রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ/২

(২)

ত্রিপুররাজ ও গৌড়ের নবাব

 সিংহতুঙ্গ যখন ত্রিপুর সিংহাসনে উপবিষ্ট তখন মুসলমান আমল আরম্ভ হইয়াছে। উত্তর ভারতে মুসলমান শক্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, হিন্দুর স্বাধীনতা-সূর্য্য প্রায় ডুবু ডুবু। বাঙ্গালার রাজা লক্ষ্মণসেনের পরাজয়ে বাঙ্গালা দেশ মুসলমানের হাতে চলিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে গৌড়ে নবাবী আমল সুরু হইল। সেই সময় হীরাবন্ত খাঁ নামে জনৈক ধনবান্ জমিদার ত্রিপুরেশ্বরের অধিকার সান্নিধ্যে বাস করিতেন। হীরাবন্ত গৌড়ের নবাব হইতে মেহেরকুলের[] সনদ পাইয়া কর্ত্তৃত্ব করিতেন এবং নবাবকে সেজন্য করের পরিবর্ত্তে এক নৌকা বহু মূল্য দ্রব্য উপহার দিতেন। ত্রিপুররাজ এই কথা জানিতে পারিলেন এবং যখন বুঝিতে পারিলেন এই সব মূল্যবান্ ধনরত্ন ত্রিপুরা রাজ্য হইতেই সংগ্রহ করিয়া নবাবকে নজর পাঠান হইতেছে, তখন তাঁহার বড়ই ক্রোধ হইল। হীরাবন্ত ত্রিপুরেশ্বরকে অবজ্ঞা দ্বারা এই ক্রোধ আরও বাড়াইলেন। তখন একদিন সহসা ত্রিপুর সৈন্য মেহেরকুল আক্রমণ করিয়া ইহার সর্ব্বস্ব লুটিয়া লইল। হীরাবন্ত এইরূপে পরাস্ত হইয়া গৌড়ের নবাবের নিকট ধন্না দিয়া পড়িলেন। হীরাবন্ত নৌকা বোঝাই রত্ন দিয়া নবাবকে খুসী করিয়াছিলেন, এখন সে রত্ন ত্রিপুর-রাজ নিজভাণ্ডারে লইয়া আসিলেন। হীরাবন্ত বুঝাইলেন নবাবের রাজস্বের উপর ত্রিপুরেশ্বরের লোভ হেতু ত্রিপুরা রাজ্য শীঘ্রই আক্রমণ করা উচিত।

 নবাব সম্মত হইলেন। ত্রিপুররাজের সহিত প্রবল প্রতাপ গৌড়ের নবাবের যুদ্ধ বাঁধিয়া গেল। যখন নবাবের প্রায় ২।৩ লক্ষ্য সৈন্য আসিয়া ত্রিপুর সীমান্তে হানা দিল তখন ত্রিপুররাজ ভয় পাইলেন। তিনি অন্য উপায় না দেখিয়া সন্ধির পরামর্শ করিতে লাগিলেন। রাজার এই ভীরুতার কথা রাজরাণীর কাণে গেল। মহাদেবী ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন—“হে নরনাথ, তুমি একি কথা কহিতেছ? পূর্ব্বপুরুষের কীর্ত্তি লোপ করিতে চাও? ছি! ছি! যদি নবাবের সৈন্য দেখিয়া ভয় পাঠয়া থাক তবে অন্তঃপুরে আরামে বাস কর, আমি রণে ঝাঁপাইয়া পড়ি।” এই বলিয়া রাণী দামামা বাজাইলেন, সৈন্যেরা সব সারি দিয়া দাঁড়াইল। “কি বল ত্রিপুর সৈন্যগণ, তোমরা কি যুদ্ধ চাও, না চাও না? তোমাদের রাজা সিংহের কুলে শৃগাল হইয়া জন্মিয়াছে। ভয়ে ঘরের কোণে লুকাইয়া থাকিতে চায়। রাজা ভয়ে ভীত হউক আমি ভয় করি না। কুলের মান রাখিতে আমি যুদ্ধে যাইব। তোমাদের প্রাণে যদি তিল মাত্র বল থাকে তবে আমার সঙ্গে চল।” রাণীর বচনে সৈন্যদের হৃদয়ে বল বাড়িল। সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, “আমরা ভয় করি না মা,—আমরা ভয় করিনা, তুমি মা হইয়া যদি যুদ্ধে চল আমরা সন্তান হইয়া তোমার পেছনে যাইব।”

 রাণীর আনন্দের সীমা রহিল না। রণরঙ্গিনী মূর্ত্তিতে তিনি ভয়ভৈরবী মূর্ত্তি ধরিলেন। যুদ্ধে[] যাইবার পূর্ব্বদিন তিনি
রাণী রণরঙ্গিনী মূর্ত্তিতে হস্তিপৃষ্ঠে অগণন সৈন্য সহ যুদ্ধ যাত্রা করিলেন।


অন্নপূর্ণা হইয়া সকল সৈন্যকে তৃপ্তিমত ভোজন করাইলেন। পরদিন দেশের স্বাধীনতার জন্য হস্তিপৃষ্ঠে চড়িয়া অগণন সৈন্যসহ যুদ্ধ যাত্রা করিলেন। তালে তালে রণ দামামা বাজিতে লাগিল, ত্রিপুরা রাজ্যের সে এক দিন! ত্রিপুরেশ্বর এই সব দেখিয়া কি ভাবে বসিয়া থাকেন, তিনিও সৈন্যের সহিত যোগ দিলেন।

 অতঃপর দুই সৈন্যের ভেট হইল, মহাযুদ্ধ বাঁধিয়া গেল। ত্রিপুর কুললক্ষ্মী যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছেন, কুলদেবতা চৌদ্দদেবতার আশীর্ব্বাদ বর্ষণ হইল। গৌড়ের সৈন্য ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িতে লাগিল। এমন সময় ত্রিপুররাজ আকাশে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখিলেন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়, ধূসর আকাশে এক নরমুণ্ড নাচিতেছে। মহারাজ দেখিলেন, সৈন্যেরাও দেখিল—দেখিয়া সকলে ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। মহারাজ অমঙ্গল আশঙ্কায় রামকৃষ্ণ নারায়ণ স্মরণ করিলেন। এইরূপ প্রবাদ আছে যে লক্ষ্য সৈন্য হত হইলে আকাশে নরমুণ্ড ধেই ধেই করিয়া নৃত্য করে। তখন মহারাজ বুঝিলেন এই যুদ্ধে লক্ষ লোক হত হইয়াছে। রণশ্রান্ত হইয়া তিনি বসিতে চাহিলে তাঁহার জামাতা আসন না পাইয়া মৃত হস্তীর দাঁত তুলিয়া আনিয়া বসিতে দিলেন। এদিকে সন্ধ্যা হইয়া গেল, গৌড়ের সৈন্য রণে ভঙ্গ দিয়া যে যার পথ দেখিল। ত্রিপুরেশ্বরের বিজয় কেতন উড়িল। রাণী জয়মাল্য পরিয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে স্বদেশে ফিরিলেন। হীরাবন্তের অধিকৃত মেহেরকুল ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত হইল, অদ্যাবধি এই স্থান ত্রিপুরার রাজ্যভুক্ত রহিয়াছে। ভারত  ইতিহাসে এই রাণীর আসন গড়মণ্ডলের রাণী দুর্গাবতী, ঝানসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ এবং চাঁদ সুলতানার সমান।

  1. মেহেরকুল পরবর্ত্তী কালে একটী পরগণায় পরিগণিত হয়, কমলাঙ্ক বা কুমিল্লা ইহারই অন্তর্গত।
  2. The women……in daring and moral prowess remind one of the females in Rajputana or of the Maharatta Country. —Rev. Long—Asiatic Society Journal.
     উক্ত রাণীর তরবারি আজও আগরতলায় দেবালয়ে পূজিত হইতেছে।