রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ/৮

(৮)

সেনাপতি বধ

 শুভদিনে ১৪৬৪ খৃষ্টাব্দে ধন্যমাণিক্যের অভিষেক হইয়া গেল। প্রধান সেনাপতির কন্যা কমলা দেবীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। এই কমলা দেবীর নামেই সুবিখ্যাত কমলাসাগর খনন হয়, কসবা মার মন্দিরের নিম্নে কমলাসাগর আজও স্বর্গ শোভায় ঝল্‌মল্ করিতেছে। কমলাদেবী যেন সাক্ষাৎ কমলাই ছিলেন, তাই তাঁহার কীর্ত্তি শত শত বৎসর ব্যাপিয়া অম্লান রহিয়াছে।

 ধন্যমাণিক্যের শাসন কাল ঘটনা বহুল, রাজা হইয়া অবধি সেনাপতিগণের কড়া শাসনের মধ্যে তাঁহার দিন চলিতে লাগিল। কোথায় তিনি তাহাদিগকে শাসন করিবেন, না তাহারাই তাঁহাকে শাসন করিতে লাগিলেন। জুলিয়স সিজরের মৃত্যুর পর রোমের ইতিহাসে যেরূপ সেনাতন্ত্র প্রবল হইয়াছিল এও সেইরূপ। মহারাজ ত অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন। এদিকে সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত তাঁহার উপরে তেমনি স্নেহ বিস্তার করিতেছিলেন। একদিন নৃপতি বলিলেন, “প্রভো! এরা আমাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে, মুক্তির উপায় কি? আমি একা, আর এরা পঞ্চাশ হাজার সৈন্য বাঁটিয়া লইয়াছে।” পুরোহিত উপদেশ দিলেন, “দেখ মহারাজ, কথা ঠিক বলিয়াছ, রাজার পক্ষে ডর ভাল নয়, রাজা যদি ভয়ে কাঁচু মাচু হয় তবে রাজ্যের অমঙ্গল অনিবার্য্য। এই রক্তশোষা সেনাপতির দল হইয়াছে রাজ্যের ব্যাধিস্বরূপ, হয় এদিগকে তাড়াও নতুবা শমন ভবনে পাঠাও, এরা থাকিতে রাজ্যের মঙ্গল নাই।”

 তখন গুরু শিষ্যে মিলিয়া মুক্তির উপায় স্থির হইল এদের বধ করা। রাজা অন্তঃপুরে রাণীরও অদর্শন হইয়া থাকিবেন, বাহিরে ঘোষণা হইবে যে রাজা অসুস্থ, কেবল পুরোহিত রাজার সাক্ষাতে থাকিবেন। অবসর সময়ে রাজা মল্লবিদ্যা শিখিবেন। যেমন পরামর্শ তেমনি কায। বাহিরে রাজার অসুখ প্রচার হইয়া গেল, এই ভাবে তিন মাস কাটিয়া গেল। একদিন প্রধান সেনাপতি রাণীর নিকটে রাজার অবস্থা জানিতে চাহিলেন। রাণী কহিলেন, “রাজাকে ত দেখিতে পাই না, অন্ধকারে থাকেন। একদিন অন্ধকারে দেখিলাম রাজার বৃহৎ শরীর হইয়াছে।” সেনাপতি শুনিয়া বুঝিলেন তাহা হইলে ত রাজার পাণ্ডুরোগ হইয়াছে, বড় কষ্ট ভোগ কপালে আছে।

 এই ভাবে কিছু কাল গেল। কিছু দিন পরে সেনাপতিগণ রাজাকে দেখিতে চাহিলেন। পুরোহিত বলিলেন, তোমরা কাল আসিও, দেখা হইবে। এদিকে যুক্তি করিয়া ত্রিশ চল্লিশ জন সেনাকে রাজার ঘরে অন্ধকারে লুকাইয়া রাখা হইল, তাহাদের হাতে রহিল চোখা তলোয়ার। পরদিন সন্ধ্যার সময় দশ সেনাপতি রাজাকে দেখিতে আসিল, বাহিরের ঘরে ঢাল তলোয়ার রাখিয়া সেনাপতিরা নগ্নপদে অন্তঃপুরে চলিয়া আসিল, পুরোহিত পথ দেখাইয়া আনিলেন। ঘর অন্ধকার, তাহারা ঢুকিয়া দেখিলেন রাজাকে ঈষৎ দেখা যাইতেছে। জাজিমের উপর বসিয়া আছেন—বিপুল দেহ। তখন দশ
মহারাজ জাজিমের উপর বসিয়াছিলেন……ইহারা সাষ্টাঙ্গে মাটিতে পড়িয়া প্রণাম করিল…ঘাতক এই সুযোগে সকলের শির টুকরা করিয়া ফেলিল।
সেনাপতি গড় করিয়া মাটিতে পড়িয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিল, সেই মুহূর্ত্তে সঙ্কেত পাইয়া ৩০।৪০ জন সিপাহী সেনাপতিদের একেবারে টুকরা করিয়া ফেলিল। এই ভাবে বিপক্ষ দলন করিয়া রাজার বন্দীদশা ঘুচিল। পরদিন রাজ্যময় ঘোষণা হইল রাজার অসুখ সারিয়া গিয়াছে—রাজা হস্তিপৃষ্ঠে রাজ্যময় বেড়াইয়া আসিলেন।