রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/২
(২)
যশোধরমাণিক্য ও জাহাঙ্গীর
১৬১৩ খৃষ্টাব্দে রাজধরের পুত্র যশোধর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। যশোধর মঘরাজের বিক্রম জানিয়া তাঁহার সহিত মৈত্রী স্থাপন করেন, ইহাতে রাজ্যে মঘভীতি দূর হইয়া যায়। ইহার পর ভুলুয়া বিদ্রোহী হয় কিন্তু যশোধরমাণিক্যের প্রবল আক্রমণে ভুলুয়া পুনঃ পদানত হইয়া পড়ে।
যশোধরমাণিক্য দিল্লীর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক। গৌড়েশ্বর হস্তীর লোভে ত্রিপুরা আক্রমণ করিয়া ব্যর্থকাম হইয়াছিলেন, এ সংবাদ বাদশাহের কানে উঠে। ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণে অগণিত হস্তিবল দ্বারা মোগল সৈন্য সমৃদ্ধ হইবে এই ভরসায় জাহাঙ্গীর সুদূর ত্রিপুরায় অভিযান প্রেরণ করেন। এতকাল ত্রিপুরার সহিত গৌড়েশ্বরের শক্তির পরীক্ষা হইয়াছে, এইবার দিল্লীর বাদশাহ ত্রিপুরা ধ্বংসের জন্য স্বীয় বাহুবল প্রয়োগ করিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যের পক্ষে ঘোর দুর্দ্দিন উপস্থিত হইল।
নবাব ফতেজঙ্গ দিল্লী হইতে দুইজন প্রধান উমরা সঙ্গে লইয়া বিপুল বাহিনীসহ যুদ্ধ যাত্রা করিলেন এবং কিছুকাল মধ্যে ঢাকা আসিয়া পৌঁছিলেন। ফতেজঙ্গ ঢাকার কেল্লা পরিদর্শন করিয়া সেখান হইতেও সৈন্য সংগ্রহ করিলেন। ঢাকা নগরীতে বসিয়া ফতেজঙ্গ যুদ্ধের পরিকল্পনায় ব্যস্ত হইলেন, যাহারা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে ত্রিপুরার গিরিবর্ত্ম জানে তাহারা পথ ঘাটের সন্ধান ফতেখাঁর গোচর করাইল। ফতেখাঁ যুদ্ধের নক্সা আঁকিয়া ফেলিলেন—একভাগ কৈলাগড় পথে ও অপর ভাগ মেহেরকুল (কুমিল্লা) পথে আসিয়া উদয়পুরকে যুগপৎ ঘেরাও করিয়া গলা টিপিয়া মারিবার ব্যবস্থা করিবে। নবাব ফতেখাঁ ঢাকায় রহিয়া গেলেন, তাঁহার নক্সা অনুযায়ী দুই উমরাহ ইস্পিন্দার ও নুরুল্যা দুইভাগে সৈন্য লইয়া বাদসাহী ফৌজসহ যাত্রা করিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে পৌঁছিয়াই ইস্পিন্দার কৈলাগড় (কসবা) পথে এবং নুরুল্যা মেহেরকুল পথে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
এতবড় সমরায়োজনেও যশোধরমাণিক্যের বীর হৃদয় দমিয়া যায় নাই ইহা অত্যন্ত গৌরবের কথা। তিনি মোগল সৈন্যের গতিরোধ করিবার জন্য দুইদিকেই সৈন্য পাঠাইলেন এবং বাদশাহ কি কারণে তাঁহার সহিত সংগ্রামে লিপ্ত হইয়াছেন জানিবার উদ্দেশ্যে স্বীয় দূত মোগল শিবিরে প্রেরণ করিলেন। মোগল শিবির হইতে উত্তর আসিল—দিল্লীশ্বর এই ইচ্ছা করেন যে ত্রিপুরার যত হস্তী আছে সমস্তই বাদসাহকে অর্পণ করা হউক। যদি ত্রিপুরার মহারাজ ইহাতে অস্বীকৃত হন তবে যেন মোগলের সহিত স্বীয় বাহুবল পরীক্ষা করেন। যশোধরমাণিক্য প্রত্যুত্তরে জানাইলেন বীরের ন্যায় তিনি খাপ হইতে তরবারী খুলিবেন, যদি হার হয় তবেই ইহা সম্ভব।
সুতরাং প্রবল পরাক্রম দিল্লীশ্বরের সহিত ত্রিপুরার নরনাথ যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন। বীরত্বের তীব্র উদ্দীপনায় বিপক্ষের সমুদ্রপ্রমাণ সৈন্যের সহিত যুদ্ধ আদৌ সম্ভবপর কিনা ইহা ভাবিয়া দেখেন নাই কিন্তু যখন ত্রিপুর সৈন্যেরা যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া শত্রুসৈন্যের কূলকিনারা পাইল না তখন সকলেই রণে ভঙ্গ দিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে ত্রিপুর সৈন্যের শোচনীয় পরাজয় কাহিনী মহারাজের কানে আসিতে আসিতেই খবর পৌঁছিল যে ইস্পিন্দার ও নুরুল্যা বাদশাহী ফৌজ লইয়া উদয়পুর আসিয়া পড়িয়াছেন প্রায়। চারিদিকে হাহাকার পড়িয়া গেল, যশোধরমাণিক্য স্বীয় পরিজন ও পাত্রমিত্র সহ অমরমাণিক্যের ন্যায় গভীর অরণ্যে লুকাইয়া পড়িলেন—প্রজারাও যে যেদিকে পারিল ছুটিল, উদয়পুর শ্মশানের ন্যায় শূন্য নির্জ্জন হইয়া পড়িল। যখন উমরাহদ্বয় রাজধানীতে পৌঁছিলেন তখন আকবরের আক্রমণে শূন্য চিতোরের ন্যায় উদয়পুর আলোক-বিহীন (বে-চেরাগ)। মোগল সৈন্যেরা লুটতরাজ করিল, শূন্য নগরীতে শিবির খাটাইয়া সমরোল্লাসে রজনী কাটাইল, পরদিন রাজার খোঁজে লোক ছুটিল, গুপ্তচরে উদয়পুরের বনবনানী ছাইয়া গেল। শৈল হইতে শৈলান্তরে পলায়মান প্রতাপ সিংহের ন্যায়, যশোধর শত্রুহস্ত এড়াইয়া চলিতে লাগিলেন। কিন্তু এইভাবে কতদিন চলে? চরমুখে রাজবার্ত্তা শুনিয়া নুরুল্যা একদিন সহসা সৈন্যদিয়া মহারাজের বিশ্রামবন ঘেরাও করিয়া ফেলিলেন। যশোধরমাণিক্য ধৃত হইলেন।
বন্দী অবস্থায় যশোধরমাণিক্যকে লইয়া ইস্পিন্দার ও নুরুল্যা ঢাকায় চলিয়া আসিলেন। এদিকে উদয়পুরে মোগল ফৌজ অবরোধ করিয়া রহিল। নবাব ফতেজঙ্গ মহারাজকে পাইয়া বড়ই প্রীতিলাভ করিলেন, মনে মনে ভাবিলেন অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন। মহারাজকে পাইলে বাদশাহের আনন্দের সীমা থাকিবে না, নবাবের ভাগ্যেও কত না জয়মাল্য পড়িবে!
ফতেজঙ্গ মহারাজকে সমাদর করিয়া কহিলেন—“আপনি যখন বাদশাহের অভিপ্রায় মানিতে চাহেন না তখন বাদশাহের সহিত আপনার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিতেছি, আপনার যাহা বক্তব্য থাকে বাদশাহকেই বলুন।” ফতেজঙ্গ যশোধরমাণিক্যকে বাদশাহ সমীপে দিল্লীতে পাঠাইয়া দিলেন। মহারাজ দিল্লীতে পৌঁছিলে, বাদসাহের দরবার হইতে তাঁহার ডাক পড়িল। যশোধরমাণিক্য যখন বাদশাহের দরবারে উপনীত হইলেন তখন জাহাঙ্গীর প্রচুর সম্মানের সহিত মহারাজকে স্বীয় আসনের নিকট বসাইয়া সৌজন্য পূর্ব্বক যুদ্ধের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
যশোধরমাণিক্য বলিলেন—আর রাজত্বে কায নাই। তাঁহাকে বলা হইয়াছিল—“মহারাজ আপনার ত্রিপুরা রাজ্যে আপনি স্বচ্ছন্দে ফিরিয়া যান, শুধু হস্তিবল বাদশাহকে অর্পণ করুন।” যশোধরমাণিক্যের চিত্ত স্বাধীনতা হারাইয়া এত ব্যথিত হইয়াছিল যে বাদশাহকে মুখ ফুটিয়া বলিলেন—“বাদশাহ, আপনার নিকট একটি প্রার্থনা জানাইতেছি আর রাজত্বে কায নাই, আমাকে ছুটি দিন। যে রাজ্যে পরাজিত হইয়া আমাকে স্বদেশত্যাগে সুদূর দিল্লীতে চলিয়া আসিতে হইয়াছে সে দেশে আর অপমানের ডালা মাথায় করিয়া যাইতে চাহি না। বাদশাহের অনুমতি পাইলে জীবনের বাকী দিনগুলি তীর্থপর্য্যটনে কাটাইতে ইচ্ছা করি।”
বাদশাহ মহারাজের রাজ্যোচিত বলদৃপ্ত বাক্য শুনিয়া মুগ্ধ হইলেন এবং তীর্থদর্শনের জন্য অবাধগতির অধিকার দান করিলেন। দরবার হইতে বিদায় হইয়া যশোধরমাণিক্য সর্ব্বপ্রথমে কাশীধাম যাত্রা করিলেন, মহারাণী ও অন্যান্য পরিজন তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। কাশীবাসে মহারাজের মনের গ্লানি দূর হইল। মণিকর্ণিকাতে গঙ্গাস্নান করিয়া বিশ্বেশ্বর অন্নপূর্ণা দর্শন করিলেন এবং মহারাণীর সহিত অন্যান্য দেবতা দর্শনে পরিতৃপ্ত হইলেন। এইভাবে কিছুকাল কাশীতে পরমানন্দে কাটাইয়া মহারাজ প্রয়াগ যাত্রা করেন, সেখানকার পিতৃকার্য্যাদি করিয়া মথুরাধামে পৌঁছেন। মথুরা, গোকুল, গিরিগোবর্দ্ধন, শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড ও শ্রীবৃন্দাবন দর্শনে মহারাজের আনন্দের সীমা রহিল না। শ্রীবৃন্দাবনে তাঁহার জীবনের দিনগুলি ভক্তিরসে সিক্ত হইয়া কাটিতে লাগিল, কেবলি ভাবিতে লাগিলেন কতদিনে এ তনু ত্যজিয়া শ্রীকৃষ্ণের চরণ পাইব। এইভাবে ৭২ বৎসর বয়সে মহারাজ ধাম প্রাপ্ত হইলেন। মহারাজ যশোধরমাণিক্যের শেষজীবন পুরাকালের রাজর্ষিদের ন্যায়। যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছিলেন সত্য কিন্তু যে হরিপদ-প্রাপ্তিতে মৃত্যুভয় দূর হয় সে জয় যাঁহার ভাগ্যে ঘটিয়াছিল, তিনি পরাজিত হইয়াও জয়ী।