তেইশ

 ঊনত্রিশ বছর আগেকার কথা। সাধারণ রঙ্গালয়ে শ্রীযুক্ত শিশিরকুমার ভাদুড়ী সবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর অপূর্ব নাট্যপ্রতিভা দেখে বিশেষজ্ঞদের বুঝতে বিলম্ব হ’ল না যে, গিরিশোত্তর যুগের জরাজীর্ণ অভিনয়মঞ্চ ভূমিসাৎ হবার সময় এসেছে।

 ষ্টার থিয়েটার চালাচ্ছেন তখন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মঞ্চে অভিনয় হচ্ছে, ভিতরে ব’সে আমি অপরেশবাবুর সঙ্গে আলাপ করছি। এমন সময়ে ফিটফাট বিলাতী পোষাক প’রে একটি যুবকের আগমন। তাঁর মার্জিত মুখশ্রী ও সুগঠিত দেহ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভাবভঙ্গির মধ্যেও আভিজাত্যের লক্ষণ।

 জিজ্ঞাসু চোখে অপরেশচন্দ্রের মুখের দিকে তাকালুম। তিনি বললেন, ‘উনি হচ্ছেন মিঃ মুখার্জি—রাধিকানন্দ মুখার্জি। উঁচুদরের সৌখীন অভিনেতা।’

 তখনকার সৌখীন অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচিত ছিলুম না। রাধিকানন্দ কোন্ শ্রেণীর অভিনেতা আমি তা জানতুম না, কোনদিন তাঁর নাম পর্যন্ত শুনি নি। সেইদিনই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হ’ল এবং তাঁর নিজের মুখেই শুনলুম, তিনি সিমলার পাহাড়ে থাকেন। সরকারি আপিসে কাজ করেন। দীর্ঘকালের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছেন।

 বললুম, ‘শিশিরবাবু তো দু’দিনেই আসর খুব জমিয়ে তুলেছেন। আপনারও অভিনয় করবার ইচ্ছা আছে নাকি?’

 তিনি বললেন, ‘ইচ্ছা তো আছে, কিন্তু সুযোগ কই?’

 এরই দিন কয় পরে মিনার্ভা থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী স্বর্গীয় উপেন্দ্রনাথ মিত্র ও অধ্যক্ষ স্বর্গীয় সতীশচন্দ্র রায় আমার বাড়ীতে এসে উপস্থিত হলেন। উপেন্দ্রবাবু বললেন, ‘শিশিরবাবু এসে আমাদের বাজার মাটি ক’রে দিয়েছেন। সেইজন্যে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছি।’

 সতীশবাবু বললেন, ‘আমরা বেশ বুঝতে পারছি, কেবল পুরানো দলের লোক নিয়ে থিয়েটার আর চলবে না। আমরাও শিশিরবাবুর মত কোন শিক্ষিত নূতন অভিনেতা চাই। বাজারে নরেশচন্দ্র মিত্রের খুব নাম-ডাক শুনতে পাই। তিনি যদি আমাদের থিয়েটারে যোগ দেন, তাহ’লে আমরাও শিশিরবাবুর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারি। এ বিষয়ে আপনি কিছু সাহায্য করবেন?’

 আমি বললুম, ‘চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি।’

 তখনও নরেশচন্দ্রের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয় নি। কিন্তু ইতিমধ্যে রাধিকানন্দের সঙ্গে আরো দুই-তিনবার দেখা হয়েছে এবং তাঁরই মুখে শুনেছি তিনি শিশিরকুমার ও নরেশচন্দ্রকে ঘনিষ্ঠভাবেই চেনেন। মিনার্ভা থিয়েটারের প্রস্তাব নিয়ে আমি তাঁরই কাছে গেলুম এবং সব শুনে তিনি বললেন, ‘আমি নরেশকে মিনার্ভা থিয়েটারে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু সেইসঙ্গে আমিও ওখানে নামতে চাই।’

 কিন্তু মিনার্ভার কর্তৃপক্ষের কাছে রাধিকানন্দ ছিলেন তখন Dark horse-এর মত। প্রথমটা তাঁরা ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। তারপর আমি যখন বললুম, ‘শিশিরবাবুর মুখে শুনেছি, রাধিকানন্দ একজন ভালো অভিনেতা’, তখন তাঁরা আর অমত করলেন না।

 মিনার্ভায় এলেন নরেশচন্দ্র ও রাধিকানন্দ। তাঁদের মঞ্চস্থ করবার জন্যে “চন্দ্রগুপ্ত” নাটকের পুনরভিনয়ের আয়োজন করা হ’ল। চাণক্য ও আণ্টিগোনাসের ভূমিকায় যথাক্রমে নরেশচন্দ্র ও রাধিকানন্দ।

 আণ্টিগোনাসের ভূমিকাটি রাধিকানন্দ যে নিজের জন্যে কেন রেছে নিয়েছিলেন, প্রথমটা আমি তা আন্দাজ করতে পারি নি। ওটি হচ্ছে “চন্দ্রগুপ্তে”র একটি অবান্তর ভূমিকা, তখন পর্যন্ত তা বিশেষভাবে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি। রাধিকানন্দ মহলাও দিতে লাগলেন নিতান্ত সাধারণ ভাবেই, তাঁর অভিনয়ে যে অসাধারণ কিছু পাব তাও আমি বুঝতে পারলুম না।

 কিন্তু তিনি মন্মথনাথ পালের (হাঁদুবাবু) চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন নি। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘রাধিকাবাবু মহলার সময়ে নিজের কলকৌশল প্রকাশ করতে রাজি নন। কিন্তু দেখবেন, ওঁর অভিনয় খুব উৎরে যাবে।’

 সফল হ’ল তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী। প্রথম পুনরভিনয়ের রাত্রে পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগারে দর্শকরা ঘন ঘন করতালি দিয়ে পরম সমাদরে অভিনন্দিত করলে রাধিকানন্দের অভিনয়কে এবং তারপর থেকে আণ্টিগোনাসের সেই অবান্তর ভূমিকাটিই নাটকের মধ্যে হয়ে উঠল প্রধান ভূমিকার মত। কেবল আমিই অবাক হলুম না, মিনার্ভার কর্তৃপক্ষও রীতিমত বিস্মিত। তাঁর সংলাপ, দৈহিক ভঙ্গিমা, মৌখিক ভাবের ব্যঞ্জনা এবং প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ সমস্তই হ’ল এমন অভিনব যে দর্শকরা উপলব্ধি করলে অভাবিত আনন্দ। নাট্যগগনে যে একটি নূতন তারকার সন্ধান পাওয়া গেল, সে সম্বন্ধে আর কারুর কোন সন্দেহ রইল না।

 একক শিশিরকুমার পুরাতনকে ম্লান ক’রে দিয়েছিলেন বটে, তবে পুরাতনের প্রভাব থেকে আমাদের নাট্যজগৎ তখনো মুক্ত হ’তে পারে নি। কিন্তু শিশিরকুমারের অব্যবহিত পরেই এলেন রাধিকানন্দ ও নরেশচন্দ্র এবং তারপরেই নির্মলেন্দু লাহিড়ী! এঁরা প্রত্যেকেই যখন জনসাধারণের প্রশস্তি লাভ করলেন, তখন ষ্টার থিয়েটারের কর্তৃপক্ষও আর উদাসীন হয়ে থাকতে পারলেন না, তাঁরাও সাদরে আহ্বান করলেন শ্রীতিনকড়ি চক্রবর্তী, শ্রীঅহীন্দ্র চৌধুরী ও স্বর্গীয় দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতিকে। এবং তারপরেই শিশিরকুমার আবার আর একদল নূতন শক্তিশালী অভিনেতা (বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, যোগেশ চৌধুরী, ললিত লাহিড়ী, শৈলেন চৌধুরী, তুলসীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শ্রীরবি রায় ও শ্রীজীবন গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি) নিয়ে আর একটি সম্প্রদায় গঠন করলেন, তখন পুরাতনের কোন গর্বই আর অবশিষ্ট রইল না, তার প্রধান দুর্গ মনোমোহন থিয়েটারের অস্তিত্ব পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে গেল।

 আণ্টিগোনাসের পর নাদির সাহ, প্যালারাম ও কেলো প্রভৃতি ভূমিকায় দেখা দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই রাধিকানন্দ একজন চৌকস অভিনেতা ব’লে অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। ভবিষ্যতের জন্যে তাঁর আসন হয়ে গেল নির্দিষ্ট। তিনি ছিলেন একজন পদস্থ সরকারি কর্মচারী, ছয় মাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। ক্রমে ছুটি এল ফুরিয়ে, কিন্তু তবু তাঁর ব্যস্ততা নেই। পাদপ্রদীপের মোহ তাঁকে এমনভাবে পেয়ে বসল যে, তিনি স্থির ক’রে ফেললেন, আপিসের চাকরি আর করবেন না। চাকরি ছাড়তে আমি তাঁকে মানা করেছিলুম, কিন্তু তিনি শোনেন নি। ফল ভালো হয় নি। যশস্বী হলেন যথেষ্ট বটে, কিন্তু অর্থাভাবে মাঝে মাঝে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন— বিশেষতঃ শেষজীবনে। আর্ট পাশ্চাত্য দেশে গিয়ে অর্থকর হয়, কিন্তু বাংলাদেশে এসে অধিকাংশ শিল্পীকেই সে যশ দিতে পারলেও টাকা দিতে পারে না।

 রাধিকানন্দ নানা রঙ্গালয়ে যত ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, এখানে তার সুদীর্ঘ তালিকা আর দাখিল করলুম না। কিন্তু কি গম্ভীর, কি বীর এবং কি হাস্যরসের অভিনয়ে তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। “খাসদখলে”র নিতাইয়ের ভূমিকায় এবং “বলিদানে”র দুলালচাঁদের ভূমিকায় যথাক্রমে অমৃতলাল বসু ও দানীবাবু ছিলেন অতুলনীয়। কিন্তু ঐ দুটি ভূমিকাও গ্রহণ ক’রে তিনি বড় অল্প শক্তির পরিচয় দেন নি। গোড়ার দিকে তাঁর অভিনয় একটু অতিরিক্ত মাত্রায় ‘মেলো-ড্রামাটিক’ হয়ে উঠত বটে, কিন্তু ক্রমেই এই বাহুল্য থিতিয়ে যায় এবং তাঁর অভিনয় হয়ে ওঠে রীতিমত সংযত ও পরম স্বাভাবিক।

 আর এক শ্রেণীর ভূমিকাভিনয়ে নূতন দলের মধ্যে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না আর কেউ। যখনই তিনি সাহেবের বা ইঙ্গবঙ্গের ভূমিকায় নেমেছেন, তখনই আসর একেবারে মাৎ ক’রে দিয়েছেন। সিমলার পাহাড়ে তিনি প্রায় য়ুরোপীয়দের মতই জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন এবং দীর্ঘকাল ধ’রে সাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করবার সুযোগ পেয়েছেন। হাউইট-ফিলিপদের বিলাতী নাট্য-সম্প্রদায় কিছুকাল সিমলার পাহাড়ে অবস্থান করে, সেই সময়ে তিনিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে একাধিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সুতরাং এ শ্রেণীর ভূমিকায় অভিনয় করবার মত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যে তাঁর যথেষ্ট ছিল, এটুকু সহজেই বোঝা যায়। এই অভিজ্ঞতার অভাবেই আমাদের রঙ্গালয়ের সাহেবের ভূমিকাগুলি প্রায়ই দস্তুরমত হাস্যকর হয়ে ওঠে, সেগুলিকে সাহেবের সঙ ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। “রাজা বাহাদুর” প্রহসনে মাতাল ইংরেজের ভূমিকায় রাধিকানন্দের যে চমৎকার অভিনয় দেখেছিলুম, তার ছবি এখনো আমার মন থেকে মুছে যায় নি। অমৃতলাল বসুও ঐ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, কিন্তু তিনিও রাধিকানন্দের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি।

 সাধারণ আবৃত্তির শক্তিও তাঁর অল্প ছিল না। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের “পুরাতন ভৃত্য” ও ইংরেজীতে টেনিসনের “দি চার্জ অফ দি লাইট ব্রিগেডে”র আবৃত্তি তাঁর মুখে শ্রবণ ক’রে মুগ্ধ হন নি এমন লোক নেই। এম্পায়ার থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের “চিত্রাঙ্গদা” খুলে অর্জুনের ভূমিকার অপূর্ব অভিনয় ক’রে তিনি প্রমাণিত করছিলেন যে, গদ্যের মত পদ্যেও কাব্যমাধুর্য যথাযথভাবে অভিব্যক্ত করবার ক্ষমতা ছিল তাঁর কত বেশী। সেই নাট্যাভিনয়ে তিনি উচ্চশ্রেণীর প্রয়োগনৈপুণ্যেরও পরিচয় দিয়েছিলেন।

 কিন্তু নির্মলেন্দুর মত রাধিকানন্দও বৈতনিক অভিনেতার কাজে নিযুক্ত থেকে নিজের পরিপূর্ণ শক্তির সদ্ব্যবহার ক’রে যেতে পারেন নি। একটি নিজস্ব সম্প্রদায় গঠন ক’রে নাট্যাচার্যের কর্তব্য পালন করবার মত প্রতিভাও তাঁর ছিল। তবে সে শক্তির অল্পবিস্তর পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন তিনি শ্রীযুক্ত জ্যোতি বাচস্পতি প্রণীত “নিবেদিতা” নাটকখানি খুলে। গান রচনার, সুর সংযোজনার ও নৃত্য-পরিকল্পনার ভার আমার উপরে দিয়ে তিনি আর সব ভারই নিজের হাতে তুলে নিলেন। সম্প্রদায়ের অধিকাংশ নট-নটীই একেবারে কচি ও কাঁচা। তারা যে কতটা মুখ রক্ষা করতে পারবে, সে সম্বন্ধে আমার অল্প সন্দেহ ছিল না। কিন্তু রাধিকানন্দ সকলকে এমন অভাবিত ভাবে গ’ড়ে-পিটে ‘মানুষ’ ক’রে তুলতে লাগলেন যে, তাঁর নাট্যশিক্ষা দেবার ক্ষমতা দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলুম না। যথাসময়ে “নিবেদিতা” মঞ্চস্থ হ’ল এবং প্রত্যেক নট-নটীই আপন আপন ভূমিকার মর্যাদা রক্ষা করলেন। অভিনয়ের এবং প্রয়োগনৈপুণ্যের দিক দিয়ে নাট্যরসিকদের কাছ থেকে প্রভূত প্রশংসা লাভ করেছিল ঐ নাট্যাভিনয়। এর পরেও একাধিক রঙ্গালয়ে আমি রাধিকানন্দকে অভিনয় শিক্ষা দিতে দেখেছি। নবযুগে অভিনয়শিক্ষকরূপে আমি শিশিরকুমারের পরেই তাঁর স্থান নির্দেশ করতে পারি। এ বড় অল্প সুখ্যাতির কথা নয়।

 রাধিকানন্দ ছিলেন আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রায়ই এসে আমার সঙ্গে দেখা করতেন। একদিন বাড়ীর একতলা থেকে শোনা গেল রাধিকানন্দের কণ্ঠস্বর। নীচে নেমে দেখি, তিনি আমার মধ্যমকন্যা শেফালিকার কাঁধে মাথা রেখে ক্রন্দন করছেন।

 সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ব্যাপার কি রাধিকা?’

 তিনি সাশ্রুনেত্রে কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই হেমেন্দ্র, আমি আর বাঁচব না। আমার মুখে ক্যান্সার হয়েছে।’

 কিছুদিন পরেই পেলুম রাধিকানন্দের মৃত্যুসংবাদ। নাট্যজগতে আর কেউ এখনো তাঁর অভাব পূরণ করতে পারেন নি।