ছয়

 আমাদের সাধারণ রঙ্গালয়ের অধিকাংশ পালাই অভিনেতা ও রঙ্গালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই রচনা করতেন—যদিও এখানকার “পাবলিক থিয়েটার” গুলি গ’ড়ে ওঠে সর্বপ্রথমে সাহিত্যিকদেরই অবলম্বন ক’রে। ক্রমে অবস্থা এমন হ’য়ে দাঁড়ায় যে, বাইরের কোন নাট্যকারেরই রঙ্গালয়ের ভিতরে পাত্তা পাবার উপায় রইল না। তারপর এই ধারা বদলে দেন ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল।

 দু’জনেই ওঁরা সমবয়সী ছিলেন এবং দু’জনেই করতেন কবিতা রচনা। বাল্যকালে “জন্মভূমি” ও অন্যান্য পত্রিকায় আমি ক্ষীরোদপ্রসাদের রচিত কবিতা পাঠ করেছি। নাট্যকার রূপে বিখ্যাত হবার পরেও তিনি মাঝে মাঝে কবি ও সাহিত্যিকরূপে সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে ছাড়েন নি।

 তিনি ছিলেন রসায়ন-বিদ্যার অধ্যাপক এবং কাব্যরস ও নাট্যরস নিয়েও সখের কারবার করতেন অবসরকালে। কিন্তু প্রথম প্রথম যথেষ্ট চেষ্টা ক’রেও তিনি রঙ্গালয়ের দরজা খোলা পান নি। কোন বড় ও চল্‌তি রঙ্গালয়ের মালিকই তাঁকে কল্‌কে দিতে রাজি হলেন না। অবশেষে তাঁর কপাল ফিরল। “এমারেল্ড থিয়েটার” অত্যন্ত অচল অবস্থায় প’ড়ে তাঁর “ফুলশয্যা” নামে একখানি নাটক গ্রহণ করতে বাধ্য হ’ল। কিন্তু তবুও নাট্যকাররূপে ক্ষীরোদপ্রসাদ জাতে উঠতে পারলেন না, “এমারেল্ড থিয়েটার”ও বাঁচল না।

 প্রায় বৎসর দু’য়েক পরে আবার এক সুযোগ উপস্থিত হয়। আমার দ্বারা সম্পাদিত “নাচঘরে” প্রকাশিত নাট্যকার অতুলকৃষ্ণ মিত্রের “আত্মজীবনী” পাঠ ক’রে জানতে পারি, “আলিবাবা” গীতিনাটকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ গিয়েছিলেন তাঁর কাছে এবং তিনিই নাকি পালাটির অধিকাংশ গান বেঁধে দেন ও বাকি কোন কোন গান গিরিশচন্দ্র প্রভৃতির রচনা। অতুলবাবুই “আলিবাবা”র অভিনয়ের ব্যবস্থা ক’রে দেন। “ক্লাসিক থিয়েটার” নব-প্রতিষ্ঠিত রঙ্গালয় হয়েও তখন দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছিল না এবং রঙ্গালয়ের সেই দুর্ভাগ্যই হ’ল ক্ষীরোদপ্রসাদের সৌভাগ্যের হেতু। সব দিক দিয়ে সার্থক হয়ে উঠল “আলিবাবা”র অভিনয়, মালিকের ঘরে আসতে লাগল কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। বিজ্ঞাপনে “আলিবাবা”কে বলা হ’ল—“ক্লাসিকের বিজয়বৈজয়ন্তী!”

 এই “আলিবাবা”ই হ’ল ক্ষীরোদপ্রসাদের পক্ষে রঙ্গালয়ের প্রবেশপত্রের মত। পরের বৎসরেই (১৮৯৮ খৃঃ) “রয়েল বেঙ্গল থিয়েটারে” অভিনীত হয়ে তাঁর “প্রমোদরঞ্জন” গীতি-নাটকও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঐখানে তাঁর “কুমারী” ও “বভ্রুবাহন” নাটকও পাদপ্রদীপের আলোক আসে। তার কিছুকাল পরেই তিনি প্রধান নাট্যকাররূপে ষ্টার থিয়েটারে যোগ দেন এবং ঐ সম্প্রদায়ের জন্যে একমাত্র “রঘুবীর” ছাড়া পর পর অশ্রান্তভাবে রচনা করেন “সপ্তম প্রতিমা”, “সাবিত্রী” “বেদৌরা”, “প্রতাপাদিত্য”, “বৃন্দাবন-বিলাস”, “রঞ্জাবতী” (১৯০৪ খৃঃ)। (এই সময়েই রঙ্গালয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের আত্মপ্রকাশ), “নারায়ণী”, “পদ্মিনী”, “উলুপী” ও “পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত” প্রভৃতি নাটক। রঙ্গালয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত হ’ল নির্দিষ্ট আসন।

 রঙ্গালয়ের নট-নাট্যকাররা সাধারণতঃ নিজেদের রচনায় বা ভাষায় কাব্যরস বা সাহিত্যরস বিতরণের চেষ্টা করতেন না। কিন্তু ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল প্রথমে ছিলেন কবি, পরে তাই নাটকেও উচ্চশ্রেণীর কাব্যরসকে পরিহার করতে পারেন নি এবং এইজন্যে তাঁদের নাটক নট-নাট্যকারদের নাটকের চেয়ে পাঠ ক’রে বেশী আনন্দ পাওয়া যায়।

 স্বদেশী আন্দোলনের যুগে নাট্যজগৎ থেকে সর্বপ্রথম সাড়া দিয়েছিলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ, জাতীয় ভাবদ্যোতক নাটক “প্রতাপাদিত্য” রচনা ক’রে। গত শতাব্দীতে যখন মহাত্মা গান্ধীও অচ্ছূত বা অস্পৃশ্যদের পক্ষাবলম্বন করেন নি, তখন তিনি “কুমারী” নাটকে সেই সমস্যার সমাধান করেছিলেন। তাঁর “রঘুবীরে”ও হিংসা ও অহিংসা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর “আলমগীর” নাটকে দেখি, পরস্পরের প্রবল শত্রু হয়েও জাতির ও দেশের কল্যাণের জন্যে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরের প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ হ’তে পারে। একদিকে তিনি যেমন হালকা কৌতুক-নাট্য রচনা ক’রে তরল আনন্দ বিতরণের চেষ্টা করেছেন, অন্য দিকে তেমনি বিদগ্ধমণ্ডলীর উপযোগী চিন্তার খোরাক যোগাতেও কুণ্ঠিত হন নি কিছুমাত্র।

 “জাহ্নবী” পত্রিকার জন্যে লেখার তাগিদ দিতে গিয়ে সর্বপ্রথমে দেখি ক্ষীরোদপ্রসাদকে। একহারা দেহ, বর্ণ কৃষ্ণ, মুখ হাসিমাখা, সরল ও মিষ্ট কথাবার্তা, কোনরকম Pose বা ভঙ্গী নেই। দেখলেই সেকালের ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের কথা স্মরণ হয়।

 বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মোৎসব উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে কাঁঠালপাড়ায় যাচ্ছিলুম। ঠিক কোন্ সালে মনে নেই, তবে একত্রিশ-বত্রিশ বৎসর আগের কথা। শিয়ালদহ স্টেশনে ক্ষীরোদপ্রসাদও আমাদের কামরায় এসে উঠলেন এবং সকলের সঙ্গে একেবারে ঘরের লোকের মত গল্প জুড়ে দিলেন। খানিকক্ষণ পরে বুঝলুম, বয়সে তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর স্বভাব এখনো আছে বালকের মতই তাজা ও অকপট। প্রসঙ্গক্রমে আমি পূরাতন “জন্মভূমি”তে প্রকাশিত তাঁর রচিত একটি কবিতার কথা উল্লেখ করলুম।

 তিনি শিশুর মত উৎফুল্ল হয়ে উঠে বললেন, ‘আপনি পড়েছেন? আপনি পড়েছেন? হ্যাঁ, সেটি আমার খুব ভালো কবিতা, প্রেরণা না পেলে তেমন কবিতা কেউ লিখতে পারে না!’ তারপরেই তিনি সোজা হয়ে ব’সে, উচ্চকণ্ঠে ভাবভঙ্গীর সঙ্গে হাত নেড়ে গড় গড় ক’রে সেই তিন-চার যুগ আগেকার লেখা সমগ্র কবিতাটি আবৃত্তি ক’রে গেলেন। অবাক্ হয়ে ভাবতে লাগলুম, এত রাশি রাশি, ভারি ভারি নাটকের চাপেও এত বৎসর পরে একটিমাত্র স্বরচিত কবিতা তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে লুপ্ত হয়ে যায় নি! নিশ্চয়ই নিজের রচনার উপরে তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা!

 আর একদিনও পেলুম বালকতার পরিচয়। ষ্টার থিয়েটারে তখনও “অযোধ্যার বেগম” খোলা হয়নি এবং শিশিরকুমারও দেখা দেন নি সাধারণ রঙ্গালয়ে। স্বর্গীয় বন্ধু অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব’সে ব’সে আলাপ করছি, এমন সময়ে একখানি পাণ্ডুলিপি হাতে ক’রে ক্ষীরোদপ্রসাদের আবির্ভাব। খানিকক্ষণ কথাবার্তার পরেই তিনি বললেন, ‘এইবারে আমার নাটক প’ড়ে শোনাব।’

 অপরেশচন্দ্র বললেন, “পড়ুন।”

 কিন্তু নাটকপাঠের কোন চেষ্টাই দেখা গেল না। কিছুক্ষণ চুপ ক’রে ব’সে থেকে ক্ষীরোদপ্রসাদ আবার বললেন, ‘এইবার আমার নাটক প’ড়ে শোনাব।’

 অপরেশচন্দ্র নিরুত্তর। আবার কিছুক্ষণ নীরব থেকে ক্ষীরোদপ্রসাদ ঐ কথারই পুনরাবৃত্তি ক’রে আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন— তাঁর দুই চক্ষে অস্বাচ্ছন্দ্য। তখন ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলুম। আমিও একজন লেখক, আমার সামনে তিনি তাঁর নাটক পড়তে নারাজ—Plagiarism বা রচনাচৌর্যের ভয়ে! তাড়াতাড়ি উঠে পড়লুম, অপরেশচন্দ্র মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলেন। রঙ্গালয় জায়গা ভালো নয়। এখানে কারুর উপরে কারুর বিশ্বাস নেই।

 শিশিরকুমার যখন ম্যাডানদের দল ত্যাগ করেছেন, তখন স্বর্গীয় সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের “মুক্তার মুক্তি” নামে একখানি চমৎকার নাটিকা ওখানে অভিনীত হয়। তারপর থেকে কর্ণওয়ালিশ থিয়েটারে কিছুদিন ধ’রে আমাদের দৈনিক আসর বসত। অনেক সাহিত্যিক ও শিল্পী বন্ধু আসতেন। ক্ষীরোদপ্রসাদও প্রায় আসা-যাওয়া করতেন, কারণ তিনি ছিলেন ম্যাডানদের বৈতনিক নাট্যকার। মুখে তাঁর সর্বদাই হাসিখুসি। মাঝে মাঝে থিয়েটারওয়ালাদের উপরে চ’টে দপ্ ক’রে জ্ব’লে উঠতেন বটে, কিন্তু একটু পরেই আবার ঠাণ্ডা জল! বজ্র আর বৃষ্টি। নাটক নিয়েও অনেক কথা বলতেন, বেশীর ভাগ নিজের নাটকেরই প্রসঙ্গ। সর্বদাই মশগুল হয়ে থাকতেন যেন স্বকীয় কল্পনালোকে।

 একদিন স্বর্গীয় কবিবর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আমার হাতে ভিক্টর হিউগোর একখানি নাটক দিয়ে বললেন, ‘প’ড়ে দেখবেন। ভালো লাগে তো বাংলায় তর্জমা করবেন।’

 নাটকখানি ভালো লাগল। তাকে অবলম্বন ক’রে বাংলায় একখানি নাটক রচনা ক’রে ফেললুম। কোন রঙ্গালয়ের মুখ তাকিয়ে নয়, খেলাচ্ছলে মনের খেয়ালে। রচনাটি বন্ধুমহলে পাঠ করলুম। সকলে সুখ্যাতি করলেন।

 মণিলালের মুখে সেই নাটকের কথা শুনে ম্যাডানদের কর্ণধার (পরে “কালী ফিল্মসে”র মালিক) শ্রীপ্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলেন। দুই-চারদিন পরেই শুনলুম, নাটকখানি কর্ণওয়ালিশ থিয়েটারে অভিনয়ের জন্যে মনোনীত হয়েছে।

 ভূমিকালিপি বিলি হয়ে গেল। মহলা আরম্ভ হয় হয়, এমন সময়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ এসে হাজির। অত্যন্ত বিচলিত ভাব, সকাতর মুখ। মণিলালকে ডেকে তফাতে নিয়ে গিয়ে উত্তেজিত ভাবে কি সব ব’লে আবার চ’লে গেলেন দ্রুতপদে।

 মণিলাল আমার কাছে এসে হাসতে হাসতে বললেন, ‘হেমেন্দ্র, ক্ষীরোদবাবুকে না জানিয়ে তোমার নাটক নেওয়া হয়েছে বলে উনি অভিমান করেছেন। তুমি কাল ওঁর বাড়ীতে গিয়ে নাটকখানি শুনিয়ে এস, তাহ’লেই উনি ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন।’

 মণিলালের কথামতই কাজ করলুম। আমাকে দেখেই ক্ষীরোদপ্রসাদের মুখ হাস্যোজ্জ্বল হ’য়ে উঠল। সাদরে নীচের একটি ছোট ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে খুব মন দিয়ে নাটকখানি শ্রবণ ক’রে দু-একটি জায়গা একটু বদলে দিতে বললেন। আমিও রাজি হলুম।

 তারপর তিনি করুণ স্বরে বললেন, ‘হেমেন্দ্রবাবু, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে।’

 সবিস্ময়ে বললুম, ‘ষড়যন্ত্র! কিসের ষড়যন্ত্র?’

 —‘ম্যাডানদের সাঙ্গোপাঙ্গরা আমাকে তাড়াতে চায়। তাই ওরা আপনার নাটক নিয়েছে।’

 —‘আপনার সঙ্গে আমার তুলনা? আমি তো নাট্যকারই নই!’

 —‘না হেমেন্দ্রবাবু, ওরা আমার মত বুড়ো নাট্যকার চায় না। ওরা চায় আধুনিক নাট্যকার। এ সব হচ্ছে ষড়যন্ত্র।’

 তাঁর কাতর মুখ দেখে মায়া হ’ল আমার মনে। বললুম, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি কোন ষড়যন্ত্রেই যোগ দেব না। নাট্যকার হবার ইচ্ছা আমার একটুও নেই।’

 আমার নাটক কর্ণওয়ালিশ থিয়েটারে অভিনীত হয় নি। তারপর শিশিরকুমার সেখানি গ্রহণ করেছিলেন। তারপর গুরুদাস-লাইব্রেরীর অন্যতম স্বত্বাধিকারী শ্রীহরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে শিশিরকুমারের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে নিয়ে সেখানি আমি তাঁরই হাতে সমর্পণ করি, আর্ট থিয়েটারের জন্যে। সে পাণ্ডুলিপি আজ পর্যন্ত আমার হাতে আর ফিরে আসে নি। বোধ করি নাটকখানি রচনা করেছিলুম বিশেষ কোন অশুভ লগ্নে। সকলেরই ভালো লেগেছে, অথচ কারুরই কাজে লাগে নি।