রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ/১
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
মঘরাজ ও রাঙ্গামাটি জয়
হেড়ম্বরাজের সহিত সঙ্ঘর্ষের ফলে প্রতীত শ্যাম্বলে রাজপাট ত্যাগ করিলেন, তিনি আরও দক্ষিণে সরিয়া আসেন। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে এই পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল তখন মহারাজ প্রতীত প্রবঙ্গ বা ত্রিপুরায় প্রতিষ্ঠিত হন।[১] কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এই সময়েই ত্রিপুরাব্দের প্রচলন হয়, মহারাজ প্রতীতের সময় হইতেই ত্রিপুররাজ কপিল প্রদেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক ত্রিপুরায় আসিয়া অধিষ্ঠিত হন। সেই সময় হইতে বর্ত্তমান পর্য্যন্ত ১৩৫০ বৎসর অতীত হইয়াছে। মহারাজ প্রতীতের অধস্তন নবম পুরুষ কিরীট বা আদিধর্ম্ম ফা যজ্ঞোপলক্ষে মিথিলা দেশীয় ব্রাহ্মণগণকে তাম্রশাসন দ্বারা ভূমি দান করেন, ইহা ৫১ ত্রিপুরাব্দে অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং ইহা ১৩০০ বৎসর পূর্ব্বে ত্রিপুরাব্দের সাক্ষ্য দিতেছে।
প্রতীতের পর তৎপুত্র মরীচি রাজা হন, মরীচির পর তৎপুত্র গগন, গগনের পর তৎপুত্র নবরায় রাজপদে অভিষিক্ত হন। নবরায়ের পর তৎপুত্র হামতরফা বা যুঝার রাজা হন। সুতরাং হামতরফা প্রতীতের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ।
এতকালের মধ্যে মহারাজ দ্রুহ্যুর বংশে এইরূপ অ-সংস্কৃত নাম পাওয়া যায় নাই। ইহার কারণ কি? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, ত্রিপুর রাজবংশের আর্য্যভাগ শেষ হইয়া বুঝি অনার্য্য ভাগ সুরু হইল। কিন্তু কারণ অনুসন্ধান করিলে এইরূপ আশঙ্কা দূর হইবে।
যুঝার প্রসিদ্ধ কীর্ত্তি রাঙ্গামাটি জয়। তিনি ত্রিপুর সৈন্যকে উচ্চশ্রেণীর সামরিক শিক্ষা দিয়া দেশ জয়ে প্রবৃত্ত হন। রাঙ্গামাটি তখন প্রবল পরাক্রান্ত মঘদের দ্বারা অধিকৃত। প্রাচীন ভূগোল আলোচনায় বুঝা যায় রাঙ্গামাটি বলিতে তখন ত্রিপুরার দক্ষিণাংশ, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের পশ্চিমাংশ বুঝাইত, এই অংশে এখনও মঘ বসতি আছে এবং চট্টগ্রামে এখনও রাঙ্গামাটি প্রসিদ্ধ স্থান। মহারাজ যুঝার কালে রাঙ্গামাটির আয়তন ত্রিপুরা পর্য্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। এই মঘরাজত্বে মঘদের বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল।
মঘরাজ যখন শুনিলেন ত্রিপুরেশ্বর অভিযান প্রেরণ করিবেন তখন তিনি কৌশল করিয়া এক তুষেরদুর্গ নির্ম্মাণ করেন, উদ্দেশ্য যতুগৃহ দাহ করা কিনা সঠিক বুঝা যায় না। বাহিরে এরূপ প্রচার করা হয় তুষ মাড়ান সিপাহী সৈন্যের পক্ষে অমঙ্গলজনক। কিন্তু ত্রিপুর সৈন্যকে তুষ আটক রাখিতে পারিল না। ত্রিপুর সৈন্যের হুঙ্কারে তুষের ন্যায় মঘ সৈন্য ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল, মঘরাজ যুদ্ধে হারিয়া গেলেন।
তখন কিরাত জয় করিয়া যেমন তাঁহার পূর্ব্বপুরুষ ত্রিবেণীতে রাজপাট স্থাপন করেন তেমনি যুঝা মঘদেশ জয় করিয়া রাঙ্গামাটিতে স্বীয় রাজপাঠ প্রতিষ্ঠিত করেন, এই সময় হইতেই উদয়পুর অঞ্চলে রাজধানী স্থাপিত হয়, পরে উদয় মাণিক্য ইহার নামকরণ করেন।
রাঙ্গামাটিতে ত্রিপুররাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়া কালক্রমে সুদূর ব্রহ্মদেশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। মঘদের সহিত রাজা প্রজা সম্বন্ধ হওয়ায় ত্রিপুরনৃপতি মঘদিগকে কৌশলে প্রীত রাখিবার জন্য নিজ নামের সহিত ফা উপাধি জুড়িয়া দিলেন এবং নিজ নামেরও মঘ সংস্করণ প্রচার করিলেন। সেই হইতে ত্রিপুর ইতিহাসে দ্রুহ্যু বংশীয়ের অসংস্কৃত নামের ধারা দেখিতে পাওয়া যায়। ফা অর্থে পিতা।[২] বর্ত্তমান সুপ্রসিদ্ধ চন্দ্রনাথ তীর্থের সহিত ত্রিপুররাজগণের বংশপরম্পরা সম্বন্ধ দ্বারা চট্টগ্রাম অবধি রাজত্বের প্রসার সহজেই অনুমান করা যায়। রাঙ্গামাটি জয় দ্বারা বিজেতা ত্রিপুররাজ এই ভূভাগের ফা বা পিতা রূপে পরিণত হইলেন। যুঝা নামটি যোদ্ধার অপভ্রংশ।
যুঝার ঊনবিংশ পুরুষ পরে সিংহতুঙ্গ রাজপদে অধিষ্ঠিত হন, এই সময়ের মধ্যে ত্রিপুর রাজত্বে উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা পাওয়া যায় না। এ সময়ের মধ্যে ভারতের ভাগ্য-বিপর্য্যয় ঘটিয়াছিল, হিন্দুর হাত হইতে শাসন দণ্ড কাড়িয়া লইয়া মুসলমান শক্তি ভারতে সর্ব্বেসর্ব্বা হইয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং ত্রিপুরনৃপতিগণের স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন সমস্যা হইয়া দাঁড়াইল!
- ↑ প্রবঙ্গ — (মার্ক ৫৭।৪৩, বামন ১৩।৪৪, মৎস্য ১১৩।৪৪) ত্রিপুরার কিয়দংশ—বিশ্বকোষ।
- ↑ ফা শব্দ অনার্য্য ভাষা সমুদ্ভূত বলিয়া কথিত হয়। কেহ কেহ বলেন—শ্যানদেশীয় ও ব্রহ্মদেশীয় নরপতিগণ “ফ্রা” উপাধিধারণ করিতেন। ফ্রা হইতে ফার উদ্ভব। ফ্রা প্রভুত্ববাচক, ফা অর্থে পিতা। আসামের অজহাম নৃপতিগণও ফা উপাধি ধারণ করিতেন। কিন্তু ত্রৈপুর রাজবংশীয়গণ তৎপূর্ব্ব হইতেই এই উপাধি ধারণ করিয়া আসিতেছেন।
—শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।