সতেরো

 আগে সুধীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি, আগে তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ও হয় নি, আগে তাঁর নামের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

 বর্তমান যুগের পাঠকরা খুব সম্ভব “সাধনা” পত্রিকার সঙ্গে পরিচিত নন। কেউ কেউ বড় জোর তার নাম শুনে থাকতে পারেন। আকার ছিল তার সাধারণ কেতাবের মত। এখনকার অনেক পত্রিকার মত আকারে সে ‘মস্ত ডাগর’ না হলেও “সাধনা” হয়ে আছে বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে ‘ল্যাণ্ড-মার্ক’ বা ক্ষেত্রসীমাচিহ্নের মত— যেমন হয়ে আছে বঙ্কিমচন্দ্রের “বঙ্গদর্শন”। আধুনিক বঙ্গ-সাহিত্যগুরু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসাধনা যখন সিদ্ধির সীমায় গিয়ে পৌঁচেছে, সেই সময়েই “সাধনা”র আত্মপ্রকাশ। সুতরাং “সাধনা” নামটি হয়েছিল রীতিমত যুক্তিযুক্ত। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন তার প্রধান লেখক, মাসে মাসে সব্যসাচীর মত “সাধনা”কে তিনি সাজাতেন কবিতা দিয়ে, গল্প দিয়ে, প্রবন্ধ দিয়ে, সমালোচনা দিয়ে— এমনকি অনুবাদ দিয়েও। “সাধনা”র মধ্যে লিপিবদ্ধ আছে তাঁর তৎকালীন সাহিত্যশ্রমের বিচিত্র ইতিহাস। কিন্তু কেবলই কি রবীন্দ্রনাথ? ঠাকুরবাড়ীতে ছিলেন আর এক বিস্ময়কর সাহিত্যশিল্পী বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর— যাঁর প্রতিভাপদ্ম সম্যক্‌রূপে প্রস্ফুটিত হবার আগেই খ’সে পড়েছে ঝোড়ো বাতাসে। “সাধনা”তে তিনিও নিয়মিত লেখনীচালনা করতেন যেমন সঙ্গীতময় ও ছন্দসুন্দর ছিল তাঁর ভাষা, তেমনি অনন্যসাধারণ ছিল তাঁর বিষয়বস্তু—তাঁর বিভাগে বাংলাসাহিত্যে তিনি কেবল অতুলনীয় নয়, চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার উপরে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখনও তিনি শিল্পাচার্য হন নি— তুলি ও কলম নিয়ে খেয়ালের খেলা শুরু করেছেন মাত্র। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে তাঁর আঁকা ছবি “লিথোগ্রাফ” বা শিলাক্ষরে মুদ্রিত হয়ে “সাধনা”র পৃষ্ঠাকে করত অলঙ্কৃত।

 বাল্যকালে “সাধনা” আসত আমাদের বাড়ীতে। সেই “সাধনা”র উপরে দেখতুম সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। তখন জানতুম না সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোনদিন ঘনিষ্ঠ পরিচয় হবে। কিন্তু তখন থেকেই আমার কাছে তাঁর নামটি লাগত ভারি মিষ্টি। Presentiment?

 আরো বড় হয়ে সুধীন্দ্রনাথের দু-একটি রচনা পড়তুম। তারপর “সাহিত্য” পত্রিকায় দেখলুম মাথায় “ফেয্” টুপী পরা তাঁর একটি আবক্ষ প্রতিকৃতি। সুন্দর মৌখিক শ্রী—দেখলেই আকৃষ্ট হয় দৃষ্টি।

 এখনকার সাধারণ পাঠকরা বলেন্দ্রনাথকে ভুলেছেন, সুধীন্দ্রনাথকেও ভুলেছেন। য়ুরোপে জন্মালে বলেন্দ্রনাথ জনসাধারণের মধ্যেও অমর হয়ে থাকতেন, কারণ তিনি গল্পলেখক না হ’লেও তাঁর রচনাগুলি ছিল গল্পের মতই উপভোগ্য। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ নিজের দেশে এর মধ্যেই প্রায় অপরিচিত হয়ে উঠলেন কেন, এ রহস্য বুঝতে পারি না। প্রধানতঃ তিনি ছিলেন গল্পলেখকই এবং সত্যিকার উচ্চশ্রেণীর গল্পলেখক। তাঁর কোন কোন ছোট গল্প তখনকার সাহিত্যসমাজকে দস্তুরমত মাতিয়ে তুলেছিল— যেমন “কাসিমের মুর্গী”। তাঁর ভাষাও সেকেলে হয়ে পড়ে নি, কারণ তাঁর কলম দিয়ে বেরুতো না অলঙ্কৃত ও পল্লবিত ভাষা, তিনি ব্যবহার করতেন সহজ, সরল, চলতি ছোট ছোট শব্দ। তাঁর আখ্যানবস্তুও ছিল ঘরোয়া। অথচ বাজারে তাঁর কেতাবের কোন ক্রেতা দেখি না। তাঁর বইগুলিও বোধ করি ছাপা নেই।

 সুধীন্দ্রনাথ হচ্ছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র, রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা, কবি ও দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র। তিনি ওকালতিতে পাস করেছিলেন বটে, কিন্তু ওকালতির দিকে কোনদিনই আকৃষ্ট হন নি। আদালতও তাঁর মতন মানুষ চায় না। আদালতে তাঁর মতন মানুষ মানায় না। তাঁর বড় ছেলে শ্রীসৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম আজ সুপরিচিত।

 সুধীন্দ্রনাথ কেবল গল্প নয়, একখানি উপন্যাসও লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন, প্রবন্ধও লিখেছেন। প্রত্যেক কবিতায় পাওয়া যাবে তাঁর নিজস্ব ছাপ। এটিও ঠাকুরবাড়ীর একটি উল্লেখ্য বিশেষত্ব। সাহিত্য নিয়ে বা শিল্প নিয়ে আজ পর্যন্ত ওখান থেকে যাঁরা আত্মপ্রকাশ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের জন্যে কেটে নিয়েছেন নূতন নূতন পথ। ররীন্দ্রনাথের বৃহত্তর ও মহত্তর প্রতিভার প্রভাবে গোটা বঙ্গসাহিত্য আচ্ছন্ন হয়ে আছে, কিন্তু তাঁর পরিবারভুক্ত কোন শিল্পীই সে প্রভাবের দ্বারা অভিভূত হন নি।

 শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের সব লক্ষণ আছে সুধীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের অন্যতম যে গুণ সাহিত্যশ্রম, সেটা তাঁর মধ্যে ছিল না। ওজন করলে বেশী ভারি হবে না তাঁর গ্রন্থাবলী। কলম ধরবার উৎসাহ জাগত তাঁর কালে-ভদ্রে, কিন্তু নিয়মিতরূপে বাড়ী থেকে বেরিয়ে প’ড়ে প্রত্যহ এ-বৈঠকে ও-বৈঠকে গিয়ে ঘোরাঘুরি করবার উৎসাহ ছিল তাঁর যৎপরোনাস্তি। অথচ আসলে বৈঠকী লোক বলতে যা বুঝায়, তিনি সে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না। কারণ তিনি গম্ভীর না হ’লেও স্বল্পবাক ছিলেন। কথা শুনতে যত ভালোবাসতেন, কথা বলতে ততটা নয়।

 তিনি জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন নিশ্চিন্ত আলস্য-বিলাসের মধ্যে পরম আরামে।

 এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন অনেকটা বিলাতী কবি এডওয়ার্ড ফিযজেরাল্ডের মত। যে অসাধারণ শক্তিধর না থাকলে পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম আজ পৃথিবীবিখ্যাত হ’তে পারতেন না, চুয়াত্তর বৎসরব্যাপী সুদীর্ঘ জীবনের মধ্যেও তিনি একখানি ক্ষুদ্র অনুবাদপুস্তিকা ছাড়া আর কোন স্মরণীয় রচনা রেখে গেলেন না! কবিতা রচনার চেয়ে ভালো লাগত তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গ। তিনি ছিলেন থ্যাকারে ও টেনিসন প্রভৃতির সুহৃদ। ফুল, গান ও কাব্যরসের ভিতর দিয়েই কেটে গিয়েছে তাঁর সারাজীবন।

 সুধীন্দ্রনাথের সাহিত্যচর্চা ছিল স্বার্থহীন। পেটের ধান্ধায় কোনদিন তাঁকে কলম ধরতে হয় নি। দেশের বড় বড় সমস্ত পত্রিকার সম্পাদকই সাগ্রহে তাঁর রচনা প্রকাশ করতেন, কিন্তু জীবনে কারুর কাছ থেকেই তিনি লাভ করেন নি একটিমাত্র কপর্দক। আর এ কথাটাও সত্য, সে যুগের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকই অর্থের বিনিময়ে কোন পত্রিকায় লেখা দিতেন না। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত রচনার জন্যে প্রণামী পেয়েছেন পরিণত বয়সেই।

 সুধীন্দ্রনাথের মত নির্বিরোধী ও অজাতশত্রু সাহিত্যিক বাংলা দেশে আর কেউ আছেন ব’লে জানি না। আগেই বলেছি তিনি বৈঠকে বৈঠকে বেড়াতে ভালোবাসতেন। তখন সাহিত্যিকদের বিভিন্ন দলের ছিল বিভিন্ন বৈঠক। এক বৈঠকধারীদের সঙ্গে আর এক বৈঠকধারীদের মনের মিল, মতের মিল থাকা স্বাভাবিক নয়। অথচ এইসব পরস্পরবিরোধী বৈঠকে গিয়ে সুধীন্দ্রনাথ অনায়াসে মেলামেশা করতেন এবং সব দলই তাঁকে গ্রহণ করত নিজেদেরই একজনের মত।

 আমি যখন তাঁর সঙ্গে প্রথমে পরিচিত হই, তখন আমার বয়স সতেরো-আঠারোর বেশী হবে না। বলা বাহুল্য, বয়সে আমি তাঁর চেয়ে ছিলুম ঢের ছোট, তবু প্রথম থেকেই তিনি আমাকে গ্রহণ করলেন পুরাতন বন্ধুর মত। হয় তাঁর বাড়ীতে, নয় কোন বৈঠকে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হ’ত প্রায় প্রতিদিনই। অনেক দিন তিনি নিজেই আমার বাড়ীতে এসে দেখা করতেন। ঠাকুর-গোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর চেয়ে মিশুক ও নিরভিমান মানুষ আমি আর দেখি নি। সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের নিয়ে তাঁর সঙ্গে যখন আলোচনা হ’ত তখন তিনি এমন সাবধানে কথা কইতেন যে, কিছুতেই আন্দাজ করা যেত না, তাঁর আসল নিজস্ব মতামত কি। দলাদলির ভিতরে জড়িয়ে পড়তে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নারাজ। তাঁর মুখে কখনো কারুর নিন্দা শুনি নি। কখনো তাঁকে রাগ করতে বা বিরক্ত হ’তেও দেখি নি। কোন প্রসঙ্গ তাঁর মনের মত না হলে তিনি একেবারেই গম্ভীর হয়ে যেতেন।

 কারুর মনেই তিনি সাধ্যমত ব্যথা দিতে চাইতেন না। তিনি কোন নতুন লেখায় হাত দেন না কেন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘লিখতে আমার ভয় হয় হেমেন্দ্রবাবু!’

 —‘সে কি সুধীনবাবু!’

 —‘লেখা শুরু করলে একসঙ্গে দশ-বারোটা গল্প লিখতে হবে।’

 —‘কেন?’

 —‘দশ-বারোজন সম্পাদকের কাছে অঙ্গীকার করেছি, নতুন গল্প লিখলেই তাঁকে দেব। তাই মাথায় লেখার প্লট এলেও হাত গুটিয়ে ব’সে থাকি। একজন সম্পাদককে একটা গল্প দিলে কি আর রক্ষা আছে? অমনি বাকি সবাই এসে একসঙ্গে আমাকে আক্রমণ করবেন।’

 এ-রকম অদ্ভুত কারণে লেখায় ইস্তফা দিয়েছেন, এমন আর কোন সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি।

 কিছুকাল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর খুব দহরম-মহরম হয়েছিল। দু’জনকে উঠতে-বসতে চলতে-ফিরতে সর্বদাই দেখা যেত একসঙ্গে। এমন দু’জন বিরুদ্ধ-প্রকৃতি মানুষের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠতা হ’ল কেমন ক’রে, অবাক হয়ে তাই ভাবতুম। একজনের স্বভাব উগ্র, আর একজন পরম শান্ত। একজন মুখর, আর একজন সংযতবাক। একজন অতি চঞ্চল, আর একজন ধীর-স্থির। একজন জোর গলায় নিজের মতামত ব্যক্ত করেন, আর একজন নিজের মতামত কাকপক্ষীকেও টের পেতে দেন না।

 একদিন দেখি পথ দিয়ে চলেছেন সুধীন্দ্রনাথ, হাতে তাঁর খাবারের ঠোঙা। তখনও পর্যন্ত ঠাকুরবাড়ীর কারুর হাতে খাবারের ঠোঙা দেখি নি। বিস্মিত হয়ে সুধলুম, ‘আপনার হাতে খাবারের ঠোঙা?’

 হাসিমুখে তিনি বললেন, ‘দোকান থেকে আলুরদম কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’

 —‘কেন, আপনার বাড়ীতে কি আলুরদম হয় না?’

 —‘হয়, কিন্তু দোকানের মত স্বাদ হয় না।’

 —‘স্বাদ না হবার কারণ কি?’

 —‘বাড়ীর আলুরদমে তো রাস্তার ধূলো পড়ে না!’

 গড়ের মাঠের কখনো ফুটবল খেলা দেখেন নি ব’লে একদিন তাঁকে মোহনবাগানের খেলা দেখাবার জন্যে জোর ক’রে ধ’রে নিয়ে গিয়েছিলুম।

 তি।ন বিপুল বিস্ময়ে ব’লে উঠলেন, ‘একি, এরা খালি পায়ে ফুটবল খেলে!’

 —‘কেন, আপনি কি তা জানতেন না?’

 —‘না। আমি জানতুম ওরা মোজা প’রে খেলে।’

 তাঁর বইগুলির ছাপাই ও বাঁধাই প্রভৃতি যাতে দৃষ্টি-আকর্ষক হয়, সে সম্বন্ধে তিনি থাকতেন অত্যন্ত সচেতন। নিজে বিশেষ সতর্ক হয়ে বার বার প্রুফ দেখতেন। তবু পাছে ভুল থেকে যায় সেই ভয়ে শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (ঐতিহাসিক) প্রভৃতিকে আহ্বান ক’রে বলতেন, যে ছাপার ভুল আবিষ্কার করতে পারবে তাকেই পুরস্কার দেওয়া হবে— প্রত্যেকটি ভুলের জন্যে এক টাকা। কিন্তু এমনি ছাপাখানার ভুতের মহিমা যে, এতখানি সাবধানতার পরেও পুস্তক প্রকাশিত হ’লে দেখা যেত তার মধ্যে মুদ্রাকর-প্রমাদ আছে একাধিক!

 স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রসঙ্গে একপদ সুধাকৃষ্ণ বাগচীর গল্প বলেছি। একদিন পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের বাড়ীতে গিয়ে দেখি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। ঘরের মেঝেয় পাতা কাঠের পাটাতনের উপরে খঞ্জ সুধাকৃষ্ণের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছেন— রাগ করে নয়, সখ ক’রে। তারপর দু’জনেই জড়াজড়ি ক’রে পাটাতনের উপর থেকে দুম ক’রে পপাতধরণীতলে।

 সুধাকৃষ্ণ তখন প্রায় বালক আর সুধীন্দ্রনাথ প্রায় বৃদ্ধ। প্রাচীন বয়সেও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুশুলভ মন নিয়ে অনেক মজার গল্প প্রচলিত আছে। বোধ করি পুত্র সুধীন্দ্রনাথও লাভ করেছিলেন সেই মনের খানিকটা।