রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৭

(৭)

উদয়মাণিক্য ও জয়মাণিক্য

 গৌড়ের অভিযানবার্ত্তা শুনিয়া উদয়মাণিক্য গৌড় সেনার পথরোধ করিবার মানসে খণ্ডলে রণাগণ নারায়ণের অধীনে এক বিপুল ত্রিপুর বাহিনী পাঠাইলেন। প্রধান সেনাপতি রণা খণ্ডলে এক গড়ঘাই করিয়া ত্রিপুর সৈন্যের শিবির স্থাপন করিলেন, তাহাতে ৫২ হাজার সৈন্যের সমাবেশ হইল। রণার অধীনে চন্দ্রদর্প, চন্দ্রসিংহ, উড়িয়া, গজভীম প্রভৃতি অনেক সেনাপতি ছিলেন। সমর সজ্জা যে উৎকৃষ্ট আদর্শের হইয়াছিল তাহা বলাই বাহুল্য কিন্তু অধর্ম্মের মূর্ত্তি উদয়ের মধ্যে লক্ষ্মীর চিহ্ন মাত্রও ছিল না। সুতরাং শ্রীহীন ত্রিপুর সৈন্যের মধ্যে যতই দম্ভ প্রকাশ পাউক না কেন, গৌড়ের আক্রমণ ইহারা প্রতিরোধ করিতে পারিল না। গৌড়সেনা জয়োল্লাসে ত্রিপুর সেনার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, ভীষণ যুদ্ধের পর ত্রিপুর গড় গৌড়ের হস্তগত হইল। মুসলমানদের মাত্র পাঁচ হাজার হত হইল কিন্তু ত্রিপুর সৈন্যের হত সংখ্যা হইয়াছিল চল্লিশ হাজার। নবাব এই সংবাদ শুনিয়া বাছাই বাছাই যোদ্ধা চট্টগ্রাম অধিকারের জন্য পাঠাইয়া দিলেন। পীরোজ খাঁ, জামাল খাঁ প্রভৃতি সদর্পে ত্রিপুর সৈন্য দলনে আসিয়া পড়িলেন। চট্টগ্রামের পথে উড়িয়া নারায়ণ তাহাদিগের গতি রোধ করিলে কামানের গোলায় তাঁহার মৃত্যু ঘটে। চট্টগ্রাম অধিকার লইয়া ভীষণ যুদ্ধ ইহার পর পাঁচ বৎসর চলিয়াছিল।

 এদিকে অত্যাচারী উদয়ের প্রাণ নাশের জন্য ষড়যন্ত্র চলিল, অবশেষে এক দাসীর চক্রান্তে ইঁহার প্রাণবিয়োগ হয়।

 উদয়মাণিক্যের মৃত্যুর পর তৎপুত্র জয়মাণিক্য ১৫৮৩ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। জয়মাণিক্যের কিছুমাত্র বলবীর্য্য ছিল না, তাই গৌড় যুদ্ধ হইতে পিসা রণাকে আনাইলেন। প্রধান সেনাপতি রণার ভয়ে সকলেই থরহরি কম্পমান, দুর্ব্বল জয়মাণিক্য অনায়াসে তাঁহার হাতের মুঠোর ভিতর আসিয়া পড়িলেন। জয়ের নামে রণাই প্রকৃত প্রস্তাবে রাজ্যশাসন করিতেছিলেন। রণা প্রাচীন ছিলেন বলিয়া “বুড়া” নামে আখ্যাত হইতেন, স্বীয় নামে উদয়পুরে এক দীঘি খনন করেন, ইহা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের উত্তর দিকে অবস্থিত। এই দীঘি উৎসর্গের পর রণার রাজ্যলালসা ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। জয়মাণিক্যকে সরাইয়া নিজের রাজমুকুট পরিবার সাধ হইল কিন্তু তাঁহার পত্নী দুই হাতে এই কুপ্রবৃত্তিকে রোধ করিতে লাগিলেন। রণা বেগতিক দেখিয়া বুড়া বয়সে আবার দার পরিগ্রহ করিলেন এবং নূতন স্ত্রীর সহিত রাজ্যলাভের নানা যুক্তি ফাঁদিতে লাগিলেন। হায় তৃষ্ণা, ইহা বুড়াশরীরেও তরুণ থাকিয়া যায়! রণা রাজস্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকিতেন। জয়মাণিক্যকে সরান যে কঠিন হইবে না ইহা বেশ বুঝিতেন কিন্তু সিংহাসনের প্রধান কণ্টক ছিলেন অমর। রণার চক্ষু তাঁহার উপর পড়িল।

 অমর দেবমাণিক্যের সন্তান। একদা দেবমাণিক্য বজরায় ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলেন, চট্টগ্রামের পথে এক হাজরার সুন্দরী কন্যা দেখিয়া মোহিত হন, সেই হাজরা ছিলেন ফৌজদার। দেবমাণিক্যের নিকট কন্যার বিবাহ প্রস্তাব শুনিয়া তিনি সম্মত হন। সেই পরিণয়ের ফলে অমরের জন্ম হয়। সুতরাং অমর বিজয়মাণিক্যের ভ্রাতা। অমর প্রাপ্তবয়স হইয়া সেনাদলে প্রবেশ করেন এবং ক্রমে সেনাপতির পদে উন্নীত হন। গৌড়সৈন্যের সহিত যুদ্ধে অমরের কৃতিত্ব রণার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অমর দেখিতেছিলেন তাঁহার পিতৃসিংহাসন কিরূপে সেনাপতির হাতে চলিয়া গিয়াছে, কিরূপে পৈত্রিক অধিকার ফিরিয়া পাওয়া যায় তজ্জন্য ভিতরে ভিতরে তীব্র ভাব পোষণ করিতেন। রণা সিংহাসনের পথ নিষ্কণ্টক করিতে যাইয়া জয়মাণিক্য হইতে অমরকেই প্রথমে সরান কর্ত্তব্য মনে করিলেন।

 যে সময়ে অমর কল্‌মিগড়ের সেনানায়ক ছিলেন তখন সহসা একদিন রাজ-আহ্বান আসিয়া উপস্থিত—অমরকে রাজধানী আসিতে হইবে। অমর গড় ছাড়িয়া উদয়পুর আসিয়া পৌঁছিলেন। তোরণ দ্বারে পৌঁছিতেই তিনি জয়মাল্যে ভূষিত হইলেন এবং প্রধান সেনাপতির গৃহে ভোজনের আমন্ত্রণ পাইলেন। অমর ত অবাক! এত সম্মানের কারণ কি? ভিতরে ভিতরে তাঁহার একটু সন্দেহ হইল। যখন রণার গৃহে আসিলেন তখন দেখিলেন সেখানেও সম্মানের চূড়ান্ত হইল। তাঁহাকে
অমর বুঝিতে পারিলেন বোঁটার ন্যায় তাঁহার গলা দেহ হইতে পৃথক করিবার
জন্য আয়োজন হইয়াছে।
বুঝাইয়া দেওয়া হইল তাঁহার বীরত্বে রণা মুগ্ধ হইয়াছেন ভোজন কক্ষে ঢুকিয়া যখন আহারে বসিবেন এমন সময় দূরে তাঁহার এক প্রিয় সখাকে দেখিতে পাইলেন। সখা অমরকে অঙ্গুলি দ্বারা “সাবধান” এইরূপ সঙ্কেত করিয়া একটি পানের বোঁটা পান হইতে খসাইয়া ফেলিলেন। অমর বুঝিতে পারিলেন বোঁটার ন্যায় তাঁহার গলা দেহ হইতে পৃথক করিবার জন্য আয়োজন হইয়াছে। অমর শিহরিয়া উঠিলেন, কিন্তু বিপদে সাহস হারাইলেন না। রণার নিকট কহিয়া উঠিলেন—“আমার সহসা বাহ্যের বেগ হইয়াছে, পায়খানায় এক্ষুণি যাওয়া দরকার।” ব্যস্ত সমস্ত হইয়া রণা অমরকে পায়খানা দেখাইবার জন্য লোক সঙ্গে দিলেন। অমর পায়খানার পথে দেওয়াল টপ্‌কাইয়া কখন যে প্রস্থান করিলেন, সেবক জানিতে পারিল না। ভোজনশালায় রণা পার্শ্বচর সহ অমরের প্রতীক্ষায় রহিলেন।

 ওদিকে অমর ঘোড়াশালে অলক্ষিতে ঢুকিয়া ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া নিজ গড়ে পৌঁছিলেন। নিজের সৈন্যের নিকট ষড়যন্ত্রের কথা ব্যক্ত করিয়া পিতৃসিংহাসনের তিনিই যে ন্যায্য উত্তরাধিকারী তাহা মুক্তকণ্ঠে ঘোযণা করিলেন। সৈন্যগণ তাঁহার নিকট শপথ গ্রহণ করিল, এতদিনে অমরের ছদ্মবেশ খসিয়া পড়িল। সিংহাসন অধিকারের জন্য অমর বন্ধুগণ সহ উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। রণার ভাই ছিলেন সমরজিৎ নারায়ণ। সমরজিৎ রণার দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। যখন রণা অমরের পলায়ন কাহিনী ও যুদ্ধ সজ্জার বিষয় জানিলেন তখন নিজ দুর্গে তিনিও প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। ভ্রাতা সমরজিৎকে তিনি আসন্ন বিপদের কথা জানাইয়া তাঁহার সহিত অবিলম্বে সাক্ষাৎ করিবার জন্য এক গুপ্ত পত্র দিলেন। অমরের গুপ্তচর চারিদিকে ছড়ান ছিল, রণার পত্র-বাহক গুপ্তচরের হাত এড়াইতে পারিলনা। অমর তখন নদীতীরে চৌহাট্টা দুর্গে যুদ্ধের আয়োজন করিতে ছিলেন এমন সময় পত্রসহ ধৃত পত্রবাহককে তাঁহার নিকট আনা হয়।

 অমর রণার পত্র পড়িয়া দেখিলেন মস্ত সুযোগ উপস্থিত। পত্রবাহককে বন্দী করিয়া তাঁহার একজন সুদক্ষ সেনাপতিকে ঐ ভৃত্যের পোষাক পরাইয়া দিলেন, কুর্ত্তার ভিতরে খুরধার অস্ত্র লুকান রহিল। ভৃত্যবেশী সেনাপতি সমরজিৎ-ভবনে রণার পত্রের কথা জানাইল। সমরজিৎ তখন বাহিরের ঘরে বসিয়াছিলেন, পত্রবাহক হইতে পত্র লইয়া সমরজিৎ দেখিলেন রণার হাতের লেখা, পত্রখানি মাথায় ঠেকাইয়া পত্র পাঠে মন দিলেন। সেই সুযোগে সেনাপতি সমরজিতের গলা কাটিয়া ফেলিল। সমরজিতের মৃত্যু চক্ষের পলকে হইয়া গেল, বাহিরের লোক বড় একটা জানিতে পারিল না। সমরজিতের ছিন্ন মুণ্ড নানা কৌশলে রণার দুর্গে নিক্ষেপ করা হয়। যখন রণা ভ্রাতার ছিন্নমুণ্ড দেখিতে পাইলেন তখন বুঝিতে পারিলেন ইহা অমরের কার্য্য। ভ্রাতাকে নিহত দেখিয়া তিনি মনে করিলেন অমর ইতিমধ্যে তাঁহার ভ্রাতার দুর্গ অধিকার করিয়াছেন নতুবা ভাই মরিল কি করিয়া? সমরজিতের মৃত্যুতে তাঁহার ডান হাত খসিয়া পড়িল।

দেখিতে দেখিতে বর্ষার দুর্ব্বার ধারার ন্যায় অমরের সৈন্যগণে চতুর্দ্দিক ছাইয়া গেল। নিরুপায় দেখিয়া রণা রজনী যোগে পলায়ন করিলেন, প্রাণভয়ে এক জলাশয়ে ডুবিয়া রহিলেন কিন্তু অচিরেই ধরা পড়িলেন। অমরের আদেশে তাঁহার মাথা কাটিয়া ফেলা হয়। রণা অমরকে সরাইতে চাহিয়া নিজেই সরিয়া যাইতে বাধ্য হইলেন। ভীরু জয়মাণিক্য রণার মৃত্যুতে বুঝিলেন যে তাঁহার দিনও ফুরাইয়াছে তাই পলায়নের পথ খুঁজিলেন। সত্যই তাঁহার পরমায়ু ফুরাইয়াছিল, মল্লশালায় তাঁহার মৃত্যু ঘটিল। জয়মাণিক্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুর সিংহাসনে ক্রমওয়েল যুগ বা সেনাপতির অধিকার ফুরাইয়া গেল। ত্রিপুরা রাজ্য হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল।