রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/১১



(১১)

মঘরাজের মুকুট প্রেরণ

 ভীষণ ঝটিকার বেগে বাহিরে কোথাও তিষ্ঠাইতে না পারিয়া কপোত যেমন নিজ নীড়ে ফিরিয়া যায় পরাজিত মঘসৈন্য তেমনি মঘ দুর্গে ফিরিয়া আসিল। মঘরাজ নিরুপায় দেখিয়া সন্ধির প্রার্থনা করিয়া উড়িয়া রাজা নামক স্বীয় দূতকে রাজধরের শিবিরে পাঠাইলেন। উড়িয়া রাজা সন্ধিপত্র করযোড়ে রাজধরের নিকট নিবেদন করিল। রাজধর পত্র পড়িয়া দূতকে এই বলিয়া বিদায় দিলেন, “মহারাজ অমরমাণিক্যের অভিমত জানিয়া মঘরাজকে উত্তর দিব বলিও।” দূত চলিয়া গেল। পত্রে মঘরাজ এক বৎসরের জন্য যুদ্ধ স্থগিত রাখিবার প্রার্থনা জানাইয়াছিলেন।

 তখন দুর্গোৎসবের কাল সমাগত, উদয়পুরে পূজায় ধূমধাম চলিতেছে, পুত্রদের দেখিবার জন্য অমরমাণিক্যের মন ব্যাকুল হওয়া স্বাভাবিক। এমন অবস্থায় আরাকানপতির যুদ্ধ-স্থগিত-প্রার্থনা রাজধরের দূত-হস্তে মহারাজের নিকট আসিয়া পৌঁছিল। মহারাজ সম্মতি জানাইয়া পত্র দিলেন এবং লিখিয়া দিলেন যেন কুমারেরা দুর্গোৎসবের দিনে রাজধানীতে পৌঁছে। রাজধর পত্র পাইয়া মঘরাজকে যুদ্ধবিরতি জানাইয়া দিলেন এবং মঘরাজের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া ভাইদের সহিত উদয়পুরে চলিয়া আসিলেন। কিন্তু এই উদারতা অনুচিত ব্যক্তিতে প্রদর্শিত হইয়াছিল।

 প্রতিমা বিসর্জ্জন হইয়া গেল, দেবী চলিয়া গেলেন। উদয়পুর যেন নষ্টশ্রী হইয়া পড়িল, কি অমঙ্গলের আশঙ্কায় রাজপুরী যেন কাঁপিয়া উঠিতেছিল। এইরূপ জনরব শুনা যাইতে লাগিল মন্দিরে দেবতার চক্ষু ছল ছল করিয়া উঠিতেছে, আকাশ হইতে তারা খসিয়া পড়িতেছে, অকারণে শৃগাল কুকুর রোদন করিতেছে।[] এই অবস্থার মধ্যে চট্টগ্রাম হইতে দুঃসংবাদ আসিল মঘরাজ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া চট্টল অধিকার করিয়াছেন। তখনই দুর্গ তোরণে দামামা বাজিয়া উঠিল, সাজ সাজ রব উঠিল! রাজধর, অমর দুর্লভ ও যুঝা সিংহ স্ব স্ব সৈন্যসহ যাত্রা করিলেন। কনিষ্ঠ কুমার যুঝা যেরূপ ক্রোধী তাহাতে তিনি যুদ্ধে যান ইহা মহারাজের ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু যুঝাকে ঠেকাইয়া রাখা গেল না। রাজধর হইলেন প্রবীণ সেনাপতি, তাঁহার দুই ভাই অধীনে রহিলেন।

 ত্রিপুর সেনা যখন গড়খাই করিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতেছিল তখন মঘরাজ যেন মহাভয় পাইয়াছেন এরূপ ভান করিয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে কিঞ্চিৎ হঠিয়া গেলেন। কুমারদের প্রত্যয় হইল মঘরাজ সত্যই ভয় পাইয়াছেন। মঘরাজ জানিতেন যে তিন ভাইয়ের সৈন্য একত্রিত হইয়াছে বটে কিন্তু ইহাদের মনের সমতা নাই, সকলেই স্ব স্ব প্রধান। তাই তিন ভাইয়ের মধ্যে যাহাতে ভাল করিয়া বিবাদ বাধে সেই উদ্দেশ্যে তিনি রত্নখচিত হস্তিদন্তের একটি রাজমুকুট দূত হস্তে ত্রিপুর শিবিরে পাঠাইয়া দিলেন, তৎসঙ্গে রত্নপেটিকায় একটি

পত্র দিলেন। পত্রে লেখা ছিল মঘরাজ সন্ধির প্রার্থনায় এই পত্র পাঠাইতেছেন, তিনি যে ত্রিপুরেশ্বরের আনুগত্য স্বীকার করিতেছেন তাহার প্রমাণ স্বরূপ নিজ মাথার মুকুট খুলিয়া আরাকান বিজয়ী কুমারের মাথায় ইহা পরাইয়া দিতেছেন।[]

 আরাকানপতির গুপ্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল, দূত হস্ত হইতে পত্র লইয়া যখন রাজধর ইহা পাঠ করিলেন তখন অমর দুর্লভ ও যুঝা সিংহ নিকটে থাকিয়া

বিজয়ী রাজপুত্র বলিয়া সকলেই রাজমুকুট পরিতে চাহিলেন।

ইহার মর্ম্ম অবগত হন। পত্র পাঠের পর যখন রাজমুকুট কুমারদের সম্মুখে বাহির করা হইল তখন ইহার গায়ের বহুমূল্য রত্নগুলি ঝল্‌মল্ করিয়া উঠিয়া এক অপূর্ব্ব দীপ্তি ছড়াইল। ইহাতে কুমারদের চক্ষু ঝল্‌সিয়া গেল, জ্যেষ্ঠ বলিয়া মান্য রহিল না। অমর ও যুঝা সিংহের মধ্যে মুকুট লইয়া কাড়াকড়ি পড়িয়া গেল, বিজয়ী রাজপুত্র বলিয়া সকলেই মুকুট পরিতে চাহিলেন। দূত এই সুযোগে শিবিরের চারিদিক ঘুরিয়া সেনা সংখ্যার পরিমাণ মঘরাজের অভিপ্রায় অনুযায়ী জানিয়া লইয়া বিদায় হইল।

 দূত মুখে কুমারদের বিবাদের সংবাদ এবং ত্রিপুরসৈন্য সংখ্যার পরিমাণ অবগত হইয়া মঘরাজ আর কালবিলম্ব করিলেন না। কুমারদের মধ্যে তিনি বিবাদের বীজ (apple of discord) রোপণ করিয়া বন গহন দিয়া স্বসৈন্য চালনা করিলেন, নিজ নিজ আস্ফালনে মত্ত কুমারদের মুকুটের নেশা তখন টুটিয়া গেল। যখন ভীত সন্ত্রস্ত প্রহরী আসিয়া নিবেদন করিল যে মঘ সৈন্য ত্রিপুর সেনাবাসের অতি সন্নিকটে; চারিদিকে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। যুঝাসিংহ বীরদৰ্পে যুদ্ধ করিতে রওনা হইলেন, তাঁহার বীররস দেখিয়া সকলেই ভয় পাইলেন কিন্তু যুঝাকে বুঝান গেল না। যুঝাকে যখন ছত্র নাজির এইরূপ হঠকারিতা দেখাইতে নিষেধ করিলেন তখন যুঝা বীররসের অভিনয় করিয়া উত্তর দিলেন—ছত্রনাজির যেন স্ত্রীলোকের ন্যায় শঙ্খ বস্ত্র পরিয়া ঘরে চলিয়া যায়।

  1. দৈবতানি রুদন্তীব স্বিদ্যন্তি প্রচলন্তি চ—ভাগবত ১।১৪।২০
  2. এই ঘটনা অবলম্বনে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “মুকুট” নামে নাটিকা রচনা করেন।