রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/১১
(১১)
দ্বিতীয় রত্নমাণিক্য
পিতার মৃত্যুর পর ১৬৮২ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় রত্নমাণিক্য পিতৃসিংহাসন আরোহণ করেন। তখন রত্নের বয়স অল্প। রত্নের মাতুল বলিভীমনারায়ণ রত্নের নামে রাজক্ষমতা পরিচালন করিতে লাগিলেন এবং নিজকে যুবরাজরূপে প্রচার করিলেন। রামমাণিক্যের অষ্টাদশ পুত্র ছিল, বলিভীম ইহাদিগের মধ্যে বয়ঃপ্রাপ্ত কুমারগণকে ক্রমে ক্রমে সরাইয়া ফেলিলেন। বলিভীমের দৌরাত্ম্য এতই বাড়িয়া উঠিল যে এ সংবাদ ঢাকার নবাব শায়েস্তা খাঁর কানে উঠিল। তখন শায়েস্তা খাঁ ঢাকার শাসন কর্ত্তা, তিনি বলিভীমনারায়ণকে ধরিবার জন্য বহু সৈন্যসহ কেশরীদাসকে কুমিল্লা প্রেরণ করেন। বলিভীম আত্মরক্ষায় অসমর্থ হইয়া ধৃত হইলেন, প্রথমে তাঁহাকে ঢাকা নেওয়া হয় তৎপর মুর্শিদাবাদ নবাবের নিকট পাঠান হয়। এইরূপে বলিভীমের দুর্বৃত্তপণার অবসান ঘটে।
শায়েস্তা খাঁ বলিভীমের স্থানে কাহাকে বসাইবেন এই লইয়া চক্রান্ত চলিতে লাগিল। রামমাণিক্যের সময়ে দ্বারকা একবার সিংহাসনে বসিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন এইবার তিনি উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। শায়েস্তা খাঁর সহিত যোগাযোগ স্থাপন করিয়া ফৌজসহ দ্বারকা ঢাকা হইতে উদয়পুর আক্রমণে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। রত্নমাণিক্য অপ্রাপ্ত বয়স্ক, দেশদ্রোহীর এরূপ সমরায়োজনে ভয় পাইয়া তিনি পরিজনসহ উদয়পুর ছাড়িয়া বনে প্রবেশ করিলেন। রামমাণিক্যের অনুজ জগন্নাথ-তনয় সূর্য্যনারায়ণ ছিলেন উজীর, অন্য তনয় চম্পক রায় ছিলেন দেওয়ান।[১] দ্বারকার আক্রমণে উজীরের মৃত্যু হয়; তখন বেগতিক দেখিয়া চম্পকরায় পলায়ন করেন। দ্বারকার দীর্ঘকালের সঞ্চিত উচ্চাভিলাষ পূর্ণ হইল, উদয়পুর সগৌরবে প্রবেশ করিয়া তিনি নিজকে নরেন্দ্রমাণিক্য নামে প্রচার ক্রমে সিংহাসন আরোহণ করেন। নরেন্দ্রমাণিক্য আপন অভিপ্রায় গোপনে রাখিয়া বনবাসী রত্নমাণিক্যের নিকট উদয়পুরে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার জন্য রাজদূত পাঠাইয়া দিলেন। রাজদূত রত্নমাণিক্যকে পত্র দিল।
পত্র পাঠে রত্নের মনে হইল, নরেন্দ্র যাহা লিখিয়াছেন সবই সত্য, তাঁহার অভাবে উদয়পুর নরেন্দ্রের নিকট প্রাণহীন ঠেকিতেছে, রত্নের আগমনে পুনরায় নগরে প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়া আসিবে। এই ভাবিয়া রত্ন ফিরিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। তাঁহার পরিজনবর্গ প্রতিকূলে অনেক বুঝাইল, কিন্তু কোন ফল হইল না।
রত্নমাণিক্যকে প্রত্যাবর্ত্তনে কৃতনিশ্চয় বুঝিয়া পাত্র মিত্র মন্ত্রী সকলেই রাজার অনুগামী হইলেন। উদয়পুরে পৌঁছিয়াই রত্ন নিজের ভুল বুঝিলেন কিন্তু তখন ফিরিবার সময় নাই। নরেন্দ্রমাণিক্য সুযোগ বুঝিয়া সকলকে সৈন্য দিয়া ঘেরাও করিলেন এবং একে একে তাঁহাদিগকে বন্দীশালায় পাঠাইয়া দিলেন। সেখানে মন্ত্রীবর্গের প্রাণ সংহারে অধিক বিলম্ব হইল না। এইরূপে কৌশলে পলায়মান শক্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলিয়া দিয়া দেওয়ান চম্পক রায়কে ধরিবার জন্য ফাঁদ পাতিতে লাগিলেন।
চম্পক রায় চট্টগ্রামে আশ্রয় লইয়াছিলেন। সেখানে ধৃত হইবার উপক্রম হওয়ায় তিনি ভুলুয়া চলিয়া আসেন, সেখানেও যখন তিষ্ঠান দায় হইল তখন চম্পকরায় উপায়ান্তর না দেখিয়া ঢাকার নবাবের আশ্রয় ভিক্ষা করেন। মহারাজ রত্নের কনিষ্ঠ ভ্রাতা দুর্য্যোধন তথায় চম্পকের সহিত মিলিত হন, নবাব সেনাপতি আমির খাঁ ইঁহাদের পক্ষ লইলেন। এই তিনজনে মিলিয়া রত্নমাণিক্যকে পুনঃ সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। নবাবকে অনেক বুঝান হইল যে নরেন্দ্র নবাবের অভিপ্রায় অনুযায়ী যুবরাজ না হইয়া একেবারে মস্নদ অধিকার করিয়া বসিয়াছেন এবং রত্নমাণিক্য ও তাঁহার অমাত্য বর্গকে কারারুদ্ধ করিয়াছেন। এই সংবাদে নবাব অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া নরেন্দ্রকে ধরিয়া আনিবার জন্য মোগল ফৌজ পাঠাইয়া দিলেন। চম্পক রায়ের প্রচেষ্টা সফল হইল, নরেন্দ্রকে বন্দী করিয়া ঢাকা আনা হইল। রত্নমাণিক্য পুনরায় সিংহাসনে বসিলেন এবং চম্পক রায় যুবরাজরূপে ঘোষিত হইলেন।
এই ভাবে রাজ্যশাসন কিছুকাল চলিল। কিন্তু নক্ষত্ররায় বাঙ্গলার নবাবের সাহায্যে ভ্রাতৃবিরোধের যে দাবানল জ্বালিয়া গিয়াছিলেন তাহা নিভে নাই। রামমাণিক্যের পুত্রদের মধ্যে রাজা হইবার লালসা সকলকেই পাইয়া বসিয়াছিল, রত্নমাণিক্যকে দূর করিয়া কি ভাবে সিংহাসনে বসা যায় ইহাই হইল ইহাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। সেই অভীষ্ট সাধনের জন্য স্বদেশের স্বাধীনতা বলি দিতে ইঁহারা কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন নাই। নরেন্দ্রের কার্য্যকলাপ দেখিয়া পুনরায় রত্নের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঘনশ্যাম ঠাকুর রাজস্বপ্নে বিভোর হইলেন। তিনি গোপনে মুর্শিদাবাদের নবাবের নিকট যাইয়া সৈন্যপ্রার্থী হইলেন। নবাব ত্রিপুরাকে অল্পায়াসে বশ করিতে পারিবেন দেখিয়া ইহাতে সম্মত হইলেন। আবার মোগল সৈন্য আসিয়া উদয়পুরে হানা দিল, রত্নমাণিক্য সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন না। সুতরাং ঘনশ্যাম ঠাকুরের হাতে উদয়পুর চলিয়া আসিল। ঘনশ্যাম মহেন্দ্রমাণিক্য নামে নিজকে প্রচার করিয়া সিংহাসনে বসিলেন। রত্নের দিন বন্দীশালায় কাটিতে লাগিল। মহেন্দ্রমাণিক্যের শাসনে রত্নের প্রাণসংহারের ব্যবস্থা হইল, অত্যল্পকাল মধ্যেই রত্নমাণিক্যের প্রাণহীন দেহ ভূমিতে লুটাইল। স্বামীর চিতায় রাণী রত্নবতী সহমৃতা হইলেন।
রত্নমাণিক্যের রাজত্বকাল সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসরের অধিক, তিনি আওরঙ্গজেবের রাজত্বের মধ্যভাগে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইয়া উক্ত মোগল সম্রাটের পরেও কয় বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার শাসনকাল যেন মেরুদণ্ডবিহীন এক মানুষের জীবনকাহিনী। রাজ্যলোভী কুমারেরা পুণ্যকীর্ত্তি পূর্ব্বপুরুষের স্বদেশপ্রেম বিস্মৃত হইয়া, বিশাল ত্রিপুরা রাজ্যকে সম্রাটের হাতে সঁপিয়া দিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন নাই। এত চক্রান্ত-জালের মধ্যেও ত্রিপুরার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয় নাই।” মেজর ষ্টুয়ার্ট স্বপ্রণীত বাঙ্গলার ইতিহাসে লিখিয়াছেন যে যদিচ ইতঃপূর্ব্বে মুসলমানদিগের বাহুবলে ত্রিপুরা লুণ্ঠিত ও বিজিত হইয়াছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয় নাই। ত্রিপুরেশ্বর স্বাধীন ছত্র ধারণ পূর্ব্বক স্বনামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচার করিতেছিলেন। ১৭০৭-০৮ খৃষ্টাব্দে ত্রিপুরেশ্বর, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর প্রবল বিক্রম কাহিনী শ্রবণে তাঁহাকে গজ ও গজদন্ত প্রভৃতি উপঢৌকন প্রদান করেন। তদ্বিনিময়ে নবাব ত্রিপুরেশ্বরকে “খেলাত” প্রদান করিয়াছিলেন।”[২]
- ↑ চম্পকবিজয় নামক একখানি হস্তলিখিত পুঁথিতে তৎকালীন ঘটনার সবিস্তার আভাষ দেওয়া হইয়াছে, পুস্তকখানি পদ্যে লিখিত কিন্তু রাজমালার ন্যায় ইহার ভাব সুপরিস্ফুট নহে।
- ↑ Stewart’s History of Bengal, p. 233. কৈলাস সিংহ প্রণীত রাজমালা, পৃঃ ৯৯।