রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৯
(৯)
অমরমাণিক্যের সেনাপতি ইষা খাঁ
অমরমাণিক্য ধর্ম্মকর্ম্মে তৎপর হইয়া সুখে দিন কাটাইতে লাগিলেন কিন্তু রাজাদের ভাগ্য প্রজার ভাগ্যের সহিত জড়িত, তাই ধর্ম্মকার্য্য লইয়া নিরবচ্ছিন্ন শান্তিভোগ ঘটিয়া উঠে না। আবার এক উৎপাত দেখা দিল। বাঙ্গলার শাসনকর্ত্তা ইসলাম খাঁ ঢাকা নগরীতে নিজ রাজপাট স্থাপন করিয়া ত্রিপুরা রাজ্যের দিকে লুব্ধ দৃষ্টি করিতেছিলেন। বিজয়মাণিক্যের সময় সোণার গাঁ হইতে পাঠান বিতাড়িত হয়, সেই সূত্রে ত্রিপুরার উপর ক্রোধ রহিয়াছিল। ইস্লাম খাঁ সঙ্কল্প করিলেন ত্রিপুরা রাজ্য জয় করিতে হইবে, তাই সহসা অভিযান প্রেরণ করিলেন। বিদ্যুৎবেগে এই সংবাদ ত্রিপুরা রাজ্যে ছড়াইয়া পড়িল, তখন ঘরে ঘরে সাজ সাজ রব উঠিল!
সে সময়ে ইষা খাঁ ছিলেন অমরমাণিক্যের একজন প্রধান সেনাপতি। ইষা খাঁর উপর মহারাজ যুদ্ধের ভার অর্পণ করিলেন। ইষা খাঁ বিপুল সেনা লইয়া যুদ্ধযাত্রা করিলেন। সরাইলের নিকট গড়খাই করিয়া শত্রুপক্ষের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। এদিকে ইস্লাম খাঁর সৈন্য ঐপথে আসামাত্রই ইষা খাঁ বার হাজার অশ্বারোহী ও অল্প পদাতি লইয়া শত্রুর গতিরোধ করিলেন, বাকী সৈন্য গড়ে রহিয়া গেল! ইষা খাঁর আক্রমণের ক্ষিপ্রতায় শত্রুসৈন্য ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল, তাহারা পুনঃ জমাট বাঁধিবার পূর্ব্বেই ইষা খাঁর প্রবল চাপে পলায়ন করিতে বাধ্য হইল। বিপদের মেঘ কাটিয়া গেল, ইষা খাঁ লব্ধকীর্ত্তি লইয়া সগৌরবে রাজধানীতে ফিরিলেন। মহারাজ অত্যন্ত প্রীত হইয়া ইষা খাঁর উপর রাজসম্মান বর্ষণ করিলেন।
অমরমাণিক্যের ভাগ্যে আবার হরিষে বিষাদ ঘটিল। ভুলুয়া জয়ের পর যুবরাজ রাজদুর্লভ সেখানে ত্রিপুর সেনার ছাউনিতে বাস করিতেছিলেন। সে স্থান সমুদ্রের সন্নিকট, লোনা জলে তাঁহার অসুখ করিল—ক্রমে ব্যাধি দুরারোগ্য হইয়া যুবরাজের জীবনান্ত ঘটাইল। পুত্রশোকে অমরমাণিক্য অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িলেন। চিত্তবিনোদনের জন্য মহারাজ শিকারে বাহির হন। কৈলাগড় (কসবা) পথে অমরমাণিক্য যাত্রা করেন, তৎপরে জলপথে সেনাপতিসহ দাউদপুর ঘাটে আসিয়া উপনীত হন। সেখানকার জমিদার যেখানে মহারাজের অভ্যর্থনা করেন তাহা ‘মিলন ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তিতাস পার হইয়া মহারাজ সরাইল গমন করেন। কিছুদিন পূর্ব্বে ইষা খাঁ সেখানে গড়খাই প্রস্তুত করিয়াছিলেন। তখন সরাইলে গভীর অরণ্য। সুতরাং শিকারের সুবিধা হইয়াছিল। সরাইলের দক্ষিণে জঙ্গল কাটাইয়া কুমার রাজধরের উৎসাহে বেয়াল্লিশ নামক নগর বসান হয়, বর্ত্তমানেও সরাইল পরগণার দক্ষিণাংশ “তপে বেয়াল্লিশ” নামে পরিচিত।
এই সময়ে রাজধরের পুত্র যশোধর জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহার জন্মপত্রিকায় ছেদ যোগ থাকায়, কাণ নাকের কিঞ্চিৎ ছেদন করা হয় যেন দোষ কাটিয়া যায়। ইহার একবৎসর পরে কৈলাগড়ে মহামাণিক্যের দ্বিতীয় পুত্র গগনের ধারায় কল্যাণের (মাণিক্য) জন্ম হয়। কল্যাণের জন্মপত্রিকা দৃষ্টে ইহা বুঝা গিয়াছিল যে এই শিশু কালে অসামান্য তেজস্বী হইবেন।