সেবকেরই এতটা সৌভাগ্য হয় না। কিন্তু সুখের দিনেও তাঁর স্বভাবের মাধুর্য ছিল সম্পূর্ণরূপে অপরিবর্তিত।

 তাঁর সঙ্গে যেদিন প্রথম পরিচিত হই, আমি তখন একজন অখ্যাত লেখক মাত্র, ছোট ছোট মাসিক কাগজে এবং মাঝে মাঝে দৈনিক “সন্ধ্যা”য় হাতমক্স করি। একখানি মাসিক পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলুম, তারই জন্যে দীনেশচন্দ্রের কাছে গিয়েছিলুম একটি রচনা-ভিক্ষা করতে। আমার বয়স তখন সতেরো কি আঠারো, দীনেশচন্দ্রের একচল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। তিনি তখন তাঁর কাঁটাপুকুরের বাড়ীতে বাস করতেন (শুনেছি সে বাড়ীখানি নাকি গুণগ্রাহী শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দান)।

 দীনেশচন্দ্র নীচে নেমে এলেন। তাঁর রংটি কালো বটে, কিন্তু প্রশান্ত প্রসন্ন মুখ। চোখে হাসি, ওষ্ঠাধরে হাসি। এমন স্নেহভরে আমার কাঁধে হাত দিয়ে কথা কইতে লাগলেন, যেন তিনি আমার সমবয়সী পুরাতন বন্ধু।

 “সাধনা-সমিতি” নামে আমাদের একটি আলোচনা-সভা ছিল— সেখানে আমরা কয়েকজন উদীয়মান সাহিত্যিক স্বরচিত প্রবন্ধাদি পাঠ করতুম এবং আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়দীনেশচন্দ্র সেন প্রভৃতি বিখ্যাত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ ক’রে আনতুম; তাঁরা বক্তৃতা দিতেন। সেক্সপিয়ারের ট্রাজেডির সঙ্গে সংস্কৃত নাটকের পার্থক্য কি তা দেখিয়ে দীনেশচন্দ্র একটি চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

 তারও অনেক বৎসর পরে সুকিয়া স্ট্রীটে “ভারতী” কার্যালয়ের তিনতলায় বসত আমাদের বৃহৎ বৈঠক। বাংলা দেশের প্রবীণ ও নবীন অধিকাংশ বিখ্যাত লেখক ছিলেন সেখানকার সভ্য। প্রতিদিন বৈকাল থেকে রাত্রি নয়টা পর্যন্ত সে বৈঠক গম্‌গম্ করত বহু সাহিত্যিকের আনাগোনায়, সাহিত্য-আলোচনায়, তর্ক-বিতর্কে এমন কি মাঝে-মাঝে সমস্বরে রবীন্দ্র-সঙ্গীতেও। সেইখানেই দীনেশচন্দ্রকে আমাদের প্রাণের আরো কাছাকাছি পাই। “ভারতী”র সেই বৈঠকে আসতেন প্রমথ চৌধুরী, যাঁর করধৃত সিগারেটের আগুন ছিল রাবণের চিতার ক্ষুদ্রতর সংস্করণের মত সদা-জ্বলন্ত; আসতেন ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র, যিনি গল্প করতে করতে লজেঞ্জুসের মত চুষে চুষে উপভোগ করতেন আফিমের বড় বড় গুলি বা গোলা! আসতেন দীনেশচন্দ্র, তাঁর একমাত্র নেশা চা। আসতেন আরো অনেক দেশবিখ্যাত হোমরাচোমরা ব্যক্তি, তাঁদের কথা বলব পরে যথাসময়ে। প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র ও দীনেশচন্দ্র, এঁরা তিনজনেই ছিলেন গল্পিয়া। কিন্তু প্রথম চৌধুরী বলতেন কেবল সাহিত্যের গল্প; আর দীনেশচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের মুখে শুনতুম আমরা যত রাজ্যের গালগল্প।

 বলেছি, দীনেশচন্দ্রের একমাত্র নেশা ছিল চা। কিন্তু সে যা তা চা নয়— একেবারে স্পেশ্যাল চা, “ভারতী”-বৈঠকের ‘ইলেকট্রিক কেট্‌লি’তে সে চায়ের জল গরম হ’ত বটে, কিন্তু তার উপাদান ছিল অদ্ভুত। সাধারণতঃ চা তৈরি ক’রে বন্ধুদের মধ্যে পরিবেশনের ভার গ্রহণ করতুম আমি নিজে। দীনেশচন্দ্রের বাঁধা নির্দেশ ছিল, চায়ে কয় চামচ চিনি দিতে হবে তা ব’লে দেবেন তিনিই।

 আমি বলতুম, ‘দীনেশবাবু, পেয়ালায় তিন চামচ চিনি দিলুম।’

 —‘আরো চিনি দিন।’

 —‘চার চামচ, পাঁচ চামচ।’

 —‘আরো দিন, আরো দিয়ে যান।’

 —‘ছ চামচ, সাত চামচ হ’ল।’

 —‘আরো দিয়ে যান, আরো।’

 —‘বলেন কি দীনেশবাবু, আপনি চা খাবেন, না চিনি খাবেন?’

 —‘চিনি খাব ভাই, চিনি খাব। চিনি খাব ব’লেই তো চা খাই। আরো চিনি চাই।’

 পেয়ালায় আট-দশ চামচ চিনি না পড়লে দীনেশচন্দ্রের মন উঠত না। আরো বেশী চিনি দিলেও তিনি বোধ হয় বলতেন, ‘অধিকন্তু ন দোষায়’।

 চা এবং চিনিকে যথাস্থানে প্রেরণ ক’রে চাঙ্গা হয়ে ইজি-চেয়ারে ব’সে দীনেশচন্দ্র শুরু করতেন গল্পের পর গল্প। এত রকম গল্প তিনি জানতেন আর এত ভালো ক’রে বলতে পারতেন! ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথা দিয়ে যে কেটে যেত, খেয়াল করতেই পারতুম না। তারপর তিনি থাকতে থাকতে যে-দিন গালগল্পের আর এক রাজা শরৎচন্দ্র এসে পড়তেন, সেদিন তো হ’ত যাকে বলে ‘সোনায় সোহাগ।’! এঁর মুখ বন্ধ হ’তে না হ’তে মুখর হয়ে উঠত আর এক জনের মুখ! দস্তুরমত গল্প-প্রতিযোগিতা! মাঝে মাঝে শরৎচন্দ্র বাক্যবাণের দ্বারা দীনেশচন্দ্রকে বিদ্ধ করবার চেষ্টা করতেন। দীনেশচন্দ্র কথাপ্রসঙ্গে প্রায়ই বিশেষ ঝোঁক দিয়ে ‘my wife’ ব’লে নিজের সহধর্মিণীর কথা তুলতেন। একদিন শরৎচন্দ্র বললেন, ‘দীনেশবাবু যে রকম দৃঢ়কণ্ঠে ‘my wife’ ব’লে চেঁচিয়ে ওঠেন, তাতে ক’রে বেশ বোঝা যায় যে তাঁর স্ত্রীর উপর একমাত্র তিনি ছাড়া পৃথিবীর আর কারও একটুখানিও দাবি-দাওয়া নেই!’ সবাই উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন এবং দীনেশচন্দ্রও কোনরকম অপ্রস্তুত না হয়ে সকলের সঙ্গেই গলা মিলিয়ে হাসতে লাগলেন।

 দীনেশচন্দ্র তখন বেহালায় নিজের নতুন বাড়ীতে গিয়ে বাস করছেন। একদিন সেখানে হ’ল আমাদের নিমন্ত্রণ। আমরা মানে স্বর্গীয় কবিবর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বর্গীয় “ভারতী”-সম্পাদক ও গল্পলেখক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও আমি। দীনেশচন্দ্র নিজেও যেমন ভোজনবিলাসী ছিলেন, বন্ধুবান্ধবদের আদর ক’রে খাওয়াতেও তেমনি ভালোবাসতেন। দুপুরবেলায় দেখি আমাদের জঠর জ্বালা নিবারণের জন্য হয়েছে অপরিমিত আহার্যের আয়োজন। নিজে একসঙ্গে পাত পেতে দীনেশচন্দ্র সকলের উপর রাখলেন শ্যেনদৃষ্টি এবং বারংবার বলতে লাগলেন, এটা খাও, ওটা খাও— পাতে কিছু ফেলে রাখা চলবে না। পূর্ণোদরেও হাত গুটোবার উপায় নেই— ‘আরো কিছু নিতেই হবে।’ অনিচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর অকাট্য যুক্তি ছিল— ‘নইলে আমার স্ত্রী রাগ করবেন!’

 কানায় কানায় পেট ভরিয়ে ওজনে রীতিমত ভারি হ’য়ে সকলে বাগানের পুকুড়-পাড়ে ঘাসজমির উপরে এসে বসলুম। দীনেশচন্দ্র স্বরচিত একটি নূতন পৌরাণিক আখ্যায়িকা পাঠ ক’রে শোনালেন। প্রায় একটি গোটা দিন চমৎকার ভাবে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে যখন বিদায় নিচ্ছি, দীনেশচন্দ্র বললেন, ‘দেখছেন তো আমি পরম সুখে আছি। সহরের কোন উপসর্গ নেই, নিরিবিলি ঠাঁই, সবুজ বাগান, ফুলের বাহার, পাখীর গান, ঢলঢলে সরোবর— আপনারাও বেহালায় এসে বাসা বাঁধুন না!’

 মণিলাল বললেন, ‘সবই তো ভালো, তবে ঐ যা ম্যালেরিয়ার ভয়।’

 দীনেশচন্দ্র যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘বেহালার মত জায়গা আর নেই। বেহালায় ম্যালেরিয়া? অসম্ভব!’

 আমি বললুম, ‘কিন্তু এখানে সাপ আছে।’

 দীনেশচন্দ্র বললেন, ‘তা আছে। কিন্তু বেহালার সাপরা মানুষদের কামড়ায় না।’

 প্রেমাঙ্কুর বললেন, ‘বেহালার সাপরা বৈষ্ণব হ’তে পারে, কিন্তু এখানে ভারি শীত, আমি শীতকে ভয় করি।’

 দীনেশচন্দ্র বললেন, ‘আপনি ঠাণ্ডাকে নিশ্চয় আমার চেয়ে ভয় করেন না। পাছে ঠাণ্ডা লাগে সেই ভয়ে স্নান করা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। একদিন কি হয়েছিল জানেন? আমার এক ছেলে ডুবে গেল ঐ পুকুরে। কিন্তু আমি সাঁতার জেনেও ঠাণ্ডার ভয়ে পুকুরের জলে নামতে পারলুম না, ডাঙায় দাড়িয়েই চেঁচিয়ে পাড়া জাগিয়ে তুললুম। তারপর সকলে ছুটে এসে ছেলেকে জল থেকে টেনে তুললে।’

 কিছুকাল পরেই খবর পেলুম, দীনেশচন্দ্র বেহালা থেকে পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়ে আবার কাঁটা পুকুরের বাড়ীতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ? ম্যালেরিয়ার আক্রমণ।

 প্রথম দর্শনেই দীনেশচন্দ্রকে যেমন নিকট-আত্মীয় ব’লে মনে হয়েছিল, তারপরও বরাবর তাই ব’লেই মনে হয়েছে। তিনি যেখানেই বসতেন, সৃষ্ট হ’ত যেন একটি প্রেমের আবহ। সদানন্দ মাটির মানুষ ছিলেন তিনি। উত্তেজিত হয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক করেছি, দু’চারটে কঠিন কথাও বলেছি, কিন্তু তাঁর মুখের হাসি তখনও মিলোয় নি। হয়তো সেইদিনই তাঁর বাড়ীতে আহারের নিমন্ত্রণ ক’রে গিয়েছেন। বহু পরশ্রীকাতর ব্যক্তি পত্রিকায় তাঁকে কটু ভাষায় আক্রমণ করেছে, কিন্তু তিনি কখনো কাগজে-কলমে তার উত্তর দেন নি, নীরবে নির্বিকারচিত্তে নিজের সাহিত্যসাধনা নিয়েই নিযুক্ত হয়ে থাকতেন।