রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ/৯
(৯)
কুকিরাজ্য জয়
ধন্যমাণিক্য নিজের মনের মত করিয়া ত্রিপুর সেনা গঠন করিলেন, গৌড়ের সেনার মত সমর কৌশল শিক্ষা দিয়া ইহাদিগকে যুদ্ধে একরূপ অপরাজেয় করিয়া তুলিলেন। প্রধান সেনাপতি হইলেন ‘রায় কাচাগ’। এই সময়ে ত্রিপুরার পূর্ব্বদিকে গভীর অরণ্যে এক শ্বেতহস্তী দেখা যায়। থানাসী নগরের কুকি নরপতি ইহাকে আটক করিয়াছেন এই সংবাদ হেড়ম্ব রাজের নিকট পৌঁছে। হেড়ম্বরাজ ঐ হাতী পাইবার জন্য অভিযান পাঠাইলেন কিন্তু দুর্ভেদ্য কুকিদুর্গ জয় করিতে না পারিয়া হেড়ম্বসৈন্য ফিরিরা গেল। তখন ধন্যমাণিক্য ঐ কুকি অঞ্চল জয়ে শ্বেতহস্তী পাইবার জন্য প্রধান সেনাপতি রায় কাচাগকে থানাসী নগরে পাঠাইলেন। আটমাস যাবৎ লড়াই চলিল কিন্তু থানাসী দুর্গ জয় হইল না। তখন কুকিরা গড়ের উপরে উঠিয়া ত্রিপুর সৈন্যকে পা দেখাইয়া বিদ্রূপ করিতে লাগিল। ইহাতে রায় কাচাগের ক্রোধের সীমা রহিল না। ত্রিপুর সেনারা যে ছাউনিতে বাস করিত, তাহার উপরের চালা ফেলিয়া দিলেন যেন বৃষ্টির জলে ভিজিয়া ইহারা যুদ্ধে জিতিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। সৈন্যেরা প্রাণপণ করিল কিন্তু গড় অতিক্রম করিতে পারিল না।
এই সময় এক আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটিল। ত্রিপুর সেনাবাসের কাছে এক অতিকায় গোসাপ দেখা গেল—উহা লম্বায় আট এবং পাশে তিন হাত। রায় কাচাগের মাথায় এক ফন্দী আসিল, তিনি ঐ গোসাপের কোমরে এক লম্বা বেত বাঁধিয়া থানাসী গড়ের নীচে ছাড়িয়া দিলেন। তখন রাত্রি হইয়াছে গাছের নীচে জমাট আঁধার। থানাসীগড় এত খাড়া যে একমাত্র সর্পজাতীয়ই ইহার উপরে উঠিতে পারে। নীচে তাড়া খাইয়া গোসাপ গড় বাহিয়া উপরে উঠিতে লাগিল, রায় কাচাগ ঐ বেত আকড়াইয়া অন্ধকারের মধ্যে দুর্গের চূড়ায় আসিয়া পড়িলেন তাঁহার পেছনে পেছনে পিল পিল করিয়া সৈন্যের সারি উঠিতে লাগিল। কয়েকজন আসিয়া পড়িবার পর তাহারা বড় দড়ি ফেলিয়া দিল, তখন সিঁড়ি পাইয়া পিঁপড়ার স্রোতের ন্যায় বাকী সৈন্য উপরে উঠিল।
এ দিকে দুর্দ্ধর্ষ কুকি সৈন্যেরা প্রমোদে গা ঢালিয়া দিয়া ছিল—মদের নেশায় একেবারে চূর। দুর্গের গা ঘেষিয়া যে ত্রিপুর সৈন্য উঠিতেছে এবং তাহাদের ঢাল তলোয়ারে ঘষা খাইয়া যে শব্দ হইতেছিল তাহার আওয়াজ মাতাল সেনাদের কানে মাঝে মাঝে বাতাসে আনিতেছিল। মদের নেশা মাঝে মাঝে টুটিতেছিল—আরে শোন্, ঐ যেন ঢালের আওয়াজ পাইতেছি, এরা আবার উপরে উঠিয়া না আসে! অন্য কুকি তাহাকে আর একটু মদ ঢালিয়া দিয়া কহিল—দূর বোকা, তাও কি কখনো হয়, এসব গবয়ের কাণ্ড, দুর্গের গায়ে এরা শিং ঘষিতেছে! যাক্ এই ভাবে তারা মদে যতই অচেতন হইল, ত্রিপুর সেনারা সেই সুযোগে দুর্গের উপর ততই নিজের রণসজ্জা সমাপন করিল। শেষ রাত্রিতে সহসা রণ দামামা বাজিয়া উঠিল, থানাসী সেনা হুড়মুড় করিয়া উঠিয়া পড়িল। কিন্তু কাহার সঙ্গে লড়িবে? যমতুল্য রায় কাচাগ সম্মুখে—পেছনে ত্রিপুর বাহিনী। চক্ষের নিমিষে রক্তনদী বহিয়া গেল, সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে থানাসী কুকিরাষ্ট্রের উপর ত্রিপুর বৈজয়ন্তী উড়িল।
ধন্যমাণিক্যের দৃষ্টি বঙ্গদেশের উপর পড়িল। নিজ রাজধানী উদয়পুরের নিকটবর্ত্তী মেহেরকুল, পাটীকারা, গঙ্গামণ্ডল, বগাসার, বেজুরা ভানুগাছ, বিষ্ণুজুড়ী, লঙ্গলা প্রভৃতি দেশ হেলায় জয় করিয়া ফেলিলেন। বরদাখাত জমিদার প্রতাপ, গৌড়ের সম্বন্ধ ছাড়িয়া ত্রিপুরেশ্বরের সহিত যোগ দিলেন। কেবল মাত্র খণ্ডলই বিরুদ্ধাচরণ করিতে লাগিল। ত্রিপুরেশ্বর এক সেনাপতির অধীনে সৈন্য দিয়া খণ্ডল অবরোধ করিলেন। খণ্ডলের লোকেরা কৌশলে সেনাপতিকে ধরিয়া ফেলিয়া গৌড়ের নবাবের দরবারে ইঁহাকে পাঠাইয়া দেয়। গৌড়ের অধিকার খর্ব্ব করায় নবাব পূর্ব্ব হইতেই ত্রিপুরার প্রতি বিরক্ত ছিলেন, তাই সেনাপতিকে হস্তী দিয়া পিষিতে হুকুম দিলেন। সেই সেনাপতি অদ্ভুত বীরত্ব দেখাইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। ত্রিপুরেশ্বর এই সংবাদ শুনিয়া রায় কাচাগকে খণ্ডল দলনে পাঠাইলেন। রায় কাচাগের নামে সকলই থরহরি কম্পমান, কে আর যুদ্ধ করে? খণ্ডল বশ মানিল। খণ্ডলের বারজন ভূঁয়াকে রাজ-দরবারে পাঠান হয়, খণ্ডলে ভিতরে ভিতরে গৌড়ের সহিত ষড়যন্ত্র চলিতেছিল। সন্দেহের ফলে দরবারে ইহাদের মাথা কাটিয়া ফেলা হয়, গৌড়ে হাতীর পেষণে সেনাপতির মৃত্যুর এইরূপে প্রতিশোধ লওয়া হয়। ইহার পরে খণ্ডল আর টুঁ শব্দও করে নাই।