রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/৭
(৭)
গোবিন্দমাণিক্যের পুনরভিষেক
সুজার ভাগ্যে অদৃষ্টের অন্ধকার-রাত্রি আর পোহাইল না কিন্তু গোবিন্দমাণিক্যের দুর্ভাগ্য রজনী প্রভাত হইল। সাত বৎসর রাজত্ব করিয়া নক্ষত্ররায় পরলোকগমন করেন, এ সংবাদ শীঘ্রই চতুর্দ্দিকে প্রচার হইয়া গেল। মঘরাজ যখন এ সংবাদ পাইলেন তখন গোবিন্দমাণিক্যকে রাজসভায় ডাকাইয়া আনিলেন—“মহারাজ, আপনার দুঃখের দিন ফুরাইয়াছে এখন ত্রিপুরা অভিমুখে যাত্রা করুন। নক্ষত্ররায়ের মৃত্যুতে সিংহাসন শূন্য হইয়া পড়িয়াছে, এ সিংহাসন আপনার, অপর কাহারও ইহাতে অধিকার নাই।” এই বলিয়া মঘরাজ গোবিন্দমাণিক্যকে প্রচুর উপঢৌকন দিয়া বিদায় করিলেন। মঘরাজের আগ্রহ ও সৌজন্য দৃষ্টে ইহাই মনে হয় যদি সৈন্য সাহায্যের প্রয়োজন হইত তবে আরাকানপতি তাহাতেও কুণ্ঠিত হইতেন না।
রাণী গুণবতী ও পরিজনসহ মহারাজ রসাঙ্গ ত্যাগ করিয়া চট্টগ্রাম আসিলেন। সমতল ক্ষেত্রে পৌঁছিতেই উদয়পুর হইতে প্রেরিত দূতগণ আসিয়া মহারাজের চরণ বন্দনা করিয়া নক্ষত্র রায়ের পরলোক-প্রাপ্তি-সংবাদ জানাইল। মহারাজ যখন বুঝিতে পারিলেন যে তাঁহার আগমন প্রতীক্ষায় ত্রিপুরবাসী পথ চাহিয়া আছে তখন তাঁহার দ্বিধা কাটিয়া গেল।
তিনি সসম্মানে অভ্যর্থিত হইয়া স্বদেশ অভিমুখে যাত্রা করিলেন। প্রজাবৎসল গোবিন্দমাণিক্য স্বরাজ্যে ফিরিয়া আসিতেছেন, এ সংবাদে ত্রিপুরাবাসীর আর আনন্দ ধরে না—রঘুপতি যেন বনবাস অন্তে স্বরাজ্যে ফিরিতেছেন। মহারাজের আগমন বার্ত্তায় উদয়পুর আনন্দ মুখরিত হইয়া উঠিল, পুরদ্বারে মহারাজ বিজয়মাল্যে ভূষিত হইলেন, দেবালয়ে মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়া উঠিল। যিনি প্রজার হৃদয়ে পূর্ব্ব হইতেই অভিষিক্ত হইয়া আছেন তাঁহার পুনরভিষেকে সকলেরই মন পুলকে নাচিয়া উঠিল।
নক্ষত্ররায় ছত্রমাণিক্য নাম গ্রহণে রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাই তাঁহার স্মৃতি অধুনালুপ্ত ‘ছত্রসাগর’ নামক দীঘিতে, ও কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী ‘ছত্রের খীল’ ও চান্দিনা থানার অন্তর্গত ‘ছত্রের কোট’ ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার অন্তর্গত ‘ছত্রপুর’ প্রভৃতি গ্রামের নামে অদ্যাপি বর্ত্তমান রহিয়াছে।[১] গোবিন্দমাণিক্য যখন পুনরায় রাজপদে অধিষ্ঠিত হইলেন তখন ছত্রমাণিক্য-তনয় কুমার উৎসব রায় উদয়পুর ত্যাগ করিয়া ঢাকা চলিয়া যান। উদার হৃদয় গোবিন্দমাণিক্য ভ্রাতুষ্পুত্রের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উৎসব রায়কে কাদবা, বেদারা ও আমিনাবাদ এই তিন পরগণা দান করেন।
বর্ত্তমানেও নক্ষত্ররায়ের বংশ ঢাকায় দেখিতে পাওয়া যায়। নক্ষত্ররায়ের ধারাভুক্ত স্বনামপ্রসিদ্ধ শ্রীযুক্ত প্রতাপচন্দ্র রায় মহাশয়ের উল্লেখ এস্থলে অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। ইনি কিছুকাল পূর্ব্বেও শাসন-পরিষদের মেম্বররূপে পোর্টফলিও অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনায় সুনাম অর্জ্জন করেন।
- ↑ কৈলাস সিংহ প্রণীত পুস্তকে এইস্থানগুলির উল্লেখ আছে, রাজমালায় ইহাদের উল্লেখ নাই। সিংহ মহাশয়ের পুস্তকে Tavernier-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত সম্বন্ধে এইরূপ উক্ত হইয়াছে—“টেবার্ণিয়ারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত গ্রন্থে ত্রিপুরেশ্বর মহারাজ ছত্রমাণিক্যের নাম প্রাপ্ত হইয়াছি। টেবার্ণিয়ার বলেন যে মোগল সাম্রাজ্যের পূর্ব্বসীমা আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকান নামক তিনটি স্বতন্ত্র রাজ্যের সহিত সংযুক্ত। টেবার্ণিয়ার স্থানান্তরে লিখিয়াছেন যে ত্রিপুরা রাজ্য হইতে স্বর্ণ ও তসর বাণিজ্যার্থে বিদেশে প্রেরিত হইয়া থাকে। কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্য সমুৎপন্ন স্বর্ণ সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নহে।”—Tavernier’s Travels in India, P. 156.