যাঁদের দেখেছি/তেরো
তেরো
পুণ্যকীর্তি বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র ব’লেই সুরেশচন্দ্র বিশ্রুতনামা হন নি। তাঁর যশের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে মাসিকপত্র “সাহিত্য”। তরুণ যৌবন থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি কায়মনোবাক্যে “সাহিত্যে”র সেবা ক’রে গিয়েছেন। পত্রিকা সম্পাদনে এমন অক্লান্ত আন্তরিকতা দুর্লভ। সুদিনে এবং দুর্দিনে “সাহিত্য”ই ছিল তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, প্রাণ।
সম্পাদনা-শক্তি ছিল তাঁর অতুলনীয়। বাংলা দেশে বিখ্যাত পত্রিকার অভাব নেই। কিন্তু সেগুলির অধিকাংশেরই কোন নিজস্ব সুর বা আদর্শ থাকে না। যথেচ্ছভাবে রচনা সংগ্রহ হয়। বড় বড় লেখকের সঙ্গে সঙ্গে থাকে অতি সাধারণ লেখকের কাজ। কোন বিশেষ আদর্শের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা নির্বাচন করা হয় না। নিজে কিছু রচনা না ক’রেও সম্পাদক যে বিশিষ্ট মনীষার পরিচয় দিতে পারেন, এ জ্ঞান অনেকেরই নেই।
এসব দিক দিয়ে আদর্শ সম্পাদক ছিলেন সুরেশচন্দ্র; এবং আদর্শ পত্রিকা ছিল “সাহিত্য”—ঠিক যেন নির্দিষ্ট সুরে বাঁধা বীণা। বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন ভঙ্গির ভিতর দিয়ে প্রকাশ পেত “সাহিত্যে”র নিজস্ব একটি মূল ভঙ্গি। নিপুণ উদ্যানপাল নানা জাতের ফুলের চারা দিয়ে বাগান রচনা করেন বটে, কিন্তু সেগুলির ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তাঁর নিজের নির্দিষ্ট ভঙ্গি ও পরিকল্পনাই। গোড়ার দিকে সুরেশচন্দ্র “সাহিত্যে”র জন্যে গুটিকয় গল্প লিখেছিলেন বটে, কিন্তু তার পর নিজে রচনা-কার্য প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন বললেই চলে, কেবল দুই-এক পাতার সংক্ষিপ্ত “মাসিক সাহিত্য সমালোচনা”র জন্যে লেখনীধারণ করতেন। তাঁর কারবার ছিল পরের ধন নিয়ে। কিন্তু তা পরের ধনে পোদ্দারি হয়ে উঠত না— পরস্বের মধ্যেই পাওয়া যেত তাঁর নিজস্বটুকু। তিনি যে সব রচনা নির্বাচন করতেন, সেগুলির ভিতরই থাকত তাঁর চিন্তাশীলতা ও সূক্ষ্ম রসবোধের পরিচয়।
“সাহিত্য” লেখকদের জন্যে পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করত না। তবু বিখ্যাত লেখকরা “সাহিত্যে” রচনা প্রকাশ করবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। “সাহিত্যে”র লেখক হওয়া তখন যেন একটা গৌরবের বিষয় ব’লে গণ্য হত। “সাহিত্য” ছিল যেন রচনার কষ্টিপাথর। দীনেন্দ্রকুমার রায় ও হরিসাধন মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি লেখকরা নিম্নশ্রেণীর বিলাতী মাসিকপত্রের গল্প থেকে স্বীকার না ক’রেই আখ্যানবস্তু গ্রহণ করতেন এবং “ভারতী” ও “প্রদীপ” প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদকরা অনায়াসেই সে সব লেখা ছাপিয়ে দিতেন। কিন্তু “সাহিত্যে” এ সব অনাচার হবার যো ছিল না। সুরেশচন্দ্র যখন দীনেন্দ্রকুমারের লেখা নিয়েছেন, তখন গ্রহণ করেছেন তাঁর মৌলিক রচনা পল্লীচিত্রই। অথচ অনুবাদে তাঁর অরুচি ছিল না। তিনি জানতেন, অনুবাদে সাহিত্যের পুষ্টি হয়। “সাহিত্যে”ও ইংরেজী থেকে অনূদিত রচনা প্রকাশিত হ’ত। কিন্তু সে সব শ্রেষ্ঠ রচনার অনুবাদ।
সুরেশচন্দ্রের ভাষা ছিল যেমন মিষ্ট, তেমনি শিষ্ট। যেমন তার স্বকীয় ভঙ্গি, তেমনি তার সাবলীল গতি। স্বচ্ছ, ঝরঝরে, প্রাঞ্জল। ছোট ছোট কথা দিয়ে জাহির করতেন বড় বড় ভাব। এই চমৎকার ভাষায় প্রথম জীবনে তিনি রচনা করেছিলেন গুটিকয় চমৎকার গল্প, পরে “সাজি” নামে সেগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। “ডালি” নামে আর একখানি যন্ত্রস্থ গল্পগ্রন্থের বিজ্ঞাপন দেখতুম “সাহিত্যে”র মলাটে, তবে যন্ত্রগর্ভ থেকে নির্গত হয়েছিল ব’লে মনে পড়ে না। কিন্তু গল্পরচনায় এমন দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কেন যে তিনি লেখনী ত্যাগ করলেন জানি না। কারণ হয়তো কুড়েমি। তা না হলে আজ তিনি কথাসাহিত্যেও স্থায়ী যশ অর্জন করতে পারতেন।
সুরেশচন্দ্রের রচনানির্বাচনশক্তি দেখেই বোঝা যায়, সমালোচকের সুক্ষ্মদৃষ্টি থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ সমালোচকের প্রধান যা গুণ, সেই নিরপেক্ষতার অভাব ছিল তাঁর যথেষ্ট। ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্যেও তিনি কর্তব্যভ্রষ্ট হয়েছেন বার বার। সুবিধা পেলেই তিনি তীব্র ভাষায় রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করতে ছাড়তেন না। মাঝে মাঝে প্রশংসাও যে করেন, নি, তা নয়— কিন্তু সে একটুখানি সুখ্যাতি আর অনেকখানি অখ্যাতি— প্রায় চারআনা আর বারআনা। কেবল রবীন্দ্রনাথকে নয়, রবীন্দ্রনাথের ভক্তদেরও। ছবির মর্ম তিনি কতটুকু বুঝতেন, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, কিন্তু প্রাচ্য চিত্রকলার বিরুদ্ধে তিনি দস্তুরমত ‘জেহাদ’ ঘোষণা করেছিলেন। কুযুক্তির সাহায্য নিয়ে অবনীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করেছেন যেখানে সেখানে।
অনেকে মনে করেন “মাসিক সাহিত্য সমালোচনা”য় তিনি অতুলনীয় বিচারশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। আমি তা মনে করি না। ঐ আলোচনায় পাঠকদের আকৃষ্ট করত প্রধানতঃ ভাষার ইন্দ্রজালে, কৌতুকরসে ও ব্যঙ্গবাণে। ঐ রকম ছোট ছোট টীকা-টিপ্পনীতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পটু। যখন সাপ্তাহিক “বসুমতী”র সম্পাদক ছিলেন, তখন তাঁর লেখা “দশের কথা” সকলেই আগ্রহভরে পাঠ করতেন। অনেক নূতন লেখক তাঁকে যমের মতন ভয় না ক’রে, পারেন নি। বিখ্যাত কবি রজনীকান্ত সেন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচনার ভয়ে নিজের রচনা প্রকাশ করতে রাজি হন নি। পরে সুরেশচন্দ্রের কাছ থেকে মৌখিক অভয় পেয়ে তিনি তাঁর রচনাগুলি পাঠকদের উপহার দেন।
রামধন মিত্রের লেনে একখানি ছোট দোতলা বাড়ীতে গিয়ে মাঝে মাঝে আমি সুরেশচন্দ্রের সঙ্গে বাক্যালাপ ক’রে আসতুম। আমি তখন সাহিত্যিক হবার জন্যে চেষ্টা করছি বটে, তবে নামডাক বিশেষ কিছুই হয় নি। বয়সও যথেষ্ট কাঁচা। তা সত্ত্বেও সুরেশচন্দ্র আমাকে অবহেলা করেন নি—যদিও বয়সে তিনি আমার চেয়ে আঠারো ঊনিশ বৎসর বড় ছিলেন। ধীরে ধীরে গম্ভীর স্বরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
প্রথম যেদিন তাঁকে দেখতে যাই, বাড়ীর ভিতরে ঢুকে রীতিমত অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। সুরেশচন্দ্রের বৈঠকখানার পাশের ঘরে চোখ পড়তেই দেখি, একটি আলনার তলায় সারি সারি সাজানো রয়েছে কয়েক জোড়া পাদুকা। মস্ত মস্ত জুতো— এত প্রকাণ্ড যে চোখ চমকে যায়! ভাবলুম, আমি লিলিপুটের মানুষ, এ কোন্ অতিকায় ব্যক্তির বাড়ীতে এসে পড়েছি!
তারপর স্বচক্ষে সুরেশচন্দ্রকে দেখলুম। তাঁকে অতিকায় বললে অত্যুক্তি হবে না। দস্তুরমত দশাসই চেহারা— যেমন দৈর্ঘ্যে, তেমনি প্রস্থে। গৌর বর্ণ, শ্মশ্রুগুম্ফহীন মুখ। সেই পুরুষোচিত দেহ এবং প্রতিভাব্যঞ্জক মুখ বৃহৎ জনতার ভিতরেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে, দর্শকের মনে জাগায় সম্ভ্রমের ভাব।
যখন তিনি “বসুমতী”র সম্পাদক তখন একদিন তাঁর বাড়ীতে গিয়ে দেখি, সুরেশচন্দ্র সেই সপ্তাহের কাগজ হাতে ক’রে পার্শ্বে উপবিষ্ট এক ভীত সাংবাদিককে অত্যন্ত ক্রুদ্ধস্বরে ভর্ৎসনা করছেন। সাংবাদিকের অপরাধ, ছোট্ট একটি খবরে ভাষার ভুল। অধিকাংশ সম্পাদকই এই তুচ্ছ ত্রুটি ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করতেন না, কিন্তু সুরেশচন্দ্রের প্রকৃতি ছিল না অধিকাংশ সম্পাদকের মত। খবরের কাগজের টুকরো খবরেও তিনি এতটুকু ভাষার ভুল সইতে পারতেন না। আজকের সাংবাদিকদের যদি তাঁর অধীনে কাজ করতে হ’ত, তাহ’লে অধিকাংশেরই জীবন হয়ে উঠত অতিশয় অতিষ্ঠ।
কেবল সুরেশচন্দ্রের বাড়ীতে নয়, কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল ও অক্ষয়কুমার বড়ালের ভবনেও মাঝে মাঝে তাঁর দেখা পেতুম। একদিন গিয়ে দেখি, তিনি, অক্ষয়কুমার ও মুনীন্দ্রনাথ ঘোষ ব’সে ব’সে গল্প করছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘হেমেন্দ্রবাবু, আপনাকে কাল মিনার্ভা থিয়েটারের সভায় দেখলুম না?’
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনাদের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলুম।’
—‘কেমন লাগল?’
—‘ভালো লাগল খালি আপনার আর হীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তৃতা। আর সব বক্তৃতাই অশ্রাব্য।’
সুরেশচন্দ্র হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাংলা দেশে রাম-শ্যাম সবাই বক্তা হ’তে চান। কিন্তু ঐ বক্তৃতাগুলি যদি গ্রামোফোনের রেকর্ডে তুলে রাম-শ্যামদের আবার শোনাতে পারা যায়, তাহলে হয়তো তাঁদের কিঞ্চিৎ আক্কেল হ’তে পারে।’
সুরেশচন্দ্র ছিলেন উচ্চশ্রেণীর বক্তা। তাঁর লেখনীর মত তাঁর মুখ দিয়েও নির্গত হ’ত সুমধুর, প্রসাদগুণপূর্ণ, শুদ্ধ ভাষা। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল গম্ভীর ও উদাত্ত, শ্রবণকে দিত তৃপ্তি।
এইবার একটি অপ্রীতিকর ঘটনার কথা বলি। একদিন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ীর ঘাস-জমির উপরে বৈঠক বসেছে। উপস্থিত আছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, সুরেশচন্দ্র, পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়, প্রসাদদাস গোস্বামী, অক্ষয়কুমার বড়াল, ললিত মিত্র, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, কবি দেবকুমার রায় চৌধুরী ও আমেরিকা থেকে সদ্যপ্রত্যাগত একজন ডাক্তার (হোমিওপ্যাথ)।
দেবকুমার রায় চৌধুরী দ্বিজেন্দ্রলালকে সম্বোধন ক’রে বললেন, ‘আপনি কাল রবিবাবুর যে কবিতাটির কথা বলেছিলেন, আমি আজ তা প’ড়ে দেখেছি। ঠিক বলেছেন, কবিতাটি শ্লীল নয়।’
আমি বললুম, ‘ও কবিতাটি পড়ে আমার মনে কিন্তু অশ্লীল ভাব জাগে না। তবে ওটি হাল্কা যৌবনের তরল ভাবের কবিতা বটে। আর সেই জন্যেই মোহিতলাল সেন সম্পাদিত রবীন্দ্রগ্রন্থাবলীর ‘যৌবন-স্বপ্ন’ বিভাগে কবিতাটিকে স্থান দেওয়া হয়েছে।’
সুরেশচন্দ্র মুখ টিপে হাসতে হাসতে ডাক্তারকে ডেকে বললেন, ‘ওহে, তোমাদের হোমিওপ্যাথিতে যৌবন-স্বপ্ন দোষের কি ওষুধ আছে না?’
ঔষধের নাম বললেন ডাক্তার। অনেকেই হেসে উঠলেন, কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের মুখ গম্ভীর। আমি লজ্জায় মাথা নত করলুম। আমার মত কনিষ্ঠের কাছেও সুরেশচন্দ্র নিজের বয়সের মর্যাদা রক্ষা করতে পারলেন না! রবীন্দ্রনাথের কাব্যে তথাকথিত অশ্লীলতা আবিষ্কার করবার জন্যে যাদের এত মাথাব্যথা, তাঁদের মুখ থেকে লোকে অন্তত শ্লীল ভাষাই প্রার্থনা করে। প্রসঙ্গক্রমে ব’লে রাখি দ্বিজেন্দ্রলালকে আমি কোনদিন আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করতে শুনি নি।
সুরেশচন্দ্র দীর্ঘজীবী হন নি—অর্ধশতাব্দীকালের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় তাঁর পৃথিবীর মেয়াদ। তিনি আরো বড় হ’তে পারতেন, কিন্তু আলস্য তাঁকে আরো বড় হ’তে দেয় নি।