রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/৮
(৮)
গোবিন্দমাণিক্যের নিকট আওরঙ্গজেবের পত্র
গোবিন্দমাণিক্য সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই সুজাকে বন্দী করিয়া লইবার জন্য দিল্লীর দরবার হইতে নানা তদ্বির আসিতে লাগিল। ভাগ্যহীন সুজা যদি সে রাত্রে পলায়নে সক্ষম হইয়া থাকেন তবে পলায়মান অবস্থায় তাঁহার জীবন কিরূপ দুর্ব্বহ হইয়াছিল তাহা নিম্নোক্ত পত্র হইতে অনায়াসেই অনুমিত হইবে, কারণ দারার ছিন্নমুণ্ডের ন্যায় তাঁহার ছিন্নমুণ্ডের জন্য শাণিত তরবারি লইয়া দিকে দিকে লোক ছুটিয়াছিল। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য দিল্লীর বাদসাহ আওরঙ্গজেব হইতে নিম্নোক্ত পত্র প্রাপ্ত হন। পত্রখানি ফারসী ভাষায় লিখিত।[১]
অদ্বিতীয় উজ্জ্বলমণি-বংশজ বিষমসমরবিজয়ী পঞ্চ শ্রীযুত মহারাজ গোবিন্দকিশোর মাণিক্য বাহাদুর—
জগদীশ্বর আপনার রাজ্যশাসন অক্ষুণ্ণ রাখুন!
আমরা স্পষ্টরূপে জানিতে পারিলাম যে, আমাদের পৈত্রিক শত্রু সুজা গুপ্তভাবে আপনার রাজ্যে অবস্থান করিতেছে। আপনার পূর্ব্বপুরুষগণ সভ্যতা ও স্বীয় ক্ষমতানুসারে আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণের সহিত বন্ধুতা ও একতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া স্বীয় রাজ্যের শাসন কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন, পুরাতনকালে আফগান বংশ আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের মুক্ত কৃপাণ সম্মুখে পলায়ন করতঃ আপনার রাজ্যে উপস্থিত হইয়া বিদ্রোহ-পতাকা উড়াইলে, আপনার পূর্ব্বপুরুষগণ পূর্ব্বোক্ত একতা ও বন্ধুতা বলে ঐ হতভাগ্যগণকে পূর্ব্ব-বাঙ্গলা হইতে পুনরায় সম্পূর্ণরূপে বিপদাপন্ন করতঃ স্বদেশ অভিমুখে বিতাড়িত করিয়াছিলেন।[২]
সুতরাং আশা করি বর্ত্তমানে আমাদের লেখা অনুযায়ী উল্লিখিত শত্রুকে বন্দী করিয়া আমাদের রাজ্যে প্রেরণ করিবেন। যদি মহারাজের অনুমতি হয় তবে আমাদের সৈন্যাধ্যক্ষকে মুঙ্গের জেলাতে উপস্থিত থাকিয়া অপেক্ষা করিবার জন্য নিযুক্ত করিব। অতঃপর তাহাকে ধৃত করিলে বিশেষ যত্ন ও সতর্কতা সহকারে আমাদের সৈন্যাধ্যক্ষের হাওয়ালা (অর্পণ) করিয়া আমাদিগকে সন্তুষ্ট করতঃ পুরাতন জাবেতা অনুযায়ী বন্ধুতার শৃঙ্খল দৃঢ় করিবেন। নতুবা সম্পূর্ণ বিশ্বাস, যদি সেই অপরিণামদর্শী আপনার রাজ্যে অবস্থান করে তবে নিশ্চয়ই রাজ্যের অমঙ্গল ও বিশৃঙ্খলা ঘটিবে সন্দেহ নাই। আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস এই যে পুরাতন বন্ধুতা অনুযায়ী উক্ত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবেন।
আলমগীরসাহ
দিল্লীর সম্রাট্।
গোবিন্দমাণিক্য সবেমাত্র সিংহাসনে বসিয়াছেন, এরই মধ্যে প্রবল পরাক্রম আলমগীর বাদসাহের চিঠিতে তিনি নিশ্চয়ই চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। সুজার নিরুদ্দেশ যাত্রার সংবাদ তিনি সবিশেষ অবগত ছিলেন। সুজা যতকাল ধৃত না হইবে বাদসাহ হয়ত ভাবিবেন ত্রিপুরেশ্বর তাঁহাকে শৈলমালার মধ্যে আশ্রয় দিয়া রাখিয়াছেন। বাদসাহের এই সন্দেহের মূলে রাজত্বের সমূহ অনর্থ ঘটিতে পারে। একবার সুজার চক্রান্তে রাজ্যহারা হইয়াছিলেন, এবার বাদসাহের রোষে পড়িলে কি না ঘটিতে পারে? তাই যশোধরমাণিক্য হইতে হস্তী লইয়া এ যাবৎ দিল্লীর সম্রাটের সহিত যে মন কষাকষি চলিতেছিল এক্ষণে তাহা মানিয়া লইয়া বিরোধের অবসান ঘটাইলেন। স্থির হইল ত্রিপুরেশ্বর দিল্লীর সম্রাটকে বার্ষিক যত হস্তী ধৃত হইবে তাহার অর্দ্ধেক নজরানা স্বরূপ প্রদান করিবেন, তবে পাঁচ হস্তীর কম দিবেন না। এইভাবে গোবিন্দমাণিক্য কিঞ্চিৎ ন্যূনতা স্বীকার করিয়াও বাদসাহকে প্রীত করাইয়া নিজ রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখিলেন।
দিল্লীশ্বরের সহিত প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপন করিলেন বটে কিন্তু সর্ব্বহারা সুজার স্মৃতি গোবিন্দমাণিক্যের চিত্তে নিষ্প্রভ হয় নাই। নিজে সৌভাগ্য-সোপানে আরোহণ করিলেও দুর্ভাগা সুজার স্মৃতি মহারাজের উদার হৃদয় ব্যথিত করিত। রসাঙ্গ বাসের দুঃখের দিনগুলি তাঁহার বিশ্রাম সময়ে কখনও কখনও মনে পড়িত তার মনে পড়িত সুজা যে তাঁহার হাতে হীরকাঙ্গুরীয় পরাইয়া দিয়াছিলেন। সেই করুণ চিত্র তাঁহার প্রাণে অশ্রুময় ঝঙ্কার তুলিত। সুজার দুঃসময়ের দান তিনি আপন অভাব অনটনের মধ্যেও সযত্নে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। এইবাব সেই দানটিকে সুজার স্মৃতি রক্ষার কার্য্যে লাগাইতে ইচ্ছা করিয়া হীরকাঙ্গুরীয় বিক্রয় করাইলেন এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দ্বারা গোমতী নদীর তীরে বৃহৎ “সুজা মসজিদ” নির্ম্মাণ করিলেন। মসজিদের নিকটে সুজাগঞ্জ নামে এক বাজার বসাইলেন, উদ্দেশ্য হয়ত এইরূপ থাকিবে মসজিদের ব্যয়ভার বাজারের আয়ে নির্ব্বাহ হইবে। ‘সুজামসজিদ’ নির্ম্মাণ গোবিন্দমাণিক্যের এক অতুলনীয় কীর্ত্তি; ইহাতে তাঁহার হৃদয়ের পরিচয় লিপিবদ্ধ হইয়া আছে। নিজে হিন্দু রাজা হইয়া অন্য ধর্ম্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, এ গৌরব যেমন ইহার সহিত একদিকে জড়িত রহিয়াছে ইহার অপর দিকে রহিয়াছে সর্ব্বস্বান্ত জনের স্মৃতিরক্ষা এবং তাহাও আবার বিপুল বিক্রম আওরঙ্গজেবের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করিয়া। মসজিদের প্রাত্যহিক নমাজ দ্বারা নিরুদ্দিষ্ট সুজার ইহলোকে বা পরলোকে শান্তি সুখ হওয়ার বিষয় ইতিহাসের আলোচ্য না হইলেও ধর্ম্মবিশ্বাসের প্রতি চক্ষু রাখিয়া একথা অবশ্যই বলিতে হয় গোবিন্দমাণিক্য সুজার একজন অকৃত্রিম বন্ধুর কার্য্যই করিয়া ছিলেন।