সাত

 আপনি কি শিস্ দেওয়া পছন্দ করেন? প্রশ্নটি এতই তুচ্ছ যে অনেকেই হয়তো উত্তর দেওয়াও আবশ্যক মনে করবেন না। অনেকে হয়তো স্পষ্ট ভাষায় বলবেন— ‘না, নিশ্চয়ই করি না। ওটা হচ্ছে পাড়ার বখাটে ছোঁড়াদের নিজস্ব।’ আবার অনেকে হয়তো মুখে কিছুই না ব’লে মনে মনে বলবেন— ‘তা শিস্ দেওয়াটা খুব উল্লেখযোগ্য কাজ না হলেও মানুষের উঠতি বয়সে ওটা নিয়ে, খানিকটা সময় মন্দ কাটে না বটে!’ এবং এটা আমরা সকলেই জানি, বহুক্ষেত্রেই শিস্ দিলে শিষ্টতার পরিচয় দেওয়া হয় না। একটি দৃষ্টান্ত এই, গুরুজনের সামনে ব’সে শিস্ দিলে তাঁদের দ্বিতীয় রিপু প্রবল হয়ে উঠতে পারে। সময়ে সময়ে শিস্ হচ্ছে বিপদজনক। আদালতে গিয়ে শিস্ দিলে আপনার হবে জরিমানা।

 কিন্তু শিস্ যে মর্যাদাকর হ’তে পারে, এটা আপনারা বিশ্বাস করেন কি? খালি মর্যাদাকর নয়, সাধনায় অবহিত হ’লে শিস্‌কেও আর্টের স্তরে উন্নীত করতে পারা যায়। আমেরিকায় থাকেন এক ভদ্রলোক, তাঁর নাম ফ্রেড ক্রোলি। তিনি অন্ধ। শিস্ দেওয়ার আর্টে তিনি এমনি পরিপক্ক যে, সর্বত্রই তাঁর অসামান্য খাতির। রেডিয়ো, টেলি-ভিসন ও গ্রামোফোন রেকর্ডের সাহায্যে মাত্র এই শিস্‌কে অবলম্বন ক’রেই তিনি হয়েছেন বিপুল বিত্তের মালিক। আশ্চর্য তাঁর জনপ্রিয়তা। কেবল তাঁর শিস্ শোনবার জন্যেই অসংখ্য লোক তাঁকে বায়না দেয়।

 প্যাডেরিউস্কির নাম আপনাদের জানা থাকতে পারে। তিনি অবশ্য শিস্-দেনেওয়ালা নন, উচ্চতর শ্রেণীর শিল্পী। পিয়ানো বাজিয়ে তিনি কেবল য়ুরোপ-আমেরিকায় দিগ্বিজয় করেন নি, অমরত্ব অর্জন করেছেন। সঙ্গীতবিদ্‌রূপে অতিশয় জনপ্রিয় হ’তে পেরেছিলেন ব’লেই প্রথম মহাযুদ্ধের পর তিনি পোল্যাণ্ডের প্রধান মন্ত্রীর পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অর্থের দিক দিয়েও তাঁকে ধনকুবের বলা চলত।

 ঐ দুটি লোকের নাম করলুম কেন, এই সেই কথাই বলি। পিয়ানো হচ্ছে পাশ্চাত্য দেশের একটি বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র। সুতরাং পিয়ানোর সুপটু বাদক যে যশস্বী হবেন, এজন্যে বিস্মিত হবার কারণ নেই; কিন্তু শিস্ তো অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার। তাকে আর্ট ব’লে মানা দূরের কথা, আমরা তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না, তবু ওর মধ্যেও কেউ কেরামতি দেখাতে পারলে পাশ্চাত্য রসিকদের গুণগ্রাহিতার ফলে তিনি রীতিমত বিত্তশালী হয়ে উঠতে পারেন। এক্ষেত্রে এইটেই হচ্ছে দ্রষ্টব্য।

 ক্যারুসো, শালিয়াপিন, মেল্‌বা ও প্যাটি প্রভৃতি ওদেশের গায়ক-গায়িকারা যত লক্ষ টাকা রোজগার করেছেন, তা শুনলে আমাদের রাজা-মহারাজাদেরও মাথা ঘুরে যাবে। কিন্তু ওঁদের কথা ছেড়ে দি, কারণ ওরা তো হচ্ছেন বিশ্বের বাজারে বড় বড় রুইকাত্‌লা। আমেরিকায় মেরিয়ান অ্যাণ্ডার্সন নামে একটি মেয়ে আছেন। তাও শ্বেতাঙ্গদের নয়, কাফ্রিদের মেয়ে— যারা হচ্ছে ইয়াঙ্কি মুল্লুকের হরিজন। মেরিয়ানের গানের গলা অসাধারণ, তবু শ্বেতাঙ্গদের অনেকেই তাকে দমিয়ে রাখবার চেষ্টা করে। একবার ঘোষণা করা হ’ল, ওয়াশিংটন সহরে ‘ইষ্টারে’র দিন মেরিয়ানের গানের আসর বসবে। কিন্তু কোথায় বসবে আসর, কোন রঙ্গালয়ই মেরিয়ানকে ঠাঁই দিতে রাজি হ’ল না। তার ম্যানেজার তখন বাধ্য হয়ে আসর বসালেন মুক্ত আকাশের তলায়। নির্দিষ্ট তারিখে মেরিয়ানের গান শুনতে এল পঁচাত্তর হাজার শ্রোতা এবং তারা প্রত্যেকেই এসেছিল টিকিট ক্রয় ক’রে।

 ও-দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এদেশের কি দুরবস্থাই চোখে পড়ে! সাহিত্যিক ও চিত্রকর প্রভৃতি শ্রেণীর দেশীয় শিল্পীদের তো কায়ক্লেশে ভাত-কাপড় জোগাড় করতে করতেই প্রাণান্ত-পরিচ্ছেদ হয়ে ওঠে। সঙ্গীতের আবেদন অধিকতর সার্বজনীন বটে, কিন্তু কয়জন গাইয়ে বা বাজিয়ে এখানে জীবনব্যাপী সাধনার পরও যোগ্য পুরস্কার লাভ করেন? বিশেষ বিশেষ কারণে কিংবা গুটিকয় ধনী গুণগ্রাহীর পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকজন ভাগ্যবান দেশীয় সঙ্গীতবিদ্‌কে উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করতে হয় না বটে, কিন্তু তাঁদের আঙুলের ডগায় গুণে ফেলা যায়। সংপ্রতি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক ওস্তাদ ফৈয়জ খাঁ পরলোকে গমন করেছেন। শেষ জীবনে তাঁকেও রীতিমত অর্থকৃচ্ছ্রতা ভোগ করতে হয়েছিল। এদেশে শিস্ দিয়ে ধনী হওয়া তো স্বপ্নাতীত ব্যাপার, প্রথম শ্রেণীর তুলনাহীন সঙ্গীতবিদ্‌কেও এখানে কঠোর জীবন-সংগ্রামের ভিতর দিয়ে ইহকাল কাটিয়ে দিতে হয়। আজ এই রকম এক অদ্বিতীয় গুণীর সঙ্গেই আপনাদের পরিচয় সাধন ক’রে দেব।

 করমতুল্লা খাঁ ও ককুভ খাঁ দুই ভাই, ভারতের উত্তর-পশ্চিমে তাঁদের জন্ম। তাঁরা ঘরানা শিল্পী —অর্থাৎ সঙ্গীতকে অবলম্বন করেছিলেন বংশানুক্রমে।

 স্বদেশে নাম কিনে তাঁরা য়ুরোপেও গিয়েছিলেন। পারীসহরের প্রদর্শনীতে ভ্রাতৃদ্বয়ের গুণপনা য়ুরোপীয় রসিকদেরও যথেষ্ট আকৃষ্ট করেছিল।

 মসজীদবাড়ী (এখন হেমেন্দ্র সেন) স্ট্রীটের স্বর্গীয় বন্ধুবর নরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ধনবান ও চারুকলাগত প্রাণ। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বাংলার ইতিহাস” নামে সুবিখ্যাত প্রকাণ্ড গ্রন্থ তাঁরই অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর বাড়ীতে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় আমাদের একটি জমজমাট মজলিস বসত। সেখানে সহরের নামজাদা গাইয়ে-বাজিয়েদের আমন্ত্রণ করা তো হ’তই, তা ছাড়া আমন্ত্রিত হতেন ভারতের অন্যান্য প্রদেশের গুণী ব্যক্তিরাও। বলা বাহুল্য, তাঁরা উপযোগী দক্ষিণারও অভাব অনুভব করতেন না।

 ঐ আসরেই একদিন দেখতে পেলুম একটি চিত্তাকর্ষক মূর্তিকে। শ্যামবর্ণ, বিপুল ও সুদীর্ঘ দেহ। গম্ভীর আনন, প্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসা, ভাবব্যঞ্জক দৃষ্টি। দীর্ঘ কেশ, মুখে গোঁপদাড়ী। মাথায় টুপী, পরোনে পশ্চিমা মুসলমানের পোষাক। বয়স ষাটের কম নয়। সাজসজ্জা দস্তুরমত পরিপাটি ও সৌখীন। শুনলুম উনিই হচ্ছেন ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ। আসরের সবাই ডাকছেন খাঁ-সাহেব ব’লে।

 প্রথমে গায়কদের গান চলল, খাঁ-সাহেব বাক্যহীন মুখে একেবারে মূর্তির মত স্থির হয়ে ব’সে রইলেন। রাত সাড়ে নয়টা কি দশটার সময়ে গানের পালা সাঙ্গো হ’লো— সঙ্গে সঙ্গে খাঁসাহেব যেন জাগ্রত হয়ে ন’ড়ে চ’ড়ে ভালো ক’রে বসলেন। আবরণের ভিতর থেকে বেরুলো তাঁর সযত্নে রক্ষিত ও সজ্জিত শরদ। একে একে বাঁধা হ’ল তার। যন্ত্রটিকে বাগিয়ে ধ’রে তিনি সোজা হয়ে উঠে বসলেন, তাঁর মুখমণ্ডল শিল্পীসুলভ প্রতিভায় সমুজ্জ্বল। এতক্ষণ তাঁকে দেখাচ্ছিল সাধারণ মানুষের মত, বীণা হাতে তুলে নিতেই তিনি হয়ে উঠলেন ব্যক্তিত্বে অসাধারণ। তারপর শুরু হ’ল বাজনা।

 সেদিন বীণার যে ভাষা শুনলুম, তা বর্ণনা করবার শক্তি আমার নেই। কলমের রেখা মৌন, সঙ্গীত হচ্ছে ধ্বনিময়। কলম দিয়ে আঁকা যায় বড়-জোর শব্দছবি, কিন্তু বিভিন্ন ভাবে বিচিত্র বিভিন্ন তালে ছন্দোময়, বিভিন্ন রাগ-রাগিণীতে উচ্ছ্বসিত সেই মুখর বীণার জীবন্ত ভাষাকে যথাযথরূপে ফুটিয়ে তোলবার ক্ষমতা কোন লেখকের আছে ব’লে মানি না।

 প্রায় মধ্যরাত্রে বীণা হ’ল নীরব। এতক্ষণ সবাই দুনিয়াকে ভুলে বিচরণ করছিলুম সুরের স্বর্গে, হঠাৎ আবার ফিরে এলুম মাটির পৃথিবীতে। খাঁ-সাহেবের উপরে এতটা শ্রদ্ধা হ’ল যে কোনরকম মৌখিক প্রশস্তি জানাবার চেষ্টা করলুম না। শ্রেষ্ঠ আর্ট মানুষকে মুগ্ধ করে, মৌন করে, অভিভূত করে; প্রকৃত শিল্পীর পক্ষে তাইই হচ্ছে যথার্থ অভিনন্দন। ভালো অভিনয় দেখে, ভালো সঙ্গীত শুনে যারা হাততালি বা চেঁচিয়ে বাহবা দেয়, আমি তাদের অরসিক ব’লে মনে করি। হাততালি ও হট্টগোল ফুটবলখেলার মাঠেই শোভা পায়।

 তারপরও খাঁ-সাহেবের বাজনা আবার শুনেছি এবং আবার অভিভূত হয়েছি। তাঁর বীণা প্রতিদিনই বলত নূতন নূতন কাহিনী; প্রতিদিনই আমাদের জন্যে অপেক্ষা ক’রে থাকত নব নব বিস্ময়। খাঁ-সাহেবের পরে কলকাতায় আরো কত ডাকসাইটে শরদ-বাজিয়ে এলেন-গেলেন, তাঁদেরও অনেকের বাজনা শুনেছি। তাঁদেরও তাললয়দুরস্ত নিপুণ হাত, তাঁরাও সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য বিলি করতে কুণ্ঠিত নন, কিন্তু করমতুল্লা খাঁ-সাহেবের বীণায় যে কল্পনার বিলাস থাকত, যে মাধুর্যের আবেদন থাকত, যে অভাবিত কারুকুশলতা থাকত, আর কারুর কাছ থেকে তা লাভ করি নি আজ পর্যন্ত। উপভোগের দিক দিয়ে বলতে পারি, তিনি ছিলেন বীণকারদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ বীণকার।

 তাঁর বাসাতেও গিয়েছি অনেকবার আলাপ করতে। যদিও তিনি বাংলা জানতেন না, তাঁর ভাষা বুঝতেও আমার কিছু কিছু কষ্ট হ’ত, তবু তাঁর সংলাপ শুনে ও শিল্পীজনোচিত মনোবৃত্তি দেখে অতিশয় আনন্দ অনুভব করতুম। তিনি ছিলেন যেমন সদালাপী, তেমনি নিরহঙ্কার এবং বিনয়ী। শিল্পীরাও যে লেখাপড়ায় পণ্ডিত না হয়েও সংস্কৃতি ও আভিজাত্য প্রকাশ করতে পারেন—যার মূল্য কাঞ্চন-কৌলীন্যের চেয়ে অনেক বেশী, তাঁকে দেখলেই পাওয়া যেত তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অভ্যাগতদের তিনি আদর করতেও জানতেন। একবার বক্‌রীদের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, তিনি জোর করে আমাকে মাংস খাইয়ে দিলেন। সে মোগলাই মাংসের প্রত্যেক খণ্ডের আকার হাতের চেটোর মতন মস্ত এবং অসম্ভব রকম ঘৃতপক্ক ও মসলাজর্জরিত। তা খেতে খুব স্বাদু বটে, কিন্তু উদরপ্রদেশে অবতরণ ক’রে পরে কোন্ উৎপাত উৎপাদন করবে, সেই ভয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ীতে ফিরতে হয়েছিল।

 যদিও তিনি বীণকার, তবু ভারতীয় উচ্চসঙ্গীতের উপরে ছিল তাঁর অবাধ অধিকার। অথচ এ বিষয় নিয়ে অধিকাংশ প্রখ্যাত ওস্তাদের মত তাঁকে কোনদিন তুচ্ছ গর্বপ্রকাশ ক’রে হাস্যাস্পদ হ’তে দেখি নি। নামজাদা গায়করাও তাঁর কাছে তালিম গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হ’তেন না— যেমন অন্ধ-গায়ক শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দে।

 এমন একজন অতুলনীয় কলাবিদ্, কিন্তু এই জনবিপুল ও ধনবিপুল কলকাতা নগরে ব’সে তাঁকে ভোগ করতে হ’ত নিদারুণ অর্থ-কষ্ট। পাশ্চাত্য দেশে সামান্য শিস্ দিয়েও লোকে ধনবান হয়, কিন্তু এদেশে জন্মগ্রহণ ক’রে তাঁর মত কালোয়াত অন্ন-বস্ত্র সম্বন্ধেও নিশ্চিন্ত হ’তে পারেন নি!

 আর এক নতুন বৈঠকেও প্রায়ই তাঁর দেখা পেতুম। সেখানে বৈঠকধারী ছিলেন ‘লাইট-হেভি-ওয়েটে’ পৃথিবী-জয়ী কুস্তিগীর, বাংলার গৌরব শ্রীযতীন্দ্র গুহ বা গোবরবাবু। সেখানেও যখন-তখন বসত গান-বাজনার আসর। আগে জমীরুদ্দীন খাঁ-সাহেব (ইনিও মস্তবড় গুণী এবং এঁর কথাও পরে বলব) ও শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দে প্রভৃতির গান হ’ত, তারপর খাঁ-সাহেব বার করতেন তাঁর মোহনীয়া বীণা। একদিন গানের পর আরম্ভ হ’ল খাঁ-সাহেবের সাধের বীণার হাসিকান্নার অভিযান, সুর-তরঙ্গের মধ্যে ফুলের মত ভেসে ভেসে উঠতে লাগল নব-রসের সব রস। চিত্রার্পিতের মত ব’সে শুনতে শুনতে হঠাৎ দেখা গেল বেজে গিয়েছে রাত বারোটা। বাড়ীর কথা ভেবে খাঁ-সাহেবকে সেলাম ক’রে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লুম—সঙ্গে সঙ্গে আচম্বিতে খাঁ-সাহেব বাজনা থামিয়ে তাঁর সুদীর্ঘ বিপুলবপু নিয়ে সামনের দিকে হুম্‌ড়ি খেয়ে প’ড়ে একখানা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধ’রে ফেলে ব’লে উঠলেন, ‘কোথায় যাবেন বাবুজী? বাজনা শেষ না হ’লে এখান থেকে যেতে পারবেন না!’ বুঝলুম (বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় বুঝলুম), ফুলের যেমন গন্ধ বিলিয়ে সুখ, সত্যিকার কলাবিদ্‌ও তেমনি নিজের পরিপূর্ণতা না দেখিয়ে তৃপ্তি লাভ করেন না! বাধ্য হয়ে ব’সে পড়লুম, কারণ শিল্পীর মনে আঘাত দেওয়া পাপ। আবার বীণা তার বিচিত্র ভাষায় আলাপ করতে লাগল এবং সেই অপূর্ব আলাপ যখন বন্ধ হ’ল রাত কাবার হ'তে আর দেরি নেই তখন।

 সর্বশেষে খাঁ-সাহেবের একটি মজার গল্প শুনিয়ে রাখি—গল্পটি শুনেছিলুম আমি বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মুখে। তিনি তখন খাঁ-সাহেবের কাছে সেতার বাজনা শিখতে যেতেন।

 খাঁ-সাহেব এক নূতন ও ভৌতিক বাসায় উঠে এসেছেন। সে বাসায় আমিও মাঝে মাঝে গিয়েছি, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্য ক্রমে ভৌতিক কোন-কিছুর দ্বারাই আমি বিস্মিত বা চমকিত হই নি। ভূত সেখানে দেখা দেয় না বটে, কিন্তু অত্যন্ত অভদ্রের মত ইঁট-পাটকেল ছোঁড়ে। বাইরে মুক্তস্থানে নয়, বন্ধ ঘরের ভিতরে! কোন রকমেই এই অশান্তিকর উপদ্রব বন্ধ করতে না পেরে খাঁ-সাহেব শেষটা এক মোক্ষম উপায় অবলম্বন করলেন। কয়েক খণ্ড কাগজে পবিত্র কোরাণের বয়েৎ বা শ্লোক লিখে তিনি ঘরের সব জানালা বন্ধ ক’রে দেওয়ালের নানাস্থানে টাঙিয়ে দিয়ে প্রেমাঙ্কুর প্রমুখ সাকরেদদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই ঐ এক-একখানা কাগজের তলায় গিয়ে বোসো। ভূতের জারিজুরি আজ আর খাটবে না।’

 প্রেমাঙ্কুর বলেন, ‘খানিকক্ষণ যেতে-না-যেতেই আবার সেই ইষ্টকপাত সুরু হ’ল। কোথা থেকে কি হচ্ছে কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু বোঁ-বোঁ ক’রে এর-ওর-তার এপাশ-ওপাশ দিয়ে ছুটে আসতে লাগল ইঁট এবং পাটকেল।’

 অবশেষে খাঁ-সাহেব নাচার ভাবে হতাশ হয়ে দুঃখিত স্বরে অদৃশ্য প্রেতের উদ্দেশে বললেন, ‘এ কেয়া হায়? রূপেয়া ফেকো বাবা, রূপেয়া ফেকো!’

 বোধ করি সে অবিশ্বাসী কাফের ভূত, কোরাণের পবিত্র বয়েৎ মানে না, তাই ইঁট-পাটকেলের বদলে টাকা নিক্ষেপ করতে রাজি হ’ল না।

 অতএব সেই বিপদজনক বাসা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন খাঁ-সাহেব।