রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/১
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
বিজয়মাণিক্য ও দৈত্যনারায়ণ
প্রধান সেনাপতি দৈত্যনারায়ণের হাতেই শাসন ভার আসিয়া পড়িল। দেবমাণিক্যের পুত্র বিজয় তখনও বন্দী অবস্থায় হীরাপুরে ছিলেন, তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ কর্ত্তৃক নীত তাঁহার এই বন্দী দশার কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। দৈত্যনারায়ণ সেনা লইয়া বিজয়কে আনিতে হীরাপুরে গেলেন। বিজয়ের বন্দী দশার অবসান হইল, সেনাপতি সসৈন্যে সামরিক রীতিতে বিজয়কে ত্রিপুরেশ্বররূপে অভিবাদন করিলেন। শুভদিনে রাজধানীতে বিজয়ের পদার্পন হইল, একটা দুঃস্বপ্নের মোহ হইতে যেন ত্রিপুরারাজ্য মুক্ত হইয়া আনন্দে হাসিয়া উঠিল।
ত্রিপুর কুলতিলক বিজয়মাণিক্য ১৫২৮ খৃষ্টাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেন। তাঁহাকে দৈত্যনারায়ণ স্বীয় কন্যা সম্প্রদান করেন। একদিকে প্রধান সেনাপতি অন্যদিকে রাজার শ্বশুর হইয়া দৈত্যনারায়ণের প্রতাপের সীমা রহিল না। ত্রিপুরা রাজ্য তাঁহার হাতের মুঠোর মধ্যে আসিয়া পড়িল। রাজার বয়স অল্প, সুতরাং দৈত্যনারায়ণ একেবারে আকবরের অভিভাবক বৈরাম খাঁ হইয়া বসিলেন। রাজ্যে তাঁহার বিরুদ্ধে কেহ টু শব্দটি করে না!
দৈত্যনারায়ণের কীর্ত্তি উদয়পুরে জগন্নাথ মন্দির নির্ম্মাণ। শ্রীক্ষেত্র হইতে জগন্নাথ সুভদ্রা বলরামের বিগ্রহ শ্রীশ্রীজগন্নাথ স্পর্শ করাইয়া আনা হয় এবং আড়ম্বরের সহিত মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বার মাসে বার ক্রিয়ার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হইল।
বিজয়মাণিক্য ষোড়শ বর্ষে পদার্পণ করিলেন কিন্তু দৈতানারায়ণের হাতের পুতুল হইয়া রহিলেন মাত্র। সৈন্যসামন্তের কুচকাওয়াজ হইতে হাতিশাল, ঘোড়াশাল পর্য্যন্ত দৈত্যনারায়ণের অঙ্গুলি সঙ্কেতে সকলি চলিতে লাগিল, বিজয়মাণিক্য কেবল দর্শক মাত্র, মুখের কথাটি কহিবার যো নাই। দৈত্যনারায়ণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা দুর্ল্লভনারায়ণ জ্যেষ্ঠের বলে বলীয়ান্ হইয়া দৌরাত্ম্য করিতে দ্বিধাবোধ করিত না। ক্রমেই অত্যাচারের মাত্রা চরমে উঠিল। একদিন মাধবতলার হাটে এক দরিদ্রা সুন্দরী নারী শাক বেচিতে বসিয়াছিল, তখন সে পথ দিয়া দুর্ল্লভনারায়ণ দোলায় চড়িয়া যাইতেছিল। রমণীর রূপ দেখিয়া তাহাকে বলপূর্ব্বক ছিনাষ্টয়া লইয়া গেল। রমণীর স্বামী আসিয়া রাজার নিকট কৃতাঞ্জলিপুটে বিচার প্রার্থনা করিল “আপনি ধর্ম্মাবতার, প্রজার মা বাপ, যদি এ অত্যাচারের বিচার না করেন তবে রাজ্যে বাস করিব কিরূপে?” বিজয়মাণিক্য তাহাকে আশ্বাস দিয়া বিদায় করিলেন। তখন মনে মনে ভাবিলেন—ধিক্ আমাকে, আমি ত রাজা নহি! দৈত্যনারায়ণের দৈত্যপণার দর্শক মাত্র, কিন্তু এভাবে আর কত কাল থাকিব? এইরূপ চিন্তা করিয়া দৈত্যনারায়ণের বড় জামাতা মাধবকে ডাকাইলেন।
মাধবের সহিত অনেক গোপন পরামর্শ হইল। মাধব যখন বুঝিতে পারিলেন দৈত্যনারায়ণকে সরান রাজার অভিপ্রেত তখন ভয়ে কাঁচুমাচু করিয়া উঠিলেন। “ইহা কি সম্ভব? যদি আমার ঘরে সেনাপতির মৃত্যু ঘটে তবে আপনার রাণী কি আমাকে রেহাই দিবেন?” তারপর অনেক আলাপের পর স্থির হইল মাধব ভূষণা চলিয়া যাইবেন, সেখানে দৈত্যনারায়ণকে কৌশলে আনিয়া তাহার বধ সাধন করাইতে হইবে। বিজয়মাণিক্য সাবধান করিয়া দিলেন রাজার নামে কেহ ডাকিলেও মাধব যেন উহা বিশ্বাস না করেন, যখন তাঁহার হাতের হীরার অঙ্গুরী লইয়া কেহ যাইবে তখনই মাধব বুঝিবেন ইহা সত্যিকার ডাক, ছল নহে। এই স্থির করিয়া মাধব ভূষণায় গেলেন।
দৈত্যনারায়ণ মাধবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ভূষণায় আসিয়া দেখেন মাধব বড়ই বিমর্ষ। আহার করিয়া সেনাপতি পানে মত্ত হইয়া পড়িলেন তখন তাঁহাকে বধ করা কঠিন হইল না। তারপর ঘরে আগুন ধরাইয়া দেওয়া হইল, উদ্দেশ্য দৈত্যনারায়ণ পুড়িয়া মরিয়াছেন এই প্রচার করা। খবর রাজার নিকট পৌঁছিতেই তিনি সৈন্যসামন্তের শপথ গ্রহণ করিয়া নিজকে প্রধান সেনাপতির স্থলে প্রতিষ্ঠিত করিলেন এবং অল্প কালের মধ্যে অবলীলাক্রমে রাজ্য হাতের মুঠোর মধ্যে আনিয়া প্রবল প্রতাপে রাজদণ্ড ধারণ করিলেন। এদিকে তাঁহার রাণী মাধবের সহিত রাজার ষড়যন্ত্রের ও সাঙ্কেতিক হীরার অঙ্গুরীর কথা গোপনে জানিয়া প্রতিহিংসায় জ্বলিতে লাগিলেন। কিন্তু মাধব আর উদয়পুরের ত্রিসীমানা মাড়ান না। একদিন রাণী দেখেন মহারাজ সেই সাঙ্কেতিক হীরার অঙ্গুরী বিছানার উপরে ফেলিয়া অতি প্রত্যুষে শিকারে বাহির হইয়া গিয়াছেন। এতদিনে সুযোগ মিলিল। রাণী চতুরতা করিয়া হীরার অঙ্গুরীয় লোক মারফৎ পাঠাইয়া দিলেন। মাধব উহা দেখা মাত্রই বুঝিলেন মহারাজ ডাকিয়াছেন, তাই নিঃসন্দেহে উদয়পুরে রাজপুরীতে প্রবেশ করেন। কিন্তু উহা ছিল মৃত্যুর ডাক, প্রাসাদের পথে আসিতেই ঘাতকের হস্তে প্রাণ হারাইলেন!
মৃগয়া হইতে ফিরিয়া আসার পর তিন দিন কাটিয়া গেল, মহারাজ সহসা এই কাহিনী শুনিতে পাইলেন। তাঁহার ক্রোধের সীমা রহিল না। যখন ভাল করিয়া জানিতে পারিলেন ইহা মহাদেবীর কার্য্য তখন রাণীকে নির্জ্জন অরণ্যে নির্ব্বাসনে পাঠাইলেন। পাটরাণীর পদ শূন্য হইল, নূতন পরিণয় দ্বারা তিনি শূন্যস্থান পূরণ করিলেন। শেষে পাত্রমিত্রের অনুরোধে সেই রাণীকে ক্ষমা করিয়াছিলেন।