রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ/১০

(১০)

ধন্যমাণিক্য ও হোসেন শাহ

 কুকি রাজ্য জয়ে ত্রিপুরার পূর্ব্ব সীমা ব্রহ্মদেশ অবধি পৌঁছিয়াছিল। সুতরাং চট্টগ্রামের উপর ত্রিপুরেশ্বরের ক্ষমতা যাহাতে না বাড়িতে পারে তৎপ্রতি একদিকে গৌড়ের নবাব হোসেনশাহ ও অন্যদিকে আরাকানপতি মেং তীব্র দৃষ্টি রাখিয়াছিলেন। শীঘ্রই চট্টগ্রামের প্রাধান্য লইয়া যুদ্ধ বাঁধিল, মঘসৈন্য ও নবাবের সৈন্যে রণক্ষেত্র ছাইয়া গেল কিন্তু হনুমানধ্বজ রায় কাচাগের আগমনে হিন্দুর জয় হইল। রায় কাচাগের প্রবল পরাক্রমের নিকট পরাজিত হইয়া নবাবের যে ফৌজ স্থায়ীভাবে চট্টলে থাকিত তাহারা কিল্লা ভাঙ্গিয়া গৌড়ে চলিয়া গেল। চট্টলে হিন্দু রাজার কেতন উড়িল।

 চট্টল অধিকার করায় গৌড়ের নবাব ত্রিপুরা জয়ের সঙ্কল্প করিলেন। রায় কাচাগের জয়যাত্রায় ত্রিপুরা ক্রমেই গৌড়ের প্রতিপক্ষরূপে ঠেকিতে লাগিল। নবাব বিপুল সৈন্যবাহিনী সাজাইয়া গৌর মল্লিকের অধীনে এক অভিযান পাঠাইলেন। কুমিল্লাতে নবাব সেনার সহিত প্রথম সংঙ্ঘর্ষ হয়। যাহাতে মল্লিক আর কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে যাইতে না পারেন তজ্জন্য ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। কুকি রাজ্য জয়ে রায় কাচাগের মাথায় যে অদ্ভুত কৌশল খেলিয়াছিল, এখানেও তাহার কম হইল না। কুমিল্লায় নবাব সৈন্যের শিবির খাটান হইল, দেশের অবস্থা মল্লিকের জানা ছিল না, তাই যুদ্ধের চাতুরী বুঝিয়া উঠেন নাই। কুমিল্লার উজানে সোণামুড়ার পাদদেশে গোমতী বাঁধ দেওয়া হইয়াছিল, তিন দিন জল আটক রাখা হয়। তৃতীয় দিন রাত্রিকালে সহসা বাঁধ ভাঙ্গিয়া দেওয়ায় আচম্বিতে জল আসিয়া রণক্ষেত্র ভাসাইয়া ফেলিল, পাঠানেরা হাহাকার করিয়া উঠিল একেবারে সাঁতার জল। চণ্ডিগড়ে পূর্ব্বেই ত্রিপুর সৈন্য ওৎ পাতিয়া বসিয়াছিল, তাহারা সেই অবস্থায় পাঠানের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িক, ফলে গৌর মল্লিক কোনও রূপে শায়েস্তা খাঁর ন্যায় প্রাণ লইয়। পলাইলেন বটে কিন্তু তাঁহার পাঠান সৈন্যের মধ্যে কে বাঁচিল জানিবারও অবকাশ হইল না।

 গৌড়ের নবাব যখন এই পরাজয় কাহিনী শুনিতে পাইলেন, তাঁহার ক্রোধের সীমা রহিল না। হোসেন শাহ সেনাপতিদের নিয়া অনেক পরামর্শ করিলেন। তখন স্থির হইল হৈতন খাঁর অধীনে পরাজয়ের প্রতিশোধ লইবার জন্য, অভিযান যাত্রা করিবে। তাহাই হইল। গৌর মল্লিকের অপযশ হইল, তাই তাহার আর ডাক পড়িল না—এবার হৈতন খাঁর পালা। হৈতন সেনাপতিত্ব পদে বৃত হইয়া কাযটিকে খুব কঠিন মনে করিলেন না। তিনি গৌর মল্লিকের সহিত পরামর্শ আঁটিয়া দেশের হালচাল বুঝিতে পারিতেন কিন্তু গৌর মল্লিকের অভিজ্ঞতার সন্ধান লইলেন না। আফজল খাঁ যেমন পূর্ব্ব প্রসঙ্গ বিস্মৃত হইয়া নিঃসঙ্কোচে বলিয়াছিলেন শিবাজীকে বাঁধিয়া আনিবেন, হৈতন খাঁও তেমনি বীরদর্পে মেদিনী কম্পিত করিয়া ত্রিপুরনাথকে শিক্ষা দিতে চলিলেন।

 এবারের আক্রমণ পূর্ব্বের ন্যায় কুমিল্লা অঞ্চলে হয় নাই। হৈতন খাঁ কুমিল্লার পথ ছাড়িয়া কৈলাগড় পথে অগ্রসর হইলেন। কৈলাগড় বর্ত্তমান কসবা। কসবা হইতে এক মাইল পশ্চিম দক্ষিণ দিকে বিজয় নদীর তীরে হৈতন খাঁ নিজ শিবির রচনা করেন। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ পার্শ্বে পরিখা বা গড়খাই কাটা হইয়াছিল। ঐ চিহ্ন অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে। সেনাবাস রক্ষার জন্য বিজয়নদীর তীরে মাটির প্রাচীর তোলা হয়। কুমিল্লা হইতে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অভিমুখে যে রাস্তা গিয়াছে তাহা এই পরিখা ভেদ করিয়া গিয়াছে। মেবার আক্রমণ উপলক্ষ্যে আকবর যেখানে সেনাবাস রচনা করিয়াছিলেন, সেই স্থানটিকে এখনও দেখিলে চিনা যায়, উহা ‘আকবর কা দিয়া’ (দেওয়াল) নামে প্রসিদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। তেমনি কসবার সন্নিকটস্থ গড়-খাইকে হোসেন-সাহ-কা-দিয়া বলা যাইতে পারে।

 কৈলাগড় অঞ্চলে ত্রিপুর সৈন্যের সহিত হৈতন খাঁর যুদ্ধ হয়। হৈতনের ধারণা হইল ত্রিপুরায় আর কত সৈন্য থাকিবে, যুদ্ধে ইহারা নিঃশেষ হইয়া যাইবে। যুদ্ধে ত্রিপুরসৈন্যের পরাজয় হইতে লাগিল, হৈতন খাঁ খড়্গরায় প্রভৃতিকে যুদ্ধে হঠাইয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন, ক্রমে শুগড়িয়া গড়ে আসিয়া পৌঁছিলেন। সেখানে গগন সেনাপতিকে হারাইয়া উদয়পুর অভিমুখে গৌড় সৈন্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। গঙ্গানগর পার হইয়া পথে শিবির রচনা হইল, পাছে গোমতীর জল বিষাক্ত হয় সেই ভয়ে এক দীঘি খনন করা হয়। হৈতন খাঁর সঙ্গে নানা শ্রেণীয় কারিগর মিস্ত্রীর অভাব ছিল না। গোমতীর এক বাঁক দেখিয়া হৈতনের বেশ পছন্দ হইল, স্থানটি দুর্গ নির্ম্মাণের পক্ষে উপযোগী বোধ করিয়া সেখানে গড় নির্ম্মাণের আদেশ দিলেন। কারিগর মিস্ত্রীরা কাযে লাগিয়া গেল। ঠিক ঐ স্থানের উজানেই ত্রিপুরার গড় পর্ব্বতের চূড়ায় রহিয়াছে। মহারাজ ধন্যমাণিক্য ঐ গড় হইতে পাঠানের দুর্গ নির্ম্মাণ লক্ষ্য করিতে লাগিলেন।

 ত্রিপুরার স্বাধীনতা সঙ্কটাপন্ন, মহারাজ ধন্যমাণিক্য সেনাপতিদের লইয়া মন্ত্রণায় বসিলেন। এই জাতীয় সঙ্কট কালে ত্রিপুরার এক যুবতী তাঁহার ডাকিনী বিদ্যার শক্তিতে অলৌকিক ক্রিয়া দ্বারা গোমতীকে উজানে স্তম্ভিত করিয়া ফেলেন বলিয়া উল্লেখ পাওয়া যায়। ইহার নাম বলাগমা। ফরাসী যুদ্ধের সময় যেমন Maid of Orleans এর আবির্ভাব দেখা যায়, এও তেমনি ইতিহাসের এক আশ্চর্য্য ব্যাপার! বলাগমার প্রভাবে গোমতী উজানে আটক পড়িল, সুতরাং ভাটিতে বেশ চড়া পড়িয়া গেল। গৌড় সৈন্য আনন্দিত হইয়া কহিয়া উঠিল—হোসেন সাহের ভাগ্যে নদী চর দিয়াছে। তাহারা শত্রুপক্ষীয়ের কৌশল না বুঝিয়া বালুর উপরে নিজেদের ছাউনি খাটাইয়া ফেলিল। হৈতন খাঁ পূর্ব্ব-ইতিহাসের খোঁজ রাখিতেন না বলিয়াই এরূপ প্রমাদে পড়িয়াছিলেন।

 এদিকে উজানে নদী ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, এই সময়ের মধ্যে ত্রিপুর সৈন্যেরা অগণিত ভেলা তৈরী করিয়া ফেলিল। সন্ধ্যা হইতেই ঐ ভেলার উপর সারি সারি ত্রিপুর সৈন্য বসিয়া গেল, প্রত্যেক ভেলায় বড় বড় মশাল। রণসজ্জায় রাত দুপুর হইয় গেল। তারপর যখন নদীর বাঁধ খুলিয়া দেওয়া হইল তখন জলের কি শব্দ। ভেলাগুলি পর পর তীরের বেগে ছুটিয়া চলিল, যেন দৌড়ের নৌকা ছুটিয়াছে। নদীর দুইপাশে জমাট আঁধার।

 এ দিকে গৌড়সৈন্য সুখে নিদ্রা যাইতেছিল, কি অবস্থার মধ্যে তাহারা জাগিল তাহা সহজেই অনুমেয়। কথায় বলে ডাঙ্গায় বাঘ জলে কুমীর, এখানেও তাহাই হইল। বিপদের উপরে বিপদ। জলে তাহারা ভাসিল, রাশি রাশি ভেলার উপর হইতে অস্ত্র বর্ষণ চলিল, তাহাদের পিছনে যে বনে আশ্রয় মিলিবার 


জলে তাহারা ভাসিল, ভেলার উপর হইতে অস্ত্র বর্ষণ
চলিল……দাবানল জ্বলিয়া উঠিল।

কথা সেখানে দাউ দাউ করিয়া দাবানল জ্বলিয়া উঠিল, ত্রিপুর সৈন্যেরা সেখানে আগুন ধরাইয়া দিয়াছিল। হৈতন খাঁ কোনওরূপে প্রাণ লইয়া শুগড়িয়া গড়ে আসিয়া পৌঁছিলেন।

 গৌর মল্লিকের মত তাঁহারও সৈন্যদের মধ্যে কে বাঁচিয়া আছে খবর লইবার সুযোগ হইল না। শুগড়িয়া দুর্গে তিনি হতভম্ব অবস্থায় মাথায় হাত দিয়া বসিলেন। ওঃ, বড়ই ভুল হইয়াছে, ত্রিপুরা জয় করিতে বহু সৈন্যের প্রয়োজন, অল্প সৈন্যে অভিযান চালান বেকুবের কায! যখন গৌড়ে পৌঁছিয়া হোসেন শাহের নিকট পরাজয় বার্ত্তা কহিয়া আরও সৈন্যের জন্য আবেদন জানাইলেন তখন নবাব বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে পদচ্যুত করেন।