রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৮

(৮)

অমরসাগর খননে অমরমাণিক্য

 ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে শুভদিনে অমরমাণিক্যের রাজ্যাভিষেক হইয়া গেল। এই বীরপুরুষের বাহুবলে বংশের নষ্ট-গৌরব পুনরায় ফিরিয়া আসিল, শুধু এই কারণেই তাঁহার নাম ইতিহাসে অক্ষয় হইয়া থাকিবে। তিনি বয়স্ক হইয়া রাজপদে সমাসীন হন—তাঁহার চারিপুত্র সকলেই নারায়ণ উপাধিতে ভূষিত হইয়াছিলেন। ইহাদের নাম রাজদুর্লভ, রাজধর, অমর দুর্লভ ও যুঝা সিংহ বীর। তাঁহার রাজ্যলাভ স্মরণীয় করিবার জন্য তিনি ‘অমরসাগর’ খনন করান। আজিও রাজসিংহের রাজসমুদ্রবৎ ‘অমরসাগর’ তাঁহার কীর্ত্তি ঘোষণা করিতেছে। ইহা উদয়পুরে অবস্থিত। অমরপুরেও ইঁহার নামে এক সাগর আছে। উদয়পুরের পূর্ব্বদিকে পাঁচ ক্রোশ ব্যবধানে তাঁহার প্রতিষ্ঠিত ‘অমরপুর’ অদ্যাপি তাঁহার কীর্ত্তি ঘোষণা করিতেছে। সেখানে অমরমাণিক্য নির্ম্মিত ত্রিতল প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ এখনও বিদ্যমান্। অমরসাগর খনন উদ্দেশ্যে তাঁহার অধীনস্থ জমিদারবৃন্দকে লোক পাঠাইবার জন্য আমন্ত্রণ দেওয়া হয়। শুভদিনে দীঘির খনন কার্য্য আরম্ভ হয়। মহারাজের কৌতূহল হইল কোন্‌ জমিদার কিরূপ লোক দিয়াছেন। ইহা জানিতে চাহিলে সুবুদ্ধিনারায়ণ তাঁহাকে এইরূপ বলেন—“বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায় দিয়াছেন ৭০০, বাকলার বসু ৭০০, গোয়ালপাড়ার গাজি ৭০০, ভাওয়াল জমিদার ১০০০, বানিয়াচঙ্গ হইতে ৫০০, সরাইলের ঈশা খাঁ ১০০০, ভুলুয়া হইতে ১০০০, ইহাদের মধ্যে কেহ ভয়ে কেহ বা প্রীতির সহিত এ লোক সংখ্যা পাঠাইয়াছেন কিন্তু শ্রীহট্টের তরপ হইতে কোন উত্তরই পাওয়া যায় নাই।”

 এই কথায় তরপের উপর মহারাজের ক্রোধ হইল, রাজাদেশ অমান্য হইয়াছে বলিয়া ইহার জমিদারকে শিক্ষা দিবার জন্য কুমার রাজধর ২২,০০০ সৈন্য লইয়া যাত্রা করিলেন। ত্রিপুর সৈন্যের আগমনে জমিদার তরপ ছাড়িয়া শ্রীহট্টের পাঠান শাসনকর্ত্তা ফতে খাঁর আশ্রয় লইল। এই সংবাদে অমরমাণিক্য স্বয়ং যুদ্ধযাত্রা করেন। কথিত আছে যে যুদ্ধক্ষেত্রে অমরমাণিক্য গরুড়ব্যূহ রচনা করেন। পুরোভাগে দুই সেনাপতি হইল গরুড়ের চঞ্চু, উভয় পার্শ্বস্থ সেনা হইল গরুড়পক্ষ আর হস্তী অশ্ব রহিল ভিতরে, তাহা যেন গরুড়ের উদর। বিশাল গজারূঢ় হইয়া অমর ব্যূহের পৃষ্ঠদেশে রহিলেন। যুদ্ধে ফতে খাঁ হারিয়া গেলেন, পাঠানের হাত হইতে শ্রীহট্ট খসিয়া পড়িল। ত্রিপুরার বিজয়কেতন শ্রীহট্টে উড়িল। কুমার রাজধর ফতে খাঁকে লইয়া উদয়পুর পৌঁছেন। ফতে খাঁর প্রতি অমরমাণিক্য অত্যন্ত সহৃদয় ব্যবহার করেন, নানা উপহার দিয়া তাঁহাকে বিদায় করা হয়।

 তৎপর ভুলুয়া বিগ্রহ উপস্থিত হয়।[১] ১৫৭৪ খৃষ্টাব্দে মহারাজ বিজয়মাণিক্য ভুলুয়া অধিকার করেন। কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর পর যখন উদয় সিংহাসন অধিকার করেন তখন ভুলুয়ার শাসনকর্ত্তা উদয়কে রাজা মানিতে অস্বীকার করে, সেই হইতে ভুলুয়া ত্রিপুরা রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। যখন অমরমাণিক্য ভুলুয়া বশে আনিতে চাহিলেন তখন ভুলুয়াপতি অমরকে নীচপদ হইতে রাজপদে উন্নীত বলিয়া অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। ইহাতে অমরমাণিক্যের রোষানল জ্বলিয়া উঠিল। ভুলুয়া জয়ে মহারাজ স্বয়ং চারি কুমার ও ৩৬ হাজার সৈন্যসহ যাত্রা করেন। ভুলুয়া জয়ে বেগ পাইতে হয় নাই কিন্তু ঐ যুদ্ধে ভ্রমক্রমে ব্রাহ্মণ বধ হওয়ায় অমরমাণিক্য যার পর নাই ব্যথিত হন এবং তজ্জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেন। ভুলুয়া জয়ের পর মহারাজ বাকলা আক্রমণ করেন। সে সময় বাকলা চন্দ্রদ্বীপ ঐশ্বর্য্যশালী রাজ্য ছিল, সেই যুদ্ধে বাকলাধিপতি কন্দর্পরায় নিহত হন। বাকলা জয়ে অমরমাণিক্যের ধনাগার সমৃদ্ধ হয়।

 ইতিমধ্যে অমরসাগর খনন কার্য্য সমাধা হয়। শুভদিনে মহারাজ অমর-সাগর পারে বসিয়া ব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণযোগে অমরসাগর উৎসর্গ করেন। তখন ভূম্যাদি ষোড়শ দান অনুষ্ঠিত হয়। তারপর প্রস্তরের এক মনোহর মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া তাহাতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই উপলক্ষে নৃত্য গীতে রাজধানী মুখরিত হইয়াছিল, মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে মহারাজ তাম্রশাসন দ্বারা চতুর্দ্দশ গ্রাম উৎসর্গ করেন, উহা বর্ত্তমানে চৌদ্দগ্রাম পরগণায় পরিগণিত হইয়াছে। বার মাসে তের পর্ব্ব উৎসব চলিতে লাগিল—উৎসবে ব্রাহ্মণ-ভোজনের বিপুল আয়োজন হইত। এই ভাবে পূজা পার্ব্বণে ষোড়শ দানে ও তুলাপুরুষে তাঁহার নির্ম্মল যশঃ দিগন্তে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। এইরূপ কথিত হইয়া থাকে যে তাঁহার সভাগৃহে দুই শত ব্রাহ্মণ সমবেত থাকিতেন, মহারাজ অমরমাণিক্য বিক্রমাদিত্যের ন্যায় ইঁহাদের সহিত শাস্ত্রালোচনায় প্রবৃত্ত হইতেন।

  1. সংস্কৃত রাজমালা পাঠে জানা যায় ৬১০ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ প্রায় ৭০০ বৎসর পূর্ব্বে গৌড়ের প্রাতঃস্মরণীয় নরপতি আদিশূরের বংশধর রাজা বিশ্বম্ভর শূর পোতারোহণে চন্দ্রনাথে আসিতে চেষ্টা করিয়া নাবিকগণের দিক্‌ভ্রমে নোয়াখালি জিলার ভুলুয়া গ্রামে (ভুল হুয়া হইতে ভুলুয়া নাম হইয়াছে) উপনীত হইয়াছিলেন।—স্বর্গীয় হরকিশোর অধিকারী সম্পাদিত ‘চিত্রে চন্দ্রনাথ’ ৮ পৃঃ।