যাঁদের দেখেছি/বারো
বারো
আগে আগে একটা ব্যাপার দেখে ভারি অবাক হতুম। সভাস্থলে হঠাৎ একজন বক্তাকে অনুরোধ করা হ’ল বক্তৃতা দেবার জন্যে। সেদিন তাঁর বক্তৃতা দেবার কথা নয়, তবু তিনি অপূর্বকল্পিত বিষয় নিয়ে অনায়াসেই সুদীর্ঘ একটি বক্তৃতা দিয়ে অনুরোধ রক্ষা করলেন। কিন্তু এখন আর এসব দেখে অবাক হই না। কারণ বক্তাদের গুপ্ত কথা জানতে পেরেছি।
বিপিনচন্দ্রের সমধিক খ্যাতি বক্তৃতার জন্যেই। অচিন্তিতপূর্ব বিষয় নিয়ে তিনি যখন-তখন মুখে মুখেই চমৎকার বক্তৃতা রচনা করতে পারতেন। রামগোপাল ঘোষ, কেশবচন্দ্র সেন ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি ইংরেজীতে বক্তৃতা দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন, কিন্তু বিপিনচন্দ্র ইংরেজী ও বাংলা দুই ভাষার বক্তৃতাতেই প্রকাশ করতেন সমান দক্ষতা।
স্বদেশী আন্দোলনের যুগে তাঁর বাংলা বক্তৃতাগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে উচ্চতর বস্তু বা যুক্তি বেশী থাকত না বটে, কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণেই থাকত অগ্নিমন্ত্রের উগ্রতা। তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর মূর্তিমান প্রতিবাদ, হিংস্র স্বাদেশিকতার পক্ষপাতী। একদিন বিডন গার্ডেনে বক্তৃতা দিতে উঠে ওজস্বিনী ভাষায় বললেন, ‘তোমরা কেউ ইংরেজের কাছে কিল খেয়ে কিল চুরি কোরো না, পথে-ঘাটে যদি আত্মসম্মান বজায় রাখতে চাও, তাহলে ঘুসির বদলে ঘুসি মারতে শেখো।’ আর একদিন স্পষ্ট বললেন, ‘সাদা পাঁঠা দেখলেই ধ’রে বলি দেবে।’ সাদা পাঁঠা, অর্থাৎ ইংরেজ।
এই শ্রেণীর কথায় যে বক্তার intellect বা মনীষার পরিচয় পাওয়া যেতনা, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হ’ত সম্পূর্ণভাবেই, কারণ তিনি চাইতেন কেবল জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে এবং তাঁর এই সব গরম গরম বুলি জনতার মধ্যে যে উত্তেজনা ও উন্মাদনা জাগ্রত করত, বর্ণনার দ্বারা আজকের দিনে তা বুঝানো যাবে না।
জনসাধারণের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছিলেন যথেষ্ট শ্রদ্ধা, সম্মান, পূজা। ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে তাঁর সমাদর আরো বেড়ে ওঠে। তখন তিনি ইংরেজী “বন্দে মাতরম্” পত্রিকার সম্পাদক। তাতে একটি প্রবন্ধ বেরুলো, গভর্মেণ্ট বললেন, সেটি রাজদ্রোহমূলক এবং অরবিন্দ তার লেখক। তখনি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হ’ল। সম্পাদক বিপিনচন্দ্রকে আদালতে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা হ’ল, ‘অরবিন্দ ঐ প্রবন্ধটি লিখেছেন কিনা?’ বিপিনচন্দ্র উত্তর দিতে অস্বীকার করলেন। তিনি আদালতের অপমান করেছেন এই অজুহাতে তাঁর প্রতি ছয়মাস কারাবাসের হুকুম হ’ল।
মুক্তিলাভের পর তাঁর জেল থেকে প্রত্যাগমনের পথগুলি হয়ে উঠল একেবারে জনাকীর্ণ। হাজার হাজার লোকের মুখে গগনভেদী জয়ধ্বনি। কাতারে কাতারে লোক চারিদিক থেকে বিপুল আগ্রহে ছুটে আসতে লাগল একটিবার তাঁকে চোখে দেখবার জন্যে। রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ। পথে গাড়ী চলছে একখানি মাত্র, যার উপরে আছেন বিপিনচন্দ্র। তাঁকে দেখলুম খোলা গাড়ীর উপরে কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়িয়ে সহাস্যমুখে তিনি গ্রহণ করছেন বিপুল জনতার অভিনন্দন। ফিরে এলেন তিনি বিজয়ী বীরের মত।
কিন্তু কেবল জনতা-ক্ষ্যাপানো তপ্ত বক্তৃতা নয়, বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশ্রেণীর বক্তৃতাতেও তিনি নিজের চিন্তাশীলতার প্রকৃষ্ট পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন এবং ভালো বক্তা মানেই ভালো লেখক। যে কোন লেখক বক্তা হ’তে পারেন না, কিন্তু যে কোন বক্তা লেখক হ’তে পারেন। বিখ্যাত বক্তারা প্রস্তুত হবার সময় পেলে বক্তব্য বিষয় নিয়ে আগে নিবন্ধ রচনা করেন। কেশবচন্দ্র সেন ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি ভালো লেখক ছিলেন। বিপিনচন্দ্রও তাই। তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। বহু দৈনিক ও মাসিক পত্রিকার সম্পাদকরূপে নিয়মিতভাবে লেখনী চালনা করেছেন এবং বাংলাতেও অসংখ্য সুচিন্তিত প্রবন্ধ লিখেছেন, সেগুলি আমাদের মাতৃভাষার সমুজ্জ্বল অলঙ্কার। দুঃখের বিষয়, সেগুলি অধুনালুপ্ত সাময়িক পত্রিকার অন্তরালেই আত্মগোপন ক’রে আছে। প্রকাশকরা সেগুলির দিকে কৃপাদৃষ্টিপাত করবার জন্যে আগ্রহ দেখান না, নাটক-নভেল নিয়েই তাঁদের হাত জোড়া। নাটক-নভেলও সাহিত্যের সম্পত্তি বটে, কিন্তু প্রবন্ধ-পুস্তকের দৈন্য কোন সাহিত্যকেই উচিতমত সমৃদ্ধ করতে পারে না।
তিনি কেবল চিন্তাশীল নন, রীতিমত পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু দলাদলির আবর্তে প’ড়ে মাঝে মাঝে ঘুলিয়ে যেত তাঁর মনীষা। অন্যান্য অনেকের মত তিনিও বহু-প্রশংসিত ও বহুনিন্দিত রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ ক’রে যারপরনাই অবিচার করেছেন। কতকগুলো কষ্টকল্পিত ও মূল্যহীন যুক্তির সাহায্যে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্য গল্প, উপন্যাস, ও প্রবন্ধাবলীকে নস্যাৎ ক’রে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। একবার নয়, দুইবার নয়, বার বার। রবীন্দ্র-রচনার পাঠক আজ পৃথিবীব্যাপী, কিন্তু তাঁর সে-সব রচনার পাঠক নেই আজ একজনও। বৃথাই তিনি এঁকে গেলেন জলের আল্পনা।
শেষের দিকে তিনি রাজনীতির চেয়ে সাহিত্যের চর্চাই করতেন বেশী। চিত্তরঞ্জন দাশের (তখনও তিনি ‘দেশবন্ধু’ উপাধিলাভ করেন নি) পৃষ্ঠপোষকতায় যখন মাসিকপত্র “নারায়ণ” প্রকাশিত হয়, বিপিনচন্দ্রই তার প্রধান ভার গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রপ্রভাবের মধ্যে থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তখন “সবুজপত্র”, তার প্রতিযোগী হয়ে বেরুতে লাগল “নারায়ণ”। তার একাধিক লেখক বাষ্পাচ্ছন্ন ঝাপসা চোখে দিকবিদিক হাতড়ে ব্যাকুল হয়ে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন কোথায় আছে বাংলার প্রাণ? কোথায় যে আছে তা স্পষ্ট ক’রে বোঝা গেল না বটে, কিন্তু থেকে থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল রবীন্দ্রনাথকে ও রবীন্দ্রপন্থিগণকে আক্রমণের চেষ্টা।
প্রথম যখন বিপিনচন্দ্রের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পাই, আমি তখন “সঙ্কল্প” নামে স্বল্পজীবী বৃহৎ মাসিকপত্রে সহকারী সম্পাদকের কাজ করি। সুকিয়া (এখন কৈলাস বোস) স্ট্রীটে লক্ষ্মী প্রিণ্টিং ওয়ার্কস নামে একটি বড় ছাপাখানা ছিল, “সঙ্কল্প” মুদ্রিত হ’ত সেইখানেই। বিপিনচন্দ্রের সম্পাদনায় তখন একখানি ইংরেজী মাসিকপত্র (বোধহয় নাম তার “হিন্দু রিভিউ” প্রকাশিত ও মুদ্রিত হ’ত ঐ মুদ্রাযন্ত্রেই। আমাকেও প্রায় ছাপাখানায় যেতে হ’ত, বিপিনচন্দ্রেরও না গিয়ে উপায় ছিল না। সুতরাং তাঁর সঙ্গে আলাপ জমাতে বিলম্ব হ’ল না।
শ্যামবর্ণ, মাঝারি আকারের বেশ ফিটফাট মানুষটি—সিল্কের চাদর, সিল্কের পাঞ্জাবী, সিল্কের কাপড়, বয়স হ’লেও সৌখিনতার অভাব নেই। দাড়ী-গোঁফ কামানো, চোখে চশমা। মুখশ্রী সুন্দর না হলেও প্রতিভাব্যঞ্জক, সহজেই দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। একদিন দেখলুম তাঁর সামনের টেবিলের উপরে রয়েছে দুইখানি হাফটোন ছবির ব্লক। ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখলুম, অভিনেত্রী তারাসুন্দরীর অভিনয়ের ছবি। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ও ব্লক আপনার টেবিলে কেন?’
তিনি বললেন, ‘ইংরেজীতে তারাসুন্দরীর অভিনয় নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছি, তারই ছবি।’
বিপিনচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্ম এবং তখনকার দিনে অধিকাংশ ব্রাহ্মই ছিলেন বাংলা রঙ্গালয়ের বিরোধী। কেবল ব্রাহ্মই বা বলি কেন, কোন হিন্দু সম্পাদকও তখন পর্যন্ত সাহিত্য সম্পর্কীয় মাসিক পত্রিকায় নট-নটীর ছবি প্রকাশ করেন নি। সুতরাং বেশ বিস্মিত স্বরেই বললুম, ‘আপনার কাগজে ঐ ছবি ছাপা হবে, নটীর অভিনয় সমালোচনা বেরুবে!’
তিনি মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাতে দোষটা কিসের? নাট্যসাধনা একটা বড় ব্যাপার, তারাসুন্দরী একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী, আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি।’
এমনি ছিল তাঁর সংস্কারমুক্ত মন। অথচ এমন নির্মুক্ত মনও সময়ে সময়ে বদ্ধ হয়ে পড়ত, তারও পরিচয় পরে দেব।
একদিন আমার বন্ধুদের মধ্যে তর্ক বাধল, “প্লে-রাইট” বড় না “ড্রামাটিষ্ট” বড়? এসম্বন্ধে এখনো এদেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির সন্দেহের অভাব নেই। এই সেদিনই শ্রীশিশিরকুমার ভাদুড়ী গিরিশচন্দ্রকে “প্লে-রাইট” বলেছিলেন ব’লে গিরিশচন্দ্রের অপমান করা হয়েছে ভেবে জনৈক ভদ্রলোক প্রভূত উষ্মা প্রকাশ না ক’রে ক্ষান্ত হ’তে পারেন নি এবং তিনি এম-এ ডিগ্রীধারী।
একদিন বিপিনচন্দ্রের কাছে ঐ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলুম। তিনি বললেন, ‘ “প্লে-রাইট” আর “ড্রামাটিষ্ট”, ওঁরা কেউ কারুর চেয়ে ছোট বা বড় নন। তফাৎ খালি এই, “প্লে-রাইট” একটি বিশেষরঙ্গালয়ের সুবিধা-অসুবিধা দেখে, নট-নটীদের প্রকৃতি বুঝে নাটক রচনা করেন, আর “ড্রামাটিষ্ট” হচ্ছেন নিরঙ্কুশ, তিনি কোন— দিকেই ভ্রুক্ষেপ না ক’রে স্বাধীন ভাবেই লেখনীচালনা করতে পারেন। তবে এটা ঠিক যে, “ড্রামাটিষ্টে”র চেয়ে “প্লে-রাইটে”র কর্তব্য কঠিনতর।’
আমি বললুম, ‘তা’হলে সেক্সপিয়র একজন “প্লে-রাইট”?’
তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়।’
আমিও তাই জানতুম। বিপিনচন্দ্রের মত বিশেষজ্ঞের সমর্থন পেয়ে আমার মত সুদৃঢ় হয়ে উঠল।
তার কিছুকাল পরে “সঙ্কল্পে”র অকালমৃত্যু ঘটল। আমি “মর্মবাণী”র সহকারী সম্পাদক। “নারায়ণ” আত্মপ্রকাশ করেছে। বিপিনচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ করতে “নারায়ণ” কার্যালয়ে যাই মাঝে মাঝে। একদিন তিনি আমার কাছে একটি ছোটগল্প চাইলেন। “কুসুম” নামে একটি গল্প লিখে তাঁর হাতে অর্পণ করলুম। পরদিন রচনাটি আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘এ শ্রেণীর গল্প “নারায়ণে” চলবেনা।'
গল্পটি “মর্মবাণী”র জন্যে ছাপাখানায় পাঠিয়ে দিলুম। প্রুফ এল। অন্যতম সম্পাদক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তা পাঠ ক’রে বললেন, ‘এরকম গল্প “মর্মবাণী”তে বেরুতেই পারে না।’
সেখান থেকেও বিতাড়িত হয়ে “কুসুম” অবশেষে আশ্রয় পেলে “ভারতী”র অঙ্কে। সম্পাদক স্বর্গীয় মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় গল্পটি পাঠ ক’রে খুব প্রশংসাই করলেন। কিন্তু গল্পটির গল্প এখনো শেষ হয়নি।
তারপর কেটে গেল এক যুগ। জার্মানীর বার্লিন সহর থেকে ডক্টর রাইনহার্ড ভাগনার নামে এক ভাষাতত্ত্ববিদ পত্র লিখে আমাকে জানালেন, তিনি আমার কয়েকটি গল্প জার্মান ভাষায় তর্জমা করবেন এবং সেজন্যে আমার সম্মতি চান। তাঁর দ্বারা নির্বাচিত গল্পগুলির মধ্যে “কুসুম” ও স্থান পেয়েছে দেখলুম। পত্রোত্তরে সম্মতি দিয়ে ভাগনার সাহেবকে আমি লিখলুম, ‘গল্পগুলি আমার কাঁচা বয়সের রচনা।’ উত্তরে তিনি লিখলেন, ‘Now I am glad to send you a copy of my work. You will find in it 5 of your stories, among them the two master-pieces “Siuli” and “Kusum.” Blessed be the “callow days” which produce works of such a high standard! “Kusum” is scarcely to be surpassed in its psychological development and the art of unuttered feelings, employed in this story, must be highly admired.’
আত্মপ্রচারের জন্যে এ উদ্ধৃতি নয়। কারণ তেইশ বৎসর আগে আমি এই চিঠি পেয়েছি, কিন্তু দুই-একজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া বাইরের আর কারুকেই তা দেখাই নি। আমি এখানে দেখাতে চাই, বিপিনচন্দ্র ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ যে গল্প প্রকাশযোগ্য বিবেচনা করেন নি, নিশ্চয়ই তা প্রকাশের অযোগ্য ছিল না। বিশেষতঃ বিপিনচন্দ্রের ছিল প্রখর বিচারশক্তি। তবু তিনি গল্পটি গ্রহণ করেননি কেন? এর উত্তর দেওয়া খুবই সহজ।
“কুসুম” গল্পের বস্তুটুকু মোটামুটি এই: গণিকা কুসুম বারান্দার উপর থেকে দেখতে পেলে, রাজপথে গাড়ী চাপা প’ড়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আহত লোকটিকে নিজের ঘরে আনিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে, ঔষধ দিয়ে, কয়েকদিন ধ’রে কন্যার মত সেবা ক’রে কুসুম তাঁকে সুস্থ ও সবল ক’রে তুল্লে। জ্ঞান লাভ ক’রে কুসুমের পরিচয় জেনেই ভদ্রলোক তেলে-বেগুনে জ্ব’লে উঠে বললেন, ‘কী, তুই গণিকা! আর আমি ব্রাহ্মণ হয়ে তোর হাতে জল খেয়েছি! পাপিষ্ঠা, দূর হ, দূর হ আমার সামনে থেকে!’ কুসুম কাঁদতে লাগল।
চিত্তরঞ্জন ব্রাহ্ম, বিপিনচন্দ্রও ব্রাহ্ম, কিন্তু তাঁহাদের “নারায়ণ” পত্রিকায় নতুন এক হিন্দুত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছিল। শেষ পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন প্রায় হিন্দু হয়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু বিপিনচন্দ্রের মন বরাবরই ছিল ব্রাহ্মভাবাপন্ন। তবু দলগত নীতি বা “পলিসি”র খাতিরে তিনি মনে যা ভাবতেন, সব সময়ে মুখে তা স্বীকার করতে পারতেন না। তাই যে বিপিনচন্দ্র একদিন গণিকা অভিনেত্রীর ছবি ছাপতে ও তাঁকে অভিনন্দন দিতে কুণ্ঠিত হন নি, তিনিই পরে গল্পের এক কল্পিত গণিকার মহত্বকে অকৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণের ছুঁতমার্গের উপরে স্থান দিতে রাজি হন নি। দলগত নীতির খাতির রাখতে গিয়ে পরম উদার বিপিনচন্দ্র মাঝে মাঝে অত্যন্ত অনুদার হয়ে উঠেছেন। তারই ফলে তাঁর যুক্তিহীন রবীন্দ্রবিদ্বেষ।