রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/১
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(১)
রাজধরমাণিক্য
১৬০১ খৃষ্টাব্দে রাজধরমাণিক্য সিংহাসনে আরোহণ করেন। মঘের উৎপীড়নে উদয়পুর হস্তচ্যুত হইলেও ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তরভাগ অক্ষুণ্ণ রহিয়া গেল। বর্ত্তমান কৈলাসহর বিভাগের মনুনদীর তীরে মহারাজ অমরমাণিক্য রাজপাট স্থাপন করিয়া জীবনের শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করেন। মহারাজের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই রাজধরের মস্তক রাজমুকুটে বিভূষিত হইল। যে স্থানে অভিষেক কার্য্য সম্পন্ন হয় তাহা ‘রাজধর ছড়া’ নামে খ্যাতিলাভ করে। বর্ত্তমানে কৈলাসহর অঞ্চলে ঐ স্থানকে চল্তি ভাষায় ‘রাতাছড়া’ বলা হয়, ইহা দেম্দুম্ ছড়ার নিকটবর্ত্তী। কিছুকাল পূর্ব্বে রাজধর ছড়ায় মৎস্য ধরার সময় দুইটি ত্রিপদী পাওয়া যায়, ত্রিপুরেশ্বরগণ যেরূপ ত্রিপদীতে ভোজন পাত্র স্থাপন করেন এই দুইটিও তদনুরূপ।
আকবরের সহিত সংগ্রামে লিপ্ত হইয়া রাণা প্রতাপ যেরূপ পর্ব্বতের নিভৃত প্রদেশে সামান্য গৃহে রাজপাট স্থাপন করেন, অমরমাণিক্যও তেমনি জীবনের শেষ দিনগুলি সামান্য ঘর বাড়ীতে কাটাইয়া যান। পিতার মৃত্যুর পর রাজধর এই সামান্য বসন-ভূষণ-ভবনে রাজা হইয়া দিন কাটাইতে লাগিলেন। উদয়পুরের স্মৃতি কখনও ভুলিতে পারিতেন না। কি উপায়ে পতৃিপিতামহের গৌরব-সমুজ্জ্বল উদয়পুরের উদ্ধার সাধন করিতে পারেন সেই চিন্তায় দিবারাত্র বিভোর থাকিতেন।
কিছুকাল পরে ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁহার প্রতি সুপ্রসন্না হইলেন। মঘরাজ্যে গোলযোগ হওয়ায় মঘ সৈন্য উদয়পুর হইতে উঠিয়া গেল। এই সুযোগে রাজধর পাত্র মিত্র সভাসদ্ লইয়া উদয়পুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন। তখন ভাদ্রের প্রথমভাগ, কৃষ্ণপক্ষ, পর্ব্বতে পর্ব্বতে জুম ধান পাকিয়া সুঘ্রাণ ছড়াইতেছে, মাথার উপরে রাজচ্ছত্র মৃত্যুমন্দ পবনে হেলিতেছে, রাজধর চাহিয়া দেখিলেন হাস্যময়ী প্রকৃতি যেন তাঁহাকে সাদরে নিরীক্ষণ করিতেছেন। খুটিশৈল বামে রাখিয়া ধ্বজনগরপথে রাজধর বর্ত্তমান আগরতলার পার্শ্ব ঘেষিয়া বিশালগড়ে পৌঁছিলেন, সেখান হইতে অভিনিস্ক্রমণ স্থান ডোমঘাট পৌঁছিতেই চারিদিকে সাড়া পড়িয়া গেল। মহাসমারোহে রাজধর পুরপ্রবেশ করিলেন, সে সময়ে সেলামবাড়ি নামে জাতীয় বাদ্য বাজিতেছিল।
রাজধর সিংহাসনে বসিয়া কেবলি দেবসেবায় মন দিলেন। পিতার ভাগ্যবিপর্য্যয়ে তাঁহার বোধ হইয়াছিল একমাত্র বিষ্ণু সেবাই সার আর সকলই অসার। নিত্য প্রাতঃস্নান করিয়া সন্ধ্যাপূজায় নিমগ্ন থাকিতেন, রাজপুরোহিতদ্বয় সার্ব্বভৌম ও বিরিঞ্চিনারায়ণ মহারাজকে দিয়া প্রত্যহ পঞ্চপাত্রে অন্নদান করাইতেন। এইরূপে দেবকার্য্য সমাধা করিয়া তিনি দ্বিপ্রহরে রাজসভায় মন্ত্রী পরিবেষ্টিত হইয়া বসিতেন। আবার সন্ধ্যায় ভাগবত শ্রবণে তন্ময় থাকিতেন, মহারাজের ধর্ম্মানুরাগ এইভাবে দিন দিন বাড়িতে লাগিল, তিনি মুক্তকণ্ঠে বলিতেন অহোরাত্র হরিকীর্ত্তন শুনিয়া জীবন কাটিয়া যাউক, আর মনুষ্যজন্ম হয় কি না কে জানে! তরুণ বয়সে রাজাকে হরিনামে বিভোর দেখিয়া সার্ব্বভৌম বলিলেন—“মহারাজ বৃদ্ধ বয়সে হরিনাম অহোরাত্র করিবেন, এখন ত সে সময় আইসে নাই।” মহারাজের একথা অবশ্যই মনঃপূত হইল না।
মহারাজের মনের ভাব ছিল—‘গৃহীত ইব কেশেষু ধর্ম্মমাচরেৎ’। তাই মুখ ফুটিয়া বলিলেন—“প্রভো, কতদিন বাঁচিব তারই ঠিক কি, যতক্ষণ শ্বাস তাছে ততক্ষণ হরিনামের সঙ্গেই এ শ্বাস ক্ষয় হউক, তাহাতে সর্ব্বপাপ ধুইয়া যাইবে এবং অন্তে হরিপদ পাইব।” তাঁহার সঙ্কল্প অনুযায়ী অষ্টপ্রহর কীর্ত্তনের ব্যবস্থা হইল, আটজন কীর্ত্তনীয়া এই কার্য্যের জন্য নিযুক্ত হইল। মহারাজ হরিনামে বিভোর হইয়া দিন কাটাইতে লাগিলেন। এক বিচিত্র বিষ্ণুমন্দির স্থাপন করিয়া মহারাজ তাহাতে বিষ্ণু আরাধনা করিতেন। অবিরত ধর্ম্মকর্ম্মে রাজধর আত্মনিয়োগ করিয়াছেন এই সংবাদ দেশ দেশান্তর ছাপাইয়া ক্রমে গৌড়েশ্বরের কানে উঠিল, তিনি দেখিলেন ইহা এক মস্ত সুযোগ। ত্রিপুরা আক্রমণের জন্য গৌড়সৈন্য সমরায়োজন করিতে লাগিল।
ত্রিপুরারাজ্য হস্তিবলে সমৃদ্ধ, গৌড়েশ্বর হস্তী অশ্ব ধনরত্ন লুণ্ঠন অভিপ্রায়ে এক বিপুল ফৌজ পাঠাইয়া দিলেন। মহারাজ হরিনামে তন্ময় এমন অবস্থায় তাঁহার কানে এই দুঃসংবাদ পৌছিল। এক কালে রাজধর যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, সেই শৌর্য্যবীর্য্য ত্রিপুরার এ সঙ্কট কালে তাঁহাতে পুনরায় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। মহারাজ স্ব-সেনাপতিগণকে অভয় দিলেন—“মাভৈঃ, বিষ্ণুকৃপায় সর্ব্ব অমঙ্গল নিরস্ত হইবে।” ত্রিপুর সৈন্যের অধিনায়করূপে চন্দ্রদর্পনারায়ণ কৈলাগডে (কস্বা) গড়খাই করিয়া গৌড়সৈন্যের গতিরোধ করিলেন। গৌড়সেনাপতি ত্রিপুরেশ্বরের হরিনামে ডুবিয়া থাকিবার কথায় মনে করিয়াছিলেন যুদ্ধ বড় একটা হইবে না, গৌড়সৈন্যের সদর্প পদধ্বনিতেই পথ পরিষ্কার হইয়া যাইবে। এইরূপ একটা ভ্রান্ত ধারণায় যখন গৌড়সেনা আরাম আয়েসে গা ঢালিয়া আসিতেছিল তখন অতর্কিতে ত্রিপুরসৈন্যের প্রবল আক্রমণে তাঁহাদের সে সুখস্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গেল। গৌড়বাহিনী একেবারে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। বিষ্ণুশক্তিতে যেন ত্রিপুরসৈন্যের বাহু সবল হইয়া উঠিয়াছিল, সে বলের নিকট পরাভূত হইয়া গৌড়-কটক পলায়ন করিল।
বিপদের মেঘ কাটিয়া গিয়া আনন্দের সুপ্রভাত হইল। উদয়পুরে আর আনন্দ ধরে না, গৃহে গৃহে উৎসব মুখরিত। বিষ্ণুকৃপায় রাজা রক্ষা পাইয়াছে ইহা সকলেরই ধারণা হইল। রাজধর বিষ্ণুমন্দির প্রদক্ষিণ ও বিষ্ণুর পাদোদক গ্রহণ করিতে করিতে তাঁহার জীবনের দিনগুলি কাটাইতেছিলেন। তৎপ্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুমন্দির গোমতীনদীর তীরে। সেই নিভৃত স্থানে মহারাজের সকাল সন্ধ্যা কাটিতে লাগিল। একদিন হরিনামে বিভোর হইয়া মন্দির প্রদক্ষিণ করিতেছিলেন, ভাবাবেশে কখন যে গোমতী নদীতে পড়িলেন জানিতে পারিলেন না। এই ভাবে বিষ্ণুভক্ত রাজার মৃত্যু ঘটিল, রাজ্যময় সে শোকসংবাদ ছড়াইয়া পড়িল। মহারাজ রাজধরের পুত্র যশোধর পাত্রমিত্র মন্ত্রী সভাসদ্ ও ব্রাহ্মণ পুরোহিত সহ নদীতীরে ছুটিয়া গেলেন। বৈকুণ্ঠাখ্য রাজ-শ্মশানে দাহ-কার্য্য সম্পন্ন হইল।