ষোলো

 কবিবর বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাছে যাঁরা শিষ্যত্ব স্বীকার করেছিলেন তাঁদের মধ্যে তিন জনের নাম হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার বড়ালনগেন্দ্রনাথ গুপ্ত

 নগেন্দ্রনাথ পরে ছোটগল্পলেখক, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিকরূপে সমধিক খ্যাতি লাভ ক’রে কবিতা লেখা ছেড়ে দেন বটে, কিন্তু পুরাতন “ভারতী” প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতাগুলি পড়লেই বেশ বোঝা যায়, কাব্যচর্চা না ছাড়লে কবিরূপেও তিনি নিজের পথ কেটে নিতে পারতেন।

 রবীন্দ্রনাথের প্রথম বয়সের কবিতাগুলির উপরে বিহারীলালের অল্পবিস্তর প্রভাব বেশ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাঁর বৃহত্তর ও অতুলনীয় প্রতিভা অল্পদিনের মধ্যেই বিহারীলালের প্রভাব থেকে সম্যক্‌রূপে মুক্ত হ’তে পেরেছিল।

 কিন্তু অক্ষয়কুমার তা পারেন নি। তাঁর শেষের দিকের রচনাতেও আংশিক ভাবে বিহারীলালের সুর, ছন্দ ও লিখনভঙ্গী প্রভৃতি আবিষ্কার করা অসম্ভব হবে না।

 প্রসঙ্গক্রমে ব’লে রাখি, পূর্বোক্ত তিন কবির আর একজন সতীর্থ ছিলেন, তিনি বিহারীলালের বড় ছেলে অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তী। তিনিও চমংকার কবিতা রচনা করতে পারতেন এবং তাঁর কয়েকটি “কবিতা “ভারতী”তে প্রকাশিতও হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফুটতে ফুটতেও ফুটলেন না। মস্তিষ্কের ব্যাধি তাঁর কাব্যানুশীলন ব্যর্থ ক’রে দিয়েছিল।

 অক্ষয়কুমারের জন্ম ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে ও মৃত্যু ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে। হেয়ার স্কুলের পাঠ শেষ করবার আগেই তিনি অফিসে কেরাণীগিরি করতে বাধ্য হন। পুরাতন “বঙ্গদর্শন” ও অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর রচিত কবিতা সাদরে গৃহীত হ’ত। “প্রদীপ”, “কনকাঞ্জলি”, “ভুল”, “রজনীর মৃত্যু”, “এষা” ও “শঙ্খ” নামে তাঁর কয়েকখানি কবিতাপুস্তক আছে। বাংলা দেশের অধিকাংশ বিখ্যাত কবিই গদ্য রচনার নমুনাও রেখে গিয়েছেন। কিন্তু অক্ষয়কুমার কোনদিনই গদ্যে হাত দেন নি।

 বিহারীলালের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে এড়াতে না পারলেও তাঁর যে নিজস্ব রচনাভঙ্গী, স্বকীয় কাব্য-বৈভব ও গভীর ভাবসম্পদ ছিল, একথা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। যে সঙ্গীত কানে শোনা যায় না, যে সঙ্গীত প্রাণে অনুভব করতে হয়, তাঁর কবিতার মধ্যে তারও অভাব ছিল না। তিনি জাতকবি। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নামের মহিমা ক্ষুণ্ণ হবে না। যদিও রবীন্দ্রনাথের মত জীবনকে তিনি সব দিক দিয়ে সমগ্রভাবে দেখতে পারেন নি এবং যদিও তাঁর শব্দসম্পদ ও ছন্দবৈচিত্র্য বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য ও আধুনিক যুগের উপযোগী নয়, তবু রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালের অধিকাংশ কবির চেয়ে তিনি উচ্চাসনের দাবি করতে পারেন।

 অক্ষয়কুমারের সব বই একসঙ্গে বাঁধিয়ে রাখলেও আকারে বৃহৎ হবে না। তাঁর সাহিত্য-শ্রম স্মরণীয় নয়। তিনি তাড়াতাড়ি বা খুব বেশী লিখতে পারতেন না। অনেক দিন অন্তর তাঁর এক একটি কবিতা জন্মলাভ করত। তিনি চিন্তা করতেন বেশী, কলম ধরতেন কম। তাঁকে জিজ্ঞাসা ক’রে জেনেছি, কখনো কখনো একটিমাত্র কবিতা রচনা করতে তাঁর কেটে গিয়েছে দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে বলেছেন, ‘একটা নতুন কবিতা ধরেছি, কিন্তু শেষ করতে পারছি না।’ তখন তাঁর মুখ দেখলে বোঝা যেত মনে মনে তিনি কষ্টভোগ করছেন। অনেক মাসিক পত্রিকার ছিনেজোঁক গোছের দুঁদে সম্পাদকও বারংবার তাঁকে আক্রমণ ক’রে তাঁর কাছ থেকে একটিও কবিতা আদায় করতে পারেন নি। তাগাদা বা চক্ষুলজ্জার খাতিরে কখনো তিনি লেখনী ধারণ করেছেন ব’লে মনে হয় না। কবিতা স্বয়মাগতা হ’লেই তাঁর প্রাণে জাগত রচনার জন্যে প্রেরণা। তাই ভারে নয়, ধারে কাটে তাঁর কবিতা। সেগুলির সংখ্যা বেশী নয় বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে নিম্নশ্রেণীর বস্তু নেই বললেও চলে।

 “অর্চনা” মাসিক পত্রিকার কার্যালয়ে প্রত্যহ আমাদের একটি সান্ধ্য বৈঠক বসত। সেইখানেই তাঁর প্রথম দেখা পাই, যদিও তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বাল্যকাল থেকেই। একহারা, ছিপছিপে দেহ, প্রায় গৌরবর্ণ, মুখশ্রী বিশেষ উল্লেখ্য বা তীক্ষ্ণধীজ্ঞাপক নয় বটে, কিন্তু মনে কোন বিরাগও জাগায় না। তবে কবিতা প’ড়ে কবির যে মূর্তি কল্পনা ক’রে নিয়েছিলুম, আসল মানুষটির সঙ্গে তার মিল হ’ল না। এই রকমটাই হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের মত কবি-চেহারা এদেশের কোন কবিই লাভ করেন নি। আমি যে সব বিখ্যাত মৃত কবিকে স্বচক্ষে দেখেছি— যেমন অক্ষয়কুমার, দেবেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তযতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রভৃতি—তাঁদের কারুর চেহারাই কবিজনোচিত নয়। তবে দ্বিজেন্দ্রলাল, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথনাথ রায়চৌধুরী সম্বন্ধে এমন কথা বলা চলে না।

 অক্ষয়কুমার বেশ সদালাপী ও মিশুক মানুষ ছিলেন। সাদাসিধে সাজ-পোষাক। প্রকৃতিটি নিরীহ। তাঁকে অহমিকা প্রকাশ করতে বা খুব জোর দিয়ে কোন কথা বলতে শুনি নি। প্রায়ই সন্ধ্যার মুখে তিনি বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়তেন, তারপর গিয়ে বসতেন বিভিন্ন সাহিত্য বৈঠকে। সাহিত্য-সম্পর্কীয় আলোচনায় যোগ দিতেন বটে, কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ, অমৃতলাল বসু, প্রমথ চৌধুরী বা শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের মত সংলাপে বিশেষ শক্তি বা সাহিত্যরসের পরিচয় দিতে পারতেন না। যখনই ওঁদের কাছ থেকে ফিরে এসেছি তখনই মনে হয়েছে, আজ কোন নূতন কথা শুনে বা শিখে এলুম। অক্ষয়কুমারের কাছে গিয়ে কোনদিন তা মনে হয় নি।

 “সাহিত্য” সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সুরেশচন্দ্র ছিলেন রীতিমত কটুভাষী সমালোচক। কিন্তু কোনদিন তিনি অক্ষয়কুমারের নাম নিয়ে কালির ছিটে ছড়ান নি। হয় তো তার অবসরও হয় নি, কারণ অক্ষয়কুমারের অধিকাংশ রচনা প্রকাশিত হ’ত “সাহিত্য” পত্রিকাতেই। সুরেশচন্দ্রকেও মাঝে মাঝে “সাহিত্য”-গোষ্ঠীভুক্ত লেখকদের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের বাড়ীতে এসে আলাপ জমিয়ে যেতে দেখেছি। তিনি অক্ষয়কুমারের নাম দিয়েছিলেন “বড়াল-কবি”।

 অক্ষয়কুমারের মুখে নতুন বাংলার গীতি-কাব্যগুরু বিহারীলালের কোন কোন গল্প শুনেছি। ভাবে-ভোলা সদানন্দ পুরুষ, সর্বদাই কাব্যরসে মসগুল হয়ে আছেন। নতুন নতুন গান বাঁধেন, সুর দিয়ে গাইতে গাইতে দুই হাতে তক্তাপোশ চাপড়াতে চাপড়াতে তাল দেন। কিন্তু কেউ বিয়ের কবিতা ফরমাস করলেই মহা-ক্ষাপ্পা, লাঠি নিয়ে পিছনে তাড়া করেন।

 কিন্তু অক্ষয়কুমারের একটি বিশেষ দুর্বলতা প্রায়ই লক্ষ্য করেছি। যদিও এ দুর্বলতা তিনি যথাসাধ্য গোপন করবার চেষ্টা করতেন,, কিন্তু গোপন করতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথের উপরে তিনি মনে মনে খুসি ছিলেন না। এর কারণ অনুমান করাও কঠিন নয়। তিনিও রবীন্দ্রনাথের সতীর্থ, একই গুরুর কাছে হাত মক্স করেছেন, অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কত পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন! সহশিল্পীর এই ঈর্ষা স্বাভাবিক বটে, কিন্তু এথেকে সাহিত্যক্ষেত্রে স্তূপীকৃত হয়ে ওঠে বহু আবর্জনাই। এই ঈর্ষার দ্বারা চালিত হয়েই দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ্যে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ। অক্ষয়কুমারের অতটা সাহস ছিল না। কিন্তু যে সব বৈঠকে ঘটা ক’রে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে ধূলো-কাদা ছোঁড়া হ’ত, তিনি সেই সব স্থানে হাজিরা দিতে ভালোবাসতেন। দ্বিজেন্দ্রলালের বৈঠকে আমি কত লোককে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কত অমূলক কথাই বলতে শুনেছি! কেউ বলতেন, তিনি সংস্কৃত না জেনেও জানবার ভান করেন, কেউ বলতেন, তিনি ইংরেজী লিখতে পারেন না।

 রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অক্ষয়কুমারকে এরকম মন্তব্য প্রকাশ করতে শুনি নি বটে, কিন্তু একাধিকবার বলতে শুনেছি: ‘দেখ, রবিবাবু যে ভালো ভালো কবিতা লিখেছেন তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি এত বেশী বাজে কবিতাও লিখেছেন সাহিত্যের মধ্যে সেগুলির স্থান হবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি নিজে রবীন্দ্রনাথের মত বাজে কবিতা লেখেন নি এবং সেইজন্যেই বেশী কবিতা লেখার পক্ষপাতী নন। বেশী লিখলেই বাজে লিখতে হয়।

 কিন্তু অক্ষয়কুমার কোনদিন বোধ হয় এ হিসাব ক’রে দেখেন নি যে, রবীন্দ্রনাথ এমন অসংখ্য শ্রেষ্ঠ কবিতা রচনা করেছেন, যার তুলনায় তাঁর নিজের জীবনব্যাপী সাহিত্যশ্রমের দান মুষ্টিমেয় ব’লেই গণ্য হ’তে পারে।

 অক্ষয়কুমারের মুখেই বঙ্কিম-যুগের একটি গল্প শুনেছি। কবি নবীনচন্দ্র সেনের সামনে কেউ রবীন্দ্রনাথকে বড় কবি বললে তিনি আঘাত পেতেন না। কিন্তু কেউ যদি হেমচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠতর কবি বলত, তা’হলে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন।

 ঠিক এই দুর্বলতা ছিল অক্ষয়কুমারেরও। রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠতর কবি বললে তাঁর মন হ’ত বিরস। কিন্তু যে আসরে সবাই দ্বিজেন্দ্রলালকে প্রশস্তি নিবেদন করতে ব্যস্ত, সেখানে তিনি প্রায়ই নির্বিকার চিত্তে উপস্থিত থাকতেন, রবীন্দ্রনাথের কুৎসা শ্রবণ করতেন। দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠতা বা অপকৃষ্টতা নিয়ে তিনি কিছুমাত্র মাথা ঘামাতেন না। বড় অদ্ভুত শিল্পীর ঈর্ষা!