রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/৬
(৬)
আরাকান রাজ্যে গোবিন্দমাণিক্য ও সুজা
রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া গোবিন্দমাণিক্য প্রথমতঃ রিয়াং প্রজাদের আতিথ্য গ্রহণ করেন। সেখানে কিছুকাল থাকার পর রাণী গুণবতী লক্ষ্য করিতে লাগিলেন প্রজাদের আদর যত্ন যেন ক্রমেই কমিয়া আসিতেছে। অদৃষ্ট যাহার প্রতি সুপ্রসন্ন নহে তাহার প্রতি কাহারও অনুরাগ জন্মে না। দুঃসময় এমনি, যে রাজদর্শন প্রজাদের একান্ত কাঙ্খনীয় সে রাজা আসিয়া প্রজাদের সহিত স্বয়ং বাস করিতে চাহিতেছেন তথাপি ইহাদের মনে সন্তোষ নাই, কতদিনে রাজরাণী বিদায় হইবেন সেই প্রতীক্ষায় যেন ইহারা অধীর হইয়া উঠিল। এ অবস্থায় ত আর থাকা চলে না! অবশেষে রাজারাণী ত্রিপুরা রাজ্য ত্যাগ করিয়া অন্যত্র যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইলেন। রিয়াং বাস সমাপনান্তে গোবিন্দ-মাণিক্য চট্টগ্রাম পার্ব্বত্যাঞ্চলে উপনীত হইলেন। এক সময়ে যে আরাকান রাজের সহিত ত্রিপুরার ভীষণ শত্রুতা ছিল সেই আরাকানপতির রাজধানী রসাঙ্গ প্রান্তে যাইতেই মঘরাজের নিকট এ সংবাদ পৌঁছিল। অদৃষ্ট এইবার সুপ্রসন্ন হইল, মঘরাজ রাজ্যহীন গোবিন্দমাণিক্যকে পথের কাঙ্গাল ভাবিয়া উপেক্ষা করিলেন না, আতিথ্য দিতে সম্মত হইয়া নিজ অনুচরবর্গকে পাঠাইয়া দিলেন।
গোবিন্দমাণিক্যের সহিত তৎকালে অনুজ জগন্নাথ, যুবরাজ রামদেব, জগন্নাথ-তনয় সূর্য্যপ্রতাপ ও চম্পকরায় ছিলেন। রাণী ও স্বীয় পরিজনবর্গসহ গোবিন্দমাণিক্য আরাকানপতির আতিথ্যগ্রহণ করিয়া সেখানে বসবাস করিতে লাগিলেন। এদিকে অদৃষ্ট চক্রের ঘূর্ণনে যে সুজা বঙ্গের শাসনকর্ত্তাপদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া নক্ষত্ররায়কে ত্রিপুরসিংহাসনে বসাইলেন, তিনি কিয়ৎকাল মধ্যেই মসনদ্চ্যুত হইয়া গোবিন্দমাণিক্যের ন্যায় পথে পথে ফিরিতে লাগিলেন। নিয়তির কি পরিহাস! গোবিন্দমাণিক্য যে আরাকানপতির আশ্রয়ে দিনপাত করিতেছিলেন, সেই একই স্থানে সুজা ঔরঙ্গজেবের ভয়ে কোনওরূপে প্রাণে বাঁচিবার জন্য বেগম ও সাহজাদীসহ আশ্রয়প্রার্থী হইলেন।
তখন রসাঙ্গরাজ ও গোবিন্দমাণিক্য আলাপে রত ছিলেন এমন সময় কক্ষচ্যুত গ্রহের ন্যায় সুজা আসিয়া উপস্থিত। গোবিন্দমাণিক্য স্বীয় স্বভাবের ঔদার্য্যে তৎক্ষণাৎ নিজ আসনে সুজাকে বসিতে দিলেন। রসাঙ্গরাজের ইহা অভিপ্রেত ছিল না। তিনি স্পষ্টই বলিয়া উঠিলেন—“ম্লেচ্ছ সুজাকে দেখিয়া আপনার আসন ত্যাগের কোন কারণ নাই, আপনি স্বচ্ছন্দে বসিয়া থাকিতে পারেন।” কিন্তু সুজা ন্যায়তঃ এ সম্মান তাঁহার নিকট পাইতে পারেন এই বলিয়া গোবিন্দমাণিক্য শিষ্টাচার দেখাইতে ত্রুটি করিলেন না। রসাঙ্গরাজের বাক্যে সুজার মনের অবস্থা কিরূপ হইয়াছিল তাহা এক অন্তর্যামীই বুঝিয়াছিলেন। হায় মানুষের অদৃষ্ট!
সুজা রসাঙ্গরাজের নিকট যে অভ্যর্থনা পাইলেন তাহা দ্বারাই অনুমান করা যায় আরাকান বাস তাঁহার পক্ষে কিরূপ সুখের হইবে। আরাকান রাজ্যের বাহিরে সুজার গতি ঐতিহাসিকেরা জানিতে পারেন নাই, তাই সুজার পরিণাম ইতিহাসে গভীর রহস্যময়। একমাত্র অন্তর্যামীর নিকটই ইহার সন্ধান রহিয়াছে।
যখন আরাকান-রাজের দরবার ভঙ্গ হইল তখন সুজা ও গোবিন্দমাণিক্য মঘরাজের নিকট বিদায় চাহিয়া বাহিরে আসিলেন। মঘরাজের প্রতিহারী শুনিতে না পায় এইভাবে রাজভবন হইতে একটু ব্যবধানে আসিয়া সুজা গোবিন্দমাণিক্যের হাত ধরিয়া বলিলেন—“মহারাজ, আপনি আজ আমার মুখ রাখিয়াছেন, যদি আপনি আসন ত্যাগে আমাকে এই সম্মান না দিতেন তবে আমার মর্য্যাদা কোথায় থাকিত? ভাগ্যের তাড়নায় আমি আজ সর্ব্বস্বান্ত, কি দিয়া যে আপনার ঋণ শোধ করিব বুঝিয়া উঠিতে পারি না।” এই বলিয়া সুজা ক্ষণকাল অধোবদনে রহিলেন, তারপর নিজহস্ত হইতে হীরার অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিয়া মহারাজের হাতে পরাইরা বলিলেন—“মহারাজ, দুর্ভাগা সুজার স্মরণ-চিহ্নটুকু ধারণ করুন, এই আমার অনুরোধ।” গোবিন্দমাণিক্য সসম্মানে সে অনুরোধ রক্ষা করেন।
ভাগ্যবিপর্য্যয়ে রাজ্যভ্রষ্ট উভয় নৃপতিরই দিন রসাঙ্গে কাটিতে লাগিল। সুজা একবার শেষ অদৃষ্ট পরীক্ষার জন্য চেষ্টা পাইলেন। তিনি মঘরাজের কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়া আরাকানপতির সহিত মেলামেশা করিতে লাগিলেন। রসাঙ্গের এক প্রান্তে গভীর পর্ব্বতমালার মধ্যে তাঁহার ভবন নির্ম্মিত
সুজা নিজ হস্ত হইতে হীরার অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিয়া
মহারাজের হাতে পরাইয়া দিলেন। হইয়াছিল। মঘরাজকন্যা সেই ভবনে কখনো কখনো বাস করিতেন আবার বাপের বাড়ী চলিয়া আসিতেন। এই ভাবে রাজকন্যার যাওয়া আসার ধূমধাম কিছুকাল চলিল। একবার রাজকন্যা বাপের বাড়ী যাইতেছে এই অছিলায় সারি সারি দোলা সাজান হইল, সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে স্ত্রী-বেশধারী চল্লিশ জন মল্ল ঐগুলিতে প্রবেশ করিয়া দ্বার রোধ করিয়া রহিল। যখন শিবিকা-বাহকেরা ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে প্রথম ফটকে পৌঁছিল তখন প্রতিহারী বাধা দিতে চাহিলে জানান হইল রাজদুহিতা পিত্রালয়ে যাইতেছেন। ফটক খুলিয়া গেল, এই ভাবে একে একে ছয়টি ফটত পার হইয়া যখন সর্ব্বশেষ ফটকে পৌঁছিল সেখানকার প্রহরীরা সঙ্গীন উঁচু করিয়া জোরে হাঁকিল—কোন্ হ্যায়? পূর্ব্বের ন্যায় তাহাদিগকেও বলা হইল, সেবিকাসহ রাজকন্যা আসিতেছে, পথ ছাড়! কিন্তু প্রহরীদের সন্দেহ হইল—রাজকন্যার সঙ্গে এত পাল্কির কি দরকার? এই বলিয়া তাহারা বাহকগণকে তাড়া করিল। বাহকেরা পাল্কি ফেলিয়া সরিয়া গেল।
তখন বেশ সন্ধ্যা হইয়াছে, উদ্যানের পথে অন্ধকার ভরিয়া উঠিয়াছে, রাজপ্রাসাদের সম্মুখস্থ ঝাড় লণ্ঠন হইতে আলোকরশ্মি সাছের ফাঁকে ফাঁকে পড়িয়াছে। প্রহরীদের হুমকিতে যখন বাহকেরা সরিয়া গেল তখন দোলার দ্বার খুলিয়া চল্লিশ জন মোগল মল্ল বাহির হইয়া আসিল, উভয়ে লড়াই বাঁধিয়া গেল। একজন প্রতীহার নাকাড়া বাজাইয়া দিল। সঙ্কট সঙ্কেত পাওয়া মাত্র দুর্গ হইতে পিল্ পিল্ করিয়া সৈন্যের স্রোত ছুটিল। এমন অবস্থায় মোগলেরা আর কি করিবে, প্রাণ দেওয়া ছাড়া আর ফিরিবার উপায় রহিল না। মঘরাজের নিকট এ সংবাদ পৌঁছিল, তিনি সুজার চতুরতা বুঝিতে পারিলেন। রাজ্যচ্যুত হইয়া আপন আশ্রয়দাতার সিংহাসন অধিকারেও যখন সুজা উদ্যত হইয়াছে তখন তাঁহাকে ত আর আশ্রয় দেওয়া চলেনা। এই ভাবিয়া সুজাকে বন্দী করিবার জন্য ফৌজ পাঠাইয়া দিলেন। দুর্ভাগা সুজার দুর্ভাগ্য চরমে পৌঁছিয়াছিল, আপন মোগল বাহিনীর পরাজয়বার্ত্তা জানিয়া সুজা সেই রজনীর গভীর অন্ধকারে বেগম পরিভানু ও সাহজাদীসহ রসাঙ্গ ত্যাগ করিলেন। মঘরাজ-সৈন্যে চতুর্দ্দিক ছাইয়া গেল, সুজার খোঁজে ইহারা আতিপাতি করিয়া সমস্ত বন অন্বেষণ করিল কিন্তু সুজা নিরুদ্দেশ হইয়া গেলেন, সুজাকে কোথাও পাওয়া গেল না, সেই রাত্রির অন্ধকারে যেন সুজা চিরতরে মিলাইয়া গেলেন।[১]
- ↑ রাজমালায় বিবৃত কাহিনী এইরূপ কিন্তু কৈলাস সিংহ প্রণীত পুস্তকে ভিন্ন বিবৃতি রহিয়াছে। মঘরাজ সুজার বেগম ও কন্যাদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি করায় সুজা উহা প্রতিরোধ করিতে যাইয়া মঘরাজের চক্রান্তে জলে ডুবিয়া প্রাণ হারান এবং তৎপর বেগম ও সাহজাদীরা স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেন; সুজার তৃতীয় কন্যা মঘরাজ-অন্তঃপুরে স্থান প্রাপ্ত হন। রাজমালার সহিত এ কাহিনীর পার্থক্য থাকিলেও সুজার পরিণাম যে বিষাদময় ইহাই প্রতীত হয়।