চব্বিশ

 বোধ করি ১৩১৯ সালের কথা। নব পর্যায়ে “জাহ্নবী” পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে এবং তার কার্যালয়ে প্রত্যহই বসে আমাদের একটি সাহিত্য-বৈঠক। সেখানে যাঁরা ওঠা বসা করতেন তাঁদের অনেকেই আজ সুপরিচিত ব্যক্তি। যেমন শ্রীঅমল হোম (সরকারের প্রধান প্রচার-সচিব), শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থী (সাহিত্যিক ও চিত্রপরিচালক), শ্রীপ্রভাত গঙ্গোপাধ্যায় (অধুনালুপ্ত দৈনিক “ভারত” সম্পাদক), শ্রীসুধীরচন্দ্র সরকার (পুস্তক-প্রকাশক ও “মৌচাক” সম্পাদক) এবং শ্রীচারুচন্দ্র রায় (চিত্রশিল্পী ও চিত্র-পরিচালক) প্রভৃতি।

 “যমুনা” নামে একখানি প্রায় নগণ্য ছোট মাসিক কাগজ প্রকাশিত হ’ত। তার সম্পাদক ছিলেন স্বর্গীয় ফণীন্দ্রনাথ পাল, তখন লেখকরূপে তাঁর কোন খ্যাতিই ছিল না। প্রভাত এসে একদিন বললেন, ‘“যমুনা”য় ‘রামের সুমতি’ নামে একটি আশ্চর্য গল্প বেরিয়েছে, তেমন গল্প আমি আর কখনো পড়ি নি।’

 জিজ্ঞাসা করলুম, ‘লেখক কে?’ ভাবলুম, নিশ্চয়ই কোন বিখ্যাত লেখকের নাম শুনব।

 কিন্তু প্রভাত বললেন, ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।’

 একেবারে অপরিচিত নাম। গল্পটি সম্বন্ধে প্রভাতের মতামত আমলে আনলুম না, কারণ তা অত্যুক্তি ব’লেই মনে হ’ল। তবু গল্পটি নিয়ে পড়তে বসলুম এবং পড়তে পড়তে অভাবিত বিস্ময়ে মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। বাংলা ভাষায় সত্য সত্যই সে শ্রেণীর গল্প আর কখনো প্রকাশিত হয় নি! একেবারে প্রথম শ্রেণীর! অসাধারণ লেখনীর দান। মনে মনে মানলুম, প্রভাত একটি অদ্ভুত আবিষ্কার করেছেন বটে।

 কিন্তু কে এই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? এটি কি কোন বিখ্যাত লেখকের ছদ্মনাম? নূতন কোন লেখকেরই হাত একেবারে এত বেশী পাকা হ’তেই পারে না। অমন যে প্রতিভার অবতার রবীন্দ্রনাথ, তাঁরও প্রথম দিককার রচনায় বয়সোচিত দুর্বলতার অভাব নেই। হাঁসের বাচ্চারা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সাঁতার কেটে জলে ভাসতে পারে বটে, কিন্তু সাহিত্যিকরা লেখনীধারণের সঙ্গে সঙ্গেই পাকা লেখা লিখতে পারেন না। কত চেষ্টা ও পরিশ্রমের এবং দীর্ঘকালব্যাপী সাধনার পর একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক পরিপূর্ণতা লাভ করেন, বিশেষজ্ঞদের কাছে তা অজানা নেই।

 খোঁজ নিতে লাগলুম এবং দুদিন পরেই জানতে পারলুম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মোটেই নতুন লেখক নন, যৌবন বয়স, থেকেই তিনি আড়ালে ব’সে নিয়মিত ভাবে সাহিত্য-সাধনা ক’রে আসছেন, এমন কি ১৩১৪ সালে তাঁর রচিত “বড়দিদি” উপন্যাস, “ভারতী” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল— যদিও সে সময়ে লেখকের নাম প্রকাশ করা হয় নি।

 তারপর “যমুনা”য় বেরুতে লাগল শরৎচন্দ্রের “পথনির্দেশ”, “বিন্দুর ছেলে” ও অন্যান্য রচনা। সে সময়ের কথা আমার বেশ মনে আছে। শরৎচন্দ্রের এক একটি নূতন রচনা প্রকাশিত হয়, আর সাহিত্য-সমাজে জাগে নব নব উত্তেজনা! এবং শরৎচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে “যমুনা” পত্রিকারও নাম ফিরতে লাগল লোকের মুখে মুখে। তার গ্রাহক-সংখ্যাও বেড়ে উঠতে লাগল হু-হু ক’রে।

 ইতিমধ্যে “যমুনা”র সম্পাদক ফণীবাবুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। বেশ মিষ্ট মানুষ ছিলেন তিনি। লেখক হিসাবে অসামান্য না হ’লেও, অন্য এক কারণে তিনি আমাদের সকলেরই কৃতজ্ঞতার উপরে দাবি করতে পারেন। শরৎচন্দ্রকে প্রকাশ্যভাবে সাহিত্যক্ষেত্রে নিয়ে এসেছিলেন সর্বপ্রথমে তিনিই এবং এই কার্যে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন আরো তিনজন বিখ্যাত লেখক— শ্রীসৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, শ্রীউপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও শ্রীসুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়

 আমার জীবনেও ঘটল এক ঘটনা। সরকারি চাকরি করতুম, আপিসের নাম “মিলিটারি অ্যাকাউণ্ট্‌স্”। চাকরি কোনদিনই আমার ধাতে সইত না, এর আগেও গুরুজনদের তাড়নায় আরো দুই জায়গায় চাকরি নিয়েছি, আবার ছেড়ে দিয়েছি। আপিসে গেলেই আমার মনে হ’ত, জলের মাছ যেন ডাঙায় এসে পড়েছি। তার উপরে ফণীবাবু প্রায়ই আপিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা ক’রে বলতে লাগলেন, ‘হেমেন্দ্রবাবু, আপনি চাকরি ছাড়ুন, “যমুনা”র সম্পাদনার ভার গ্রহণ করুণ। আমি তাহ’লে ব্যবসার দিকটা দেখতে পারি।’ অবশেষে তাই করলুম। চাকরি ছাড়লুম। সেই আমার শেষ চাকরি।

 “যমুনা” কার্যালয়ে এসে আসন পাতলুম। কাগজের উপরে সম্পাদকরূপে ফণীবাবুর নামই রইল বটে, কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কীয় সমস্ত কর্তব্যই আমাকে পালন করতে হ’ত। তার উপরে ফণীবাবুর পীড়াপীড়িতে নূতন ক’রে আবার গল্প-রচনা সুরু করি এবং সেই সূত্রেই শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আমার পরিচয়।

 কিন্তু প্রথম পরিচয় হয় পত্রের দ্বারা, কারণ শরৎচন্দ্র তখন রেঙ্গুনে থাকতেন। “যমুনা”য় আমার “কেরাণী” নামে একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয় এবং সেটি পাঠ ক’রে তিনি আমাকে একখানি উচ্ছ্বসিত প্রশংসাপূর্ণ পত্র লিখলেন। তারপর থেকে আমাদের দুজনের ভিতরে নিয়মিত ভাবে পত্রালাপ চলতে থাকে।

 একদিনের বৈকাল বেলা। “যমুনা” কার্যালয়ে টেবিলের ধারে ব’সে আমি রচনা নির্বাচন করছি, এমন সময়ে ঘরের ভিতরে একটি লোকের আবির্ভাব। নিতান্ত সাধারণ চেহারা। নাতিদীর্ঘ কৃশ দেহ, কালো রং, মাথার চুল এলোমেলো, একমুখ দাড়ি-গোঁফ, আধময়লা জামা-কাপড়, পায়ে চটি, সঙ্গে একটা লেড়ী কুকুরের বাচ্চা।

 জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কাকে চাই?’

 —‘ফণীবাবুকে।’

 —‘তিনি এখনো আসেন নি।’

 —‘তাহ’লে আমি একটু বসব কি?’

 বিনাবাক্যব্যয়ে দূরের একখানা বেঞ্চির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলুম। তারপর আর সেদিকে না তাকিয়ে নিজের মনেই আমি কাজ করতে লাগলুম।

 বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। লোকটির সঙ্গে কুকুরের বাচ্চাটা খেলা করতে লাগল। তারপর ফণীবাবুর প্রবেশ।

 ঘরে ঢুকেই তিনি শশব্যস্ত হয়ে ব’লে উঠলেন, ‘একি, শরৎবাবু যে! ওখানে বেঞ্চের উপরে ব’সে আছেন কেন?’

 তিনি আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললেন, ‘উনি যে আমাকে এখানেই বসতে হুকুম দিলেন।’

 ফণীবাবু বললেন, ‘না, না, চেয়ারে এসে বসুন। সে কি হেমেন্দ্রবাবু, আপনি শরৎবাবুকে চিনতে পারেন নি?’

 আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললুম, ‘কেমন ক’রে চিনব? আমি ভেবেছিলুম উনি দপ্তরী।’

 শরৎবাবু হো হো ক’রে হেসে উঠলেন।

 “যমুনা” কার্যালয়ে আমরা একটি বৃহৎ সাহিত্যবৈঠক রচনা করেছিলুম, তেমন বৈঠক আজ সহরের কোথাও নেই। সেখানে প্রত্যহ বৈকালের পরে যত বিখ্যাত সাহিত্যিক এসে আলাপআলোচনা করতেন, রীতিমত দীর্ঘ হবে তাঁদের নামের তালিকা। শরৎচন্দ্র রোজই এসে আসর জমিয়ে তুলতেন। তিনি কোনরকম কৃত্রিম ভঙ্গি বা গাম্ভীর্যের ধার ধারতেন না, গল্পের পর গল্প বলবার জন্যে সর্বদাই প্রস্তুত হয়ে থাকতেন, আর কত রকমের গল্পই যে তিনি জানতেন! গল্প বলতে বলতে মাঝে মাঝে খেলার মার্বেলের মত বড় বড় আফিমের গুলি নিক্ষেপ করতেন বদনবিবরে। সভয়ে ও সবিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে একদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘হেমেন্দ্র, যদি আরো ভালো লিখতে চাও, আমার মত আফিম ধরো।’

 আমি বললুম, ‘মাপ করুন মশাই, ও-রকম একটি মাত্র ডেলা যদি খাই, তাহ’লে আর ভালো লেখার সময় পাব না, কারণ যমদূতেরা খবর পেয়ে ছুটে আসবে।’

 শরৎচন্দ্র ছিলেন পয়লা নম্বরের আড্ডাধারী মানুষ, কোন কোন দিন দশ-বারো ঘণ্টা ধ’রে অশ্রান্ত ভাবে গল্প ক’রে গিয়েছেন, বাড়ী ফিরেছি আমরা রাত দুটো কি তিনটের সময়ে। তাঁর সেই প্রথম আত্মপ্রকাশের যুগে যাঁরা তাঁকে দেখেন নি, তাঁরা আগেকার শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা করতে পারবেন না।

 প্রতিদিনই আসর ভাঙবার পর শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বাড়ী ফিরতুম আমি। তখন তিনি বাস করতেন বড়বাজারের এক কুবিখ্যাত পল্লীতে। সেই সময়ে পথ চলতে চলতে তিনি নিজের বিচিত্র জীবনের কথা আমার কাছে ব’লে যেতেন একান্ত অসঙ্কোচে। তাঁর সরলতা দেখে বিস্মিত হতুম। একদিন বললেন, ‘হেমেন্দ্র, এমন নেশা নেই যা করি নি, এমন কুস্থান নেই যেখানে যাই নি। আজ এই ভেবে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই, এত ক’রেও তো আমি নিজকে হারিয়ে ফেলি নি! আমার মনের ভিতরকার মানুষটি চিরদিনই নির্মুক্ত হয়ে আছে।’

 এক রাত্রের ঘটনা। বর্ষাকাল, বৃষ্টি নেমেছে বৈকাল থেকেই। কলকাতার পথে পথে নদীর মত জলোচ্ছ্বাস। আড্ডা সেদিন জমল না। রাত নয়টা বাজতে না বাজতেই রাস্তা জনবিরল হয়ে পড়ল। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে আমি হাঁটুভোর জল ভাঙতে ভাঙতে বাড়ীমুখো হলুম। আমাদের আগে আগে যাচ্ছিল একটি স্ত্রীলোক— কে সে, তার দিকে আমরা ভালো করে তাকিয়েও দেখি নি। সেও আস্তে আস্তে চলছে, আমরাও আস্তে আস্তে চলছি, কারণ অত জলে জোরে চলবার উপায়ও নেই।

 কিন্তু সেই দুর্যোগের রাত্রে প্রায়জনহীন পথেও যে আমাদের উপরে দৃষ্টিচালনা করবার জন্যে কৌতূহলী লোকের অভাব হয় নি, পরের দিন বৈকালে “যমুনা” কার্যালয়ে পদার্পণ ক’রেই সেটা বুঝতে পারলুম।

 ইতিমধ্যে কোন্ মহাপুরুষ চারিদিকে রটনা ক’রে দিয়েছেন, আমরা দুজনে নাকি গতকল্য রাত্রে এক গণিকার পিছু নিয়েছিলুম।

 আমি তো ব্যাপারটাকে হেসেই উড়িয়ে দিলুম, কিন্তু শরৎচন্দ্র তা পারলেন না। বিষম ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি বললেন, ‘ছি ছি, যা নয়, তাই! এমন হতভাগা লোকও থাকে! আমি বুড়োমানুষ, আর হেমেন্দ্র হচ্ছে একরত্তি ছোকরা, আমাদের দুজনের নাম জড়িয়ে এমন অপবাদ!’ তাঁর চোখ-মুখের ভাব দেখে মনে হ’ল, রটনাকারী সেখানে উপস্থিত থাকলে তার অঙ্গহানির সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট।

 শরৎচন্দ্র বয়সে আমার চেয়ে বছর এগারো বড় ছিলেন এবং তখন তাঁর বয়স ছিল বোধ হয় তেত্রিশ বৎসরের বেশী নয়। কিন্তু সেই বয়সেই তিনি নিজেকে ‘বুড়োমানুষ’ ব’লে প্রচার করতেন। একদিন রবীন্দ্রনাথের সামনেই তিনি বৃদ্ধত্বের উপরে এমনি অশোভন দাবি করতে কুণ্ঠিত হন নি, ফলে কবির চোখে ফুটে উঠেছিল কৌতুকযুক্ত বিস্ময়!

 শিল্পী-মন নানাদিক দিয়ে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে—কখনো কাব্য বা সাহিত্য, কখনো সঙ্গীত, কখনো চিত্র এবং কখনো বা অন্যান্য চারুকলার ভিতর দিয়ে। এর সেরা নজীর হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রধানত কবি রূপেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত বটে, কিন্তু ললিতকলার কত দিকে ছড়িয়ে থাকত তাঁর রসগ্রাহী মন! কখনো তিনি গীতিকার, কখনো তিনি সুরকার, কখনো তিনি নট এবং কখনো বা চিত্রকর।

 কিন্তু এ দেখে অবাক হবার কারণ নেই। সব আর্টেরই গোড়ার কথা এক। তাই এক শ্রেণীর শিল্পী চেষ্টা করলেই অন্য শ্রেণীর শিল্পীর গুপ্তকথা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। যিনি তা পারেন না, তাঁর শিল্পবোধ অল্প। আর্টের কোন বিভাগেই তিনি উচ্চশ্রেণীতে উন্নীত হবার যোগ্য নন।

 শরৎচন্দ্রকে সবাই জানে ঔপন্যাসিকরূপে। কিন্তু তাঁর আরো কিছু কিছু পরিচয় আছে, জনসাধারণের কাছে যা অজ্ঞাত। কেবল লেখনী নয়, তুলিকা চালনাতেও তাঁর হাত ছিল না অপটু। আত্মজীবনীর এক জায়গায় নিজেই বলেছেন, সুদীর্ঘ আঠারো বৎসরকাল তিনি লেখনী ত্যাগ ক’রে বসেছিলেন। ‘সাহিত্যের সঙ্গে হ’লো আমার ছাড়াছাড়ি, ভুলেই গেলাম যে জীবনে একটা ছত্রও কোনোদিন লিখেছি।’

 কিন্তু তাঁর মত অসামান্য শিল্পীর চিত্ত আর্টকে একেবারে ভুলে রিক্ত হয়ে থাকতে পারে না। কলম ছাড়লেন বটে, কিন্তু তুলিকা ধরলেন। তাঁর আঁকা ছবি যাঁরা দেখেছেন, প্রশংসা করেছেন। সে সব ছবি আমি দেখি নি, শরৎচন্দ্রের রেঙ্গুনের বাড়ীতে আগুন লেগে ছবিগুলি নষ্ট হয়ে যায়। ফিরে-ফিরতি কলম ধরবার পর ছবি আঁকা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

 তিনি সঙ্গীত চর্চাও করেছিলেন অল্পবিস্তর। বাঁশী বাজাতে পারতেন, আর পারতেন তবলা বাজাতে। শ্রীমতী অনুরূপা দেবীর মুখে জানতে পারি, যৌবনেই শরৎচন্দ্র গায়ক রূপেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। রেঙ্গুনে অজ্ঞাতবাস করবার সময়েও গানকে তিনি ত্যাগ করেন নি। কবিবর নবীনচন্দ্র সেন একবার রেঙ্গুনে বেড়াতে যান। তাঁর সম্বর্ধনা-সভায় উদ্বোধন-সঙ্গীত গেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁর কণ্ঠমাধুর্যে খুসি হয়ে কবি তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন “রেঙ্গুন-রত্ন”।

 সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ বৎসর আগেকার কথা। আমি তখন পাথুরিয়াঘাটায় আমাদের পুরাতন বাড়ীতে। মা এসে বললেন, ‘তোর পড়বার ঘরে কে একটি ভদ্রলোক চমৎকার গান গাইছেন।’ বিস্মিত হয়ে নীচে নেমে গিয়ে দেখি, গালিচার উপরে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে ব’সে আপন মনে গান গাইছেন শরৎচন্দ্রই। কণ্ঠস্বরে ওস্তাদির ছাপ না থাকলেও বড় মিষ্ট গলা। গাইতেও পারেন ভালো। কিন্তু আমার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই গান থেমে গেল। বহু অনুরোধেও আর তিনি গাইলেন না। এর পরেও প্রায় তিনি আমার ঘরে এসে বসতেন, সেখানে তাঁর জন্যে দ্বার থাকত অবারিত এবং মাঝে মাঝে আড়াল থেকে তাঁর গান শুনেছি আরো কয়েকবার। কিন্তু আমার সাড়া বা দেখা পেলেই তাঁর গান হ’ত বন্ধ।

 মসিজীবী শরৎচন্দ্রের মনের ভিতরে ছিল খানিকটা ক্ষাত্র বিশেষত্ব। তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সময়েই এটা টের পেতে বিলম্ব হয় নি। একদিন আমাদের জানিয়ে দিলেন যে, তিনি সর্বদাই সশস্ত্র হয়ে থাকেন এবং প্রমাণ দেবার জন্যে ফস্ ক’রে বার ক’রে ফেললেন মস্ত একখানা ছোরা! সাহিত্যিক শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর পাশ থেকে স’রে গিয়ে বসলেন ভয়ে ভয়ে, সচকিত চক্ষে।

 তারও কয়েক বৎসর পরে যখন তিনি রীতিমত যশস্বী এবং যখন তিনি বিখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিদিন উঠছেন বসছেন এবং সাজপোষাকেও বেশ সৌখীন হয়ে উঠেছেন, তখনও তাঁর হাতে থাকত একগাছা অত্যন্ত বেমানান, মোটাসোটা ও ভীতিকর লগুড়— যার আঘাতে অনায়াসেই গুঁড়ো হয়ে যেতে পারে মানুষের বা বড় বড় পশুর মাথা। প্রথম বয়সে শরৎচন্দ্র যাপন করেছিলেন দস্তুরমত দুর্দান্ত জীবন। উত্তরকালে একান্তভাবে সাহিত্যসাধক হয়েও বোধ করি তিনি পূর্ববর্তী বয়োধর্মের প্রভাব থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ক’রে নিতে পারেন নি। কেউ কোনদিন সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রকে লাঠালাঠি বা হাতাহাতি করতে দেখে নি বটে, কিন্তু তাঁর মনের ভিতরে নিশ্চয়ই আত্মগোপন ক’রে থাকত একটা উগ্র অংশ।

 তবে আমাদের কাছে তিনি ধরা দিয়েছিলেন যথার্থ প্রেমিক মানুষের মত। প্রায়ই সাহিত্য ও ললিতকলা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমাদের আলোচনা হ’ত এবং প্রায়ই আলোচনা গিয়ে দাঁড়াত বিষম তর্কাতর্কিতে। অধিকাংশ সময়েই আমরা চার বন্ধু—প্রভাত গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সুধীর সরকার ও আমি— থাকতুম এক পক্ষে। প্রভাত ছিলেন তো একাই একশো, তর্কে তাঁর মুখ বন্ধ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার, তার উপরে আবার আমরা তিনজন এবং আরো কেউ কেউ, শেষ পর্যন্ত শরৎচন্দ্রকে কোণঠাসা হয়ে মৌনব্রত অবলম্বন করতে হ’ত। তর্কের উত্তাপে আমরা সময়ে সময়ে অসংলগ্ন অপ্রিয় কথাও ব’লে ফেলেছি, কিন্তু কোনদিন তিনি মুখভার করেন নি, বরাবরই ক্ষমা করেছেন।

 পূর্বে যে লেড়ী কুকুরের বাচ্চার কথা বলেছি, শরৎচন্দ্র তার নাম রেখেছিলেন “ভেলু”। তার সব চেয়ে বড় সখ ছিল, যে কোন মানুষকে আদর ক’রে কামড়ে দেওয়া। তার এই বিপদজনক সখের জন্যে শরৎচন্দ্রের নামে আদালতে নালিশ হয়েছে, তবু ভেলুর বিরুদ্ধে তাঁর কোন অভিযোগ ছিল না। একদিন সে তার মনিবেরই করতল কামড়ে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় ক’রে দিয়েছিল। পরদিন ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা হাত নিয়ে শরৎচন্দ্র এসে বললেন, ‘আহা, আমাকে কামড়ে দিয়ে ভেলুর যে কি দুঃখ আর লজ্জা হয়েছিল, তার চোখ-মুখ দেখলেই তোমরা বেশ বুঝতে পারতে!’ এই ভেলু ঘরে ঢুকলেই সুধীর সরকার হন্তদন্ত হয়ে প্রাণপণে একটি লাফ মেরে একেবারে টেবিলের উপরে আরোহণ করতেন এবং সেই সারমেয়নন্দনকে সেখান থেকে অপসারিত না করা পর্যন্ত তিনি আর ভূমিষ্ঠ হবার নাম মুখেও আনতেন না।

 ভেলুর জন্যে হোটেল থেকে আসত ঘিয়ে ভাজা মটন চপ ও কাটলেট প্রভৃতি। প্রেমাঙ্কুর একদিন শরৎচন্দ্রের অসাক্ষাতে অভিযোগ করলেন, ‘শরৎবাবুর ব্যবহারটা দেখ একবার! একটা লেড়ী কুকুরের জন্যে আসছে ভালো ভালো খাবার, আর আমরা এতগুলো ভদ্রলোক যে এখানে উপস্থিত আছি, সেটা ওঁর খেয়ালেই আসে না!’

 কেবল ভেলুর উপরেই শরৎচন্দ্রের পক্ষপাতিত্ব ছিল না, তিনি ভালোবাসতেন কুকুর জাতটাকেই। তাঁর মোটর-চালকের উপরে নির্দেশ ছিল, ‘দেখ বাপু, তুমি যদি কোন মানুষ চাপা দাও, তাহ’লে হয়তো আমি কিছু বলব না। কিন্তু তুমি যদি কোন কুকুরকে চাপা দাও, তাহ’লে তখনি তোমার চাকরিটি যাবে।’

 এই ভেলু যখন মারা পড়ে তখন শরৎচন্দ্রের মুখ দেখে বিস্মিত হয়েছিলুম। পুত্রশোকেও কোন মানুষের মুখ তেমন কাতর হয় না।

 মনোমোহন থিয়েটার। চলচ্চিত্রে শরৎচন্দ্রের প্রথম বই “আঁধারে আলো” দেখানো হচ্ছে। একখানা বিছানা-পাতা ‘বক্সে’র উপরে শরৎচন্দ্র ও শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে ব’সে আছি আমি। ছবি দেখানো শেষ হ’ল। তারপর গাত্রোখান ক’রে শরৎচন্দ্র আবিষ্কার করলেন, তাঁর তালতলার চটির এক পাটি অদৃশ্য হয়েছে। অনেক খোঁজাখুজির পরেও চটির পাটি আর পাওয়া গেল না। সকলেরই ধারণা হ’ল, নিশ্চয়ই কোন চোরের কীর্তি! শরৎচন্দ্র তখন একপাটি চটি জুতাই বগলদাবা ক’রে নগ্নপদে প্রস্থানোদ্যত হলেন।

 আমি বললুম, ‘দাদা, ঐ একপাটি চটি আপনার আর কোন্ কাজে লাগবে? এইখানেই রেখে যান।’

 তিনি বললেন, ‘পাগল নাকি? চোর ব্যাটা আড়ালে কোথায় ঘাপ্‌টি মেরে ব’সে আছে। আমরা চ’লে গেলেই এই পাটিটাও নিয়ে যাবে।’

 বললুম, ‘কিন্তু একপাটি চটি নিয়ে আপনি কি করবেন?’

 —‘শিবপুরে যাচ্ছি। গঙ্গা পার হবার সময়ে জলে ফেলে দিয়ে যাব।’

 তিনি তাই-ই করেছিলেন। এদিকে পরদিন সকালেই থিয়েটারের চাকর ‘বক্সে’র তলা থেকে হারানো জুতোর পাটি টেনে বার করলে। কিন্তু তখন শরৎচন্দ্রের অন্য পাটিটাকে গঙ্গাগর্ভ থেকে উদ্ধার করবার আর কোন উপায়ই ছিল না।

 শরৎচন্দ্র পানিত্রাশের পল্লীভবনে যাবার পর বহুকাল তাঁর দেখা পাই নি। ইতিমধ্যে আমিও গঙ্গার ধারে আমার নূতন বাড়ীতে চ’লে এসেছি। একদিন দুপুরবেলায় বারান্দায় ব’সে লিখছি কি পড়ছি মনে নেই, হঠাৎ শুনতে পেলুম একতালায় সিঁড়ির কাছে কে পরিচিত কণ্ঠস্বরে আমার মেয়েদের সঙ্গে কথা কইছেন। বলছেন, ‘ওগো বাছারা, তোমরা যখন জন্মাওনি, তোমাদের বাবা তখন থেকেই আমার বন্ধু।’ গাত্রোখান ক’রে মুখ বাড়িয়ে দেখি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছেন শরৎচন্দ্র ও স্বর্গীয় কবি গিরিজাকুমার বসু

 এই অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে আমি অত্যন্ত বিস্মিত। উপরে এসে শরৎচন্দ্র বললেন, ‘গিরিজার সঙ্গে বরানগরের বাগানে যাচ্ছিলুম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়াতে এখানে চ’লে এসেছি।’

 তাঁকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বললুম, ‘কোথায় রবীন্দ্রনাথ আর কোথায় আমি! চাঁদের বদলে পাবেন আপনি জোনাকীকে। সিগারেট নিন।’

 —‘না, সিগারেট আর ভালো লাগে না। তামাক আছে?’

 —‘না দাদা। তবে হুইস্কি আছে।’

 —‘না, তাও খাব না।’

 —‘তবে কি খাবেন?’

 —‘গল্প। খালি গল্প করব।’

 তাই হ’ল। ঘণ্টাকয় ধ’রে চলল কেবল গল্প আর গল্প— পুরানো দিনের গল্প, আধুনিক সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের গল্প, পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের গল্প। দেখলুম পুরাতন শরৎচন্দ্র এতদিনেও একটুও পরিবর্তিত হন নি—অন্তত আমার কাছে।

 অবশেষে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হেমেন্দ্র, তুমি চমৎকার জায়গায় বাড়ী করেছ। কলকাতায় থেকেও তুমি কলকাতায় নেই, চোখের সামনে সর্বদাই দেখছ গঙ্গার জীবন্ত জলের ধারা। এমন সৌভাগ্য হয় কম লোকেরই। আচ্ছা, এইবারে তোমার বাড়ীর ঘরগুলো দেখাও দেখি।’

 তাঁকে তিনতলার, দোতলার ও একতলার প্রত্যেক ঘরের ভিতরে নিয়ে গেলুম। তিনি যে বিশেষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো পরীক্ষা করছেন, এটা বুঝতে পারলুম।

 তারপর তিনি যেন নিজের মনে মনেই বললেন, ‘এ বড় অন্যায় তো!’

 জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কি অন্যায় দাদা?’

 তিনি বললেন, ‘তোমার এক বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেদিন আমার কাছে অভিযোগ ক’রে এলেন, ‘হেমেন্দ্রের ঘরে ঘরে টাঙানো অশ্লীল, নগ্ন মূর্তির ছবি। চোখ তুলে তাকানো যায় না।’ কিন্তু আমি তোমার বাড়ীতে এসে একখানা অশ্লীল ছবিও তো দেখতে পাচ্ছি না! এ সব তো উঁচুদরের আর্ট, এ দেখে যার মনে অপবিত্র ভাব জাগে, তারই মন শ্লীল নয়।’

 শরৎচন্দ্র যথার্থ শিল্পী, তাই তিনি এই পরম সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। শ্রেষ্ঠ আর্ট কোনদিনই অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয় না। গ্রীক ভাস্কররা নগ্ন মূর্তি গড়তেন বটে, কিন্তু অশ্লীল মূর্তি গড়তেন না।

 শরৎচন্দ্র আমার সেই বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম প্রকাশ করেন নি। কিন্তু পরে গিরিজাকুমারের মুখে তাঁর নাম আমি শুনেছিলুম। তিনি বাংলাদেশের একজন অতিপরিচিত কবি। এখন স্বর্গত।

 শরৎচন্দ্রের সঙ্গে যখন আমার মৌখিক আলাপ হয় নি এবং যখন আমি তাঁকে চোখেও দেখি নি, সেই সময়ে (২০শে মার্চ, ১৯১৪ খৃঃ), রেঙ্গুন থেকে একখানি পত্রে তিনি আমাকে লিখেছিলেন: ‘আমার লেখার ওপরে আপনার অনুগ্রহ দেখে সত্যই বড় সুখী হয়েছি। অনেকেই অনুগ্রহ করেন বটে, কিন্তু লেখা আমার নিতান্তই মামুলী ধরণের। বিশেষত্ব আর কি আছে? তবে এটা ঠিক ক’রে রাখি যেন মনের সঙ্গে লেখার ঐক্য থাকে। যা ভাবি, তাই যেন লিখি। কে কি মনে করবে, ও কি বলবে, সেদিকে প্রায়ই তাকাই নে। বোধ করি এই জন্যেই লোকের মাঝে মাঝে ভালোও লাগে— কখনও বা লাগেও না, তবুও বড় একটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ক’রে লেখককে অপমানিত করতে চায় না। *** আমার বাংলা ভাষার ওপর মোটেই দখল নেই বললে চলে—শব্দ সঞ্চয় খুব কম। কাজেই আমার লেখা সরল হয়—আমার পক্ষে শক্ত ক’রে লেখাই অসম্ভব। আমার মুর্খতাই আমার কাজে লেগেছে।’

 যে সময়ে শরৎচন্দ্র এই পত্রখানি লিখেছিলেন, তখন তিনি আবার বহুকাল অজ্ঞাতবাসের পর নূতন ক’রে সাহিত্য-সাধনায় নিযুক্ত হয়েছেন। খ্যাতির প্রথম ধাপে পদার্পণ করেছেন মাত্র। কিন্তু তখনও এমন অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন নি যে, তাঁর উপর নির্ভর ক’রে একশো টাকা মাহিনার চাকরিটি ছেড়ে দিতে পারেন। অভাবিত আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তখনও তাঁর ধারণার মধ্যে ধরা দেয় নি। কিন্তু সেই সময়েই তাঁর মনের গড়নটি লক্ষ্য করবার বিষয়। তাঁর মত ছিল—‘যা ভাবি, তাই যেন লিখি।’ সে লেখা প‘ড়ে যে কেউ তুষ্টও হ’তে পারে, রুষ্টও হ’তে পারে, তা নিয়ে ছিল না তাঁর কিছুমাত্র মাথাব্যথা। তিনি আমরণ ছিলেন এইরকম নির্ভীক মনের অধিকারী।

 কিন্তু তিনি ছিলেন অভিমানী। “চরিত্রহীনে”র বিরুদ্ধে চারিদিকে যখন নিন্দার ঝড় উঠেছে, তখনও তিনি অটল ছিলেন। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মত ধুরন্ধর সাহিত্যিক যখন “চরিত্রহীনে”র পাণ্ডুলিপি প্রত্যাখ্যান করেন, তখন মনে মনে তিনি অল্প আহত হন নি। অথচ একখানি পত্রে তিনি নিজেই “চরিত্রহীন”কে বলেছেন ‘বখাটে উপন্যাস।’

 তাঁর অভিমানের আর একটি দৃষ্টান্ত দিই। বোধ করি প্রেসিডেন্সি কলেজের একটি ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিতে উঠে বঙ্কিমচন্দ্রকে তিনি ‘সেকেলে বঙ্কিম’ ব’লে উপহাস করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের অপরাধ, তিনি নাকি মামুলী প্রথায় পুণ্যের জয় ও পাপের পরাজয় দেখাবার জন্যেই গোবিন্দলালকে দিয়ে রোহিণীকে হত্যা করিয়েছেন প্রভৃতি। একখানি পত্রিকায় আমি তাঁর এই উক্তির প্রতিবাদ করি এবং দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখাই, শরৎচন্দ্রে চেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বেশী সেকেলে নন, কারণ শরৎচন্দ্রও একাধিক উপন্যাসে পাপের পরাজয় দেখাতে ছাড়েন নি এবং তাঁর কোন কোন নায়িকা পাপের জন্যে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন দণ্ড ভোগ করেছে। শরৎচন্দ্র আমার প্রতিবাদের জবাব দিলেন না বটে, কিন্তু এত বেশী রেগে গেলেন যে, প্রায় এক বৎসর ধ’রে আমার সঙ্গে দেখা হ’লেও ভালো ক’রে কথা কইতেন না। কিন্তু তিনি বেশী দিন মনের ভিতরে কারুর বিরুদ্ধে রাগ পুষে রাখতে পারতেন না। তাই আবার আমাদের মনের মিলনে বাধা হয় নি।

 শরৎচন্দ্রের দুই তিনটি ছোটগল্প বাজার সরগরম ক’রে তুলতেই প্রত্যেক পত্রিকার সম্পাদকই তাঁকে লেখকরূপে লাভ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে নূতন রচনা না পেয়ে সকলে এখানে-ওখানে খোঁজ নিতে লাগলেন, তাঁর কোন পুরানো লেখা পাওয়া যায় কিনা? একাধিক পুরাতন রচনার সন্ধান পাওয়া গেল এবং সেগুলি একে একে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হ’তে লাগল। তাঁর অজ্ঞাতসারেই।

 শরৎচন্দ্রের একাধিক পত্র পাঠ করলেই বেশ বোঝা যায়, এ জন্যে তিনি কম বিরক্ত হন নি। তাঁর দুই একটি মন্তব্য এখানে উদ্ধার করছি: ‘আমার ছেলেবেলার ছাইপাঁশ ছাপিয়ে আমাকে যে কত লজ্জা দেওয়া হচ্ছে এবং আমার প্রতি কত অন্যায় করা হচ্ছে তা আমি লিখে জানাতে পারি নে। সমাজপতি (সুরেশচন্দ্র) সমজদার লোক হয়ে, কেমন ক’রে যে ঐ ছাই ছাপালেন আশ্চর্য!’

 তাঁকে না জানিয়েই “ভারতী”তে বেনামে যখন “বড়দিদি প্রকাশিত হয়, তখন কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, সেটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের রচনা। কিন্তু “বড়দিদি” সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রের নিজের ধারণা অতটা উচ্চ ছিল না। তাঁর মতে ঐ রচনাটি ‘মন্দ হয় নাই। তবে, ওটা বাল্যকালের রচনা, ছাপানো না হইলেই বোধ করি ভাল হইত।’

 শরৎচন্দ্রের ধারণা ভ্রান্ত নয়। তাঁর রচনার জনপ্রিয়তা দেখে সম্পাদকেরা হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন—এমন কি সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মত উচ্চশ্রেণীর সম্পাদকও। তাই শরৎচন্দ্রের নূতন রচনা থেকে বঞ্চিত হয়ে তাঁরা তাঁর প্রথম বয়সের অপরিপক্ক রচনাবলী নিয়েই কাড়াকাড়ি করতে লাগলেন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এদের কতকগুলি আখ্যানবস্তু চলনসই হ’লেও রচনাভঙ্গীর উপরে বঙ্কিমচন্দ্রের বা রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান এবং কতকগুলি লেখা এমনিই অকিঞ্চিৎকর যে, প্রকাশ ক’রে লেখককে অপমান ছাড়া আর কিছুই করা হয় নি।

 আত্মশক্তির উপরে শরৎচন্দ্রের একটা অন্ধ নির্ভরতা ছিল এবং সময়ে সময়ে সেটা তিনি যুক্তিহীন শিশুর মতই সরলভাবে প্রকাশ ক’রে ফেলতেন। একদিনের কথা বলি। “যমুনা” তখন উঠে গেছে এবং সেই ঘরেই বসে সাপ্তাহিক সাহিত্য-পত্রিকা “মর্মবাণী”র আসর। শরৎচন্দ্র তখন পূর্ণচন্দ্রের মত সম্পূর্ণরূপেই সমুদিত।

 আমরা কয় বন্ধু মিলে ব’সে ব’সে গল্প করছি। রবীন্দ্রনাথের “ঘরে-বাইরে” তখন “সবুজপত্রে” ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে আরম্ভ হয়েছে ঘোরতর আন্দোলন। প্রসঙ্গক্রমে “ঘরে-বাইরে”র কথা উঠল। শরৎচন্দ্র বললেন, ‘রবিবাবু “সবুজপত্রে” “ঘরে-বাইরে” লিখছেন। এবারে “ভারতবর্ষে” আমার যে উপন্যাস বেরুবে, তোমরা নিক্তি ধ’রে দেখে নিও, তার ওজন “ঘরে-বাইরে”র চেয়ে এক তিল কম হবে না।’

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনার লেখা শেষ হয়ে গেছে?’

 তিনি বললেন, ‘না, এখনো লেখা আরম্ভই হয় নি।’

 আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম। কিন্তু সেখানে ছিলেন শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। কারুর যুক্তিহীন কথাই তিনি চুপ ক’রে শোনবার ছেলে নন। বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস এখনো শেষ হয় নি, আর আপনার উপন্যাস এখনো লেখাই হয় নি! যা এখনো লেখেন নি, তার সঙ্গে কি ক’রে “ঘরে-বাইরে”র তুলনা করছেন?’

 তবু শরৎচন্দ্র বললেন, ‘দেখে নিও।’

 যতদূর মনে পড়ে, শরৎচন্দ্রের পরবর্তী উপন্যাসের নাম গৃহদাহ”, তার একটি চরিত্রের উপরে রবীন্দ্রনাথের অন্য একখানি উপন্যাসের একটি বিখ্যাত চরিত্রের স্পষ্ট ছায়া আছে।

 এই উপন্যাস সম্বন্ধেই কি একখানি পত্রে শরৎচন্দ্র এই কথাগুলি লিখেছিলেন? ‘এ গল্পটা ‘গোরার’ (রবীন্দ্রনাথের) ‘পরেশবাবুর’ ভাব নেওয়া। অর্থাৎ নিজেদের কাছে বলতে ‘অনুকরণ’। তবে ধরবার যো নেই। আমার সন্দেহ সত্য হ’লে বলতে হবে, উপন্যাস লিখতে আরম্ভ ক’রে শরৎচন্দ্র নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, তিনি “ঘরে-বাইরে”র সমকক্ষ কোন কিছু রচনা করছেন না। আর সত্য কথা বলতে কি, “গৃহদাহ” কেবল “ঘরে-বাইরে”র সঙ্গে তুলনীয় তো নয়ই, উপন্যাসখানি শরৎচন্দ্রের কথা-সাহিত্যের মধ্যেও উচ্চ স্থান অধিকার ক’রে নেই।

 গোড়া থেকেই দেখে এসেছি, শরৎচন্দ্রের মধ্যে ছিল না কোন রকম ‘পোজ’ বা ঢং। যখন সর্বত্রই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিকরূপে স্বীকৃত ও সমাদৃত হয়েছেন, তখনও তিনি নিজেকে অভিজাত বা হোমরাচোমরাদের একজন ব’লে পরিচিত করবার কোন চেষ্টাই করতেন না। এবং কতদিনই তাঁর মুখে এই সব কথা শুনেছি—‘ইন্‌টেলেক্‌চুয়াল গল্প কাকে বলে হেমেন্দ্র? ও বস্তুটি তো আমি জানি না! অভিজাত সাহিত্যিক বলে কাদের? যাঁরা লোককে ধাপ্পা দিয়ে, ধাক্কা মেরে চমকে দেন? আমি বাপু, বেশী লেখাপড়াও করি নি, আমার জ্ঞানও খুব বেশী নয়। তবু যে লোকে আমার লেখা পড়তে চায়, তার কারণ হচ্ছে আমি নিজের চোখে যা দেখি, আর নিজের মনে যা অনুভব করি, লেখার ভিতর দিয়ে কেবল সেইটুকু প্রকাশ করতে চাই।’

 কিন্তু শরৎচন্দ্রের লেখার সঙ্গে মুখের কথা মিলত না মাঝে মাঝে। একদিন আমাকে তিনি বললেন, ‘সাহিত্যে দুরাত্মার ছবি আঁকা উচিত নয়। পৃথিবীতে দুরাত্মা আছে তো অসংখ্য, তাদের আবার সাহিত্যক্ষেত্রে টেনে আনা কেন?’

 আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলুম, তিনি নিজেই দুরাত্মার ছবি এঁকেছেন। তিনি আর কিছু বললেন না।

 আর একদিন আমাকে বললেন, ‘হেমেন্দ্র, কখনও অনুবাদ কোরো না, ওটা হচ্ছে পণ্ডশ্রম।’

 আমি বললুম, ‘আমার পক্ষে হয় তো ওটা খানিকটা পণ্ডশ্রমই বটে, কিন্তু অনুবাদের যথেষ্ট সার্থকতা আছে। অনুবাদের সাহায্যে যে কোন সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ক’রে তোলা যায়।’

 তবু তিনি বললেন, ‘না, অনুবাদ করা আমি পছন্দ করি না।’

 শেষের দিকে শরৎচন্দ্রের মত বদলেছিল বটে, কিন্তু গোড়ার দিকে তিনিও অনুবাদ করতে ছাড়েন নি। তাঁর দ্বারা দু’খানি ইংরেজী উপন্যাস অনূদিত হয়েছিল। “ইষ্টলিন” অবলম্বনে “অভিমান” এবং “মাইটি অ্যাটম” অবলম্বনে “পাষাণ”। এই দুটি রচনার পাণ্ডুলিপি এখন কার কাছে আছে তা জানি না, কিন্তু প্রকাশ করলে নিশ্চয়ই কৌতূহলী পাঠকের অভাব হবে না।

 শরৎচন্দ্রের লেখা সহজ, সরল এবং পড়বার সময়ে মনে হয় যেন তা স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু আমি একাধিকবার রচনায় নিযুক্ত শরৎচন্দ্রকে দেখবার সুযোগ পেয়েছি। তিনি অনায়াসে তাড়াতাড়ি লিখতে পারতেন না। একবার ধীরে ধীরে লিখতেন, আবার জায়গায় জায়গায় লেখা কাটতেন, আবার কলম থামিয়ে চুপ ক’রে ভাবতেন, সে সময়ে বোধ হ’ত মনে মনে তিনি যেন কষ্টভোগ করছেন। তাঁর লেখার আরো কিছু কিছু বিশেষত্ব ছিল। তিনি খুব দামী ও ভালো কাগজ ব্যবহার করতেন। যখন বাঙালী লেখকদের মধ্যে ফাউনটেন পেনের বিশেষ চলন হয় নি, তখনও তিনি ফাউনটেন পেন ছাড়া আর কোনরকম কলম নিয়ে কাজ করতেন না। তাঁর লেখার ছাঁদ ছিল ছোট ছোট, কিন্তু বড় সুন্দর। ঠিক যেন মুক্তার সারি।

 নানা সাহিত্য-বৈঠকে ও অন্যান্য স্থানে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়েছে যে কতবার, তা গণনা ক’রে বলা অসম্ভব। আমার বাড়ীতে দয়া ক’রে বার বার তিনি এসেছেনও। কিন্তু শিবপুরে বা পানিত্রাশে তাঁর কোন বাড়ীতে কোন দিনই আমার যাওয়া হয়ে ওঠে নি। তাঁর বালীগঞ্জের বাড়ীতেও আমি গিয়েছিলুম একবার মাত্র। আমি তখন কোন্ পত্রিকার সম্পাদক, ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। একটি রচনা ভিক্ষা করবার জন্যে একদিন শরৎচন্দ্রের বাড়ীতে গিয়ে ধর্না দিলুম। আমার সঙ্গে ছিলেন শ্রীপশুপতি চট্টোপাধ্যায়, তিনি আগে ছিলেন উদীয়মান সাহিত্যিক, এখন হয়েছেন চলচ্চিত্র-পরিচালক।

 শরৎচন্দ্র আমাদের দেখে খুসি হলেন, দু’জনকে নিয়ে গিয়ে বসলেন একতলার একখানি প্রশস্ত ঘরে। অল্পক্ষণ কথাবার্তার পর আমাদের আগমনের কারণ বললুম।

 তিনি দুঃখিতভাবে বললেন, ‘আমি আর লেখা দিতে পারব না, আমি আর লিখতে পারি না। মাথায় বিষম যন্ত্রণা, কলম ধরা অসম্ভব।’

 আমি আর পীড়াপীড়ি করলুম না, ওটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। অন্য কথা পাড়লুম।

 খানিকক্ষণ গল্প করবার পর শরৎচন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চল হেমেন্দ্র, তোমাকে আমার বাড়ীর ভিতরটা দেখিয়ে আনি।’

 আমাকে নিয়ে শরৎচন্দ্র তাঁর বাড়ীর একতলার ও দোতলার কয়েকখানি ঘর দেখালেন। তাঁর লেখবার ঘরটিও দেখলুম। ছোট ঘর। বিশেষ কোন আসবাব বা সাজসজ্জা নেই। ছোট একটি টেবিলের উপরে বৈদ্যুতিক আলোদান এবং এলোমেলোভাবে ছড়ানো এটা ওটা সেটা। একদিকে একটি ছোট পুস্তকাধার, তার তাকে সাজানো কতকগুলি ইংরেজী পুস্তক। সাহিত্যিকের ঘর ব’লে মনে হ’ল না।

 শরৎচন্দ্র বললেন, ‘কত লোকই দেখা করতে আসেন, কিন্তু তুমি আসো না কেন? তোমার মত পুরানো বন্ধুর মুখ দেখলে আমার মনে আনন্দ হয়।’

 বললুম, ‘এই তো আজ এসেছি দাদা!’

 —‘হ্যাঁ, দায়ে প’ড়ে।’

 হেসে বললুম, ‘কিন্তু সে দায় থেকেও তো আপনি আমাকে উদ্ধার করলেন না!’

 করুণ চোখে আমার দিকে চেয়ে শরৎচন্দ্র বললেন, ‘বিশ্বাস কর হেমেন্দ্র, আমি আর লিখতে পারি না। তুমি আমার শরীরের অবস্থা জানো না, লেখা আমার আসে না।’ তাঁর কণ্ঠস্বরে কাতরতা।

 সেদিনও আমি সন্দেহ করতে পারি নি, মৃত্যু তাঁর কত কাছে এগিয়ে এসেছে! তারপর সত্য সত্যই তিনি আর কোন নূতন রচনায় হাত দেন নি।

 তার কিছুদিন পরে বেতার প্রতিষ্ঠানে শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে নাটোরের মহারাজা প্রমুখ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। বক্তার পর বক্তা উঠে চিরাচরিত নিয়মে শরৎচন্দ্রের সুদীর্ঘ জীবন কামনা করে দু’-চার কথা বললেন। ভালো লাগল না।

 আমি উঠে বললুম, ‘আমি মানুষ শরৎচন্দ্রের সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি না। আমি সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি।’ আর কি বলেছিলুম মনে পড়ে না।

 আমার কথা শরৎচন্দ্রের খুব ভালো লেগেছিল এবং তাই উপলক্ষ্য ক’রে তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। শুনেছি, বেতারের কর্তৃপক্ষ শরৎচন্দ্রের বক্তৃতাটি ‘রেকর্ডে’ ধ’রে রেখেছেন।

 সেই শরৎচন্দ্রের শেষ জন্মোৎসব, সেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।