রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/১৩

(১৩)

দ্রুহ্যুবংশীয়ের স্থানান্তর গমনের সময় নির্দ্ধারণ

 এইখানে ত্রিপুরা রাজ্যের সংস্থান ও সন তারিখ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাইবে।

 দ্রুহ্যুর ত্রিবেগে কপিল নদীর তীরে রাজ্যসংস্থানের কথা বলা হইয়াছে। সেখানকার রাজত্ব সম্বন্ধে উল্লেখ সুপ্রসিদ্ধ ভবিষ্যপুরাণে পাওয়া যায়।

 ঋষিগণ দ্বাপরে যে সমস্ত নৃপতি ভারতবর্ষে বর্ত্তমান তাঁহাদের বিষয় জানিতে চাহিলে সূত বর্ণনা করিলেন—সেই সময়ে অষ্টাদশ রাজ্যের নাম আমার নিকট হইতে শ্রবণ কর। পশ্চিমে সিন্ধুনদের তীরে, দক্ষিণে সেতুবন্ধে, উত্তরে বদরী স্থানে, পূর্ব্বে কপিল তীরে অষ্টাদশ রাজ্য ছিল। এই সমস্ত রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থ, পাঞ্চাল, কুরুক্ষেত্র, কাপিল ইত্যাদি

অষ্টাদশৈব রাষ্ট্রানি তেষাং মধ্যে বভূবিরে।
ইন্দ্রপ্রস্থঞ্চ পাঞ্চালং কুরুক্ষেত্রঞ্চ কাপিলম্॥

 শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্দ্ধানের সঙ্গে সঙ্গেই দ্বাপর শেষ ও কলিযুগ আরম্ভ হয়। সুতরাং ত্রিলোচন যখন রাজসূয়যজ্ঞে উপস্থিত হন তখন দ্বাপরযুগ, সেই দ্বাপরযুগে কপিল নদীর তীরে যে দ্রুহ্যুবংশীয়েরা রাজত্ব করিতেন ইহার সমর্থন ভবিষ্যপুরাণ হইতে পাওয়া যাইতেছে।

 ভবিষ্যপুরাণে ভোজরাজের মৃত্যুকালে ভারতবর্ষের অবস্থা সম্বন্ধে আর একটি উল্লেখ আছে। ভোজরাজের কাল আধুনিক ৮৪০ খৃষ্টাব্দ হইতে ৮৯০ খৃষ্টাব্দ। ইহার পরবর্ত্তীকালে অনঙ্গপাল জয়চন্দ্রের আবির্ভাব হয়, তাহাদের উল্লেখও ভবিষ্যপুরাণে পাওয়া যায়। কান্যকুব্জাধিপতি জয়চন্দ্রের সময়েই ভারতে মুসলমান অধিকার ঘটে। সেই সময়েও যে দ্রুহ্যুবংশীয়রা রাজত্ব করিতেছিলেন ইহার উল্লেখ ভবিষ্যপুরাণে রহিয়াছে এবং দ্বাপরযুগবৎ গোব্রাহ্মণহিতৈষী ছিলেন ইহাও বুঝিতে পারা যায়

স্বর্গতে ভোজরাজেতু………………
………কান্যকুব্জে জয়চন্দ্রোমহীপতিঃ।
ইন্দ্রপ্রস্থেঽনঙ্গপাল স্তোমরান্বয়সম্ভবঃ॥
পূর্ব্বে তু কপিলস্থানে………
অগ্নিহোত্রস্য কর্ত্তারঃ গোব্রাহ্মণহিতৈষিণঃ
বভূবুর্দ্বাপরসমা ধর্ম্মকৃত্যবিশারদাঃ।

 দ্বাপরের কপিলরাজ্যের অস্তিত্ব খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতেও পাওয়া যাইতেছে। ‘কপিলস্থানে’ প্রয়োগ দ্বারা বুঝা যায় পূর্ব্বের ন্যায় ‘কপিলান্তিকে’ বা ঠিক কপিলনদীর তীরে না থাকিলেও বহুস্থানবিপর্য্যয়েও কপিলস্মৃতি তাহাদের সহিত জড়িত রহিয়াছে। এইরূপে আমরা মহারাজ পরীক্ষিতের সময় হইতে কান্যকুব্জের জয়চন্দ্রপর্য্যন্ত দ্রুহ্যুবংশীয়রাজ্যের একটি অবিচ্ছিন্ন ধারা পাইতেছি।

 পূর্ব্বে বলা হইয়াছে দ্রুহ্যুবংশীয়দের রাজপাট কপিল নদীর তীরে কিরাত দেশে স্থাপিত হয়। বামন পুরাণে ভারতের পূর্ব্বসীমায় কিরাতদিগের উল্লেখ পাওয়া যায়:—

 “পূর্ব্বে কিরাত যস্যান্তে পশ্চিমে যবনা স্মৃতাঃ।” কিন্তু ভবিষ্যপুরাণে ভারতের পূর্ব্বসীমায় ‘কপিলরাজ্যের’ই উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। ইহাতে কিরাত স্থানেই যে কপিল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহাই বুঝিতে পারা যায়।

 কালনির্ণয়প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের মত ও কল্যব্দের উল্লেখ পূর্ব্বে করা হইয়াছে। মৎস্যপুরাণের মতে পরীক্ষিতের জন্ম হইতে নন্দের অভিষেক পর্য্যন্ত কালের পরিমাণ এক সহস্র পঞ্চাশ বৎসর। নন্দ অনুমান ৩৭২ খৃঃ পূর্ব্বে রাজ্য লাভ করেন (V. A. Smith—Early History of India, (3rd Edition)। এই ৩৭২ বৎসর ১০৫০ বৎসরের সহিত যোগ করিলে ১৪২২ বৎসর হয়। ইহা হইতে পরীক্ষিতের রাজ্যারম্ভের পূর্ব্ববর্ত্তী ২০ বৎসর বাদ দিলে কলির আরম্ভ ১৪০২ খৃষ্ট পূর্ব্বাব্দে ধরিতে হয়।

 শ্রীমদ্ভাগবতে মৎস্যপুরাণোক্ত শ্লোকটি কিঞ্চিৎ রূপান্তরিত দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাতে পরীক্ষিতের জন্ম হইতে নন্দাভিষেকের সময় ১০৫০ বৎসরের পরিবর্ত্তে ১০১৫ বৎসর হইবে। “বর্ষসহস্রন্তু জ্ঞেয়ং পঞ্চদশোত্তরং”। তাহাতে কলির আরম্ভসময় আরও ৩৫ বৎসর কম হইয়া পড়ে অর্থাৎ ১৪০২ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দ স্থলে ১৩৬৭ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দ হয়। ত্রিলোচন যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক, ইহার প্রমাণ পূর্ব্বে পাওয়া গিয়াছে। ত্রিলোচন দৈত্য হইতে তৃতীয় পুরুষ। ত্রিলোচনের সময় যদি ভাগবতোক্ত সময় মতে ১৩৬৭ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দই হয় তবে ইহার সহিত তিন পুরুষে ১০০ শত বৎসর ধরিয়া, উহা যোগ করিলে ত্রিবেগে উপনিবেশের সময় ১৪৬৭ খৃষ্টপূর্ব্বাব্দেই সিদ্ধান্ত করিতে হয়।

 নিম্নে দ্রুহ্যুবংশীয়দের রাজত্বের একটি আনুমানিক তালিকা দেওয়া গেল, ইহা দ্বারা সময়ের একটি ক্ষীণ আভাষ জাগিবার সুবিধা হইবে।

  স্থান সময় পুরুষ সংখ্যা মন্তব্য
১। ত্রিবেগে রাজত্ব ১৪৬৭ খৃ: পূ: – ১৩০০ খৃ: পূ: ৪ পুরুষ দাক্ষিণেরও কিছু সময়
২। থলংমাতে রাজত্ব ১৩০০ খৃ: পূ: – ১৫০ খৃ: পূ:
(৪ পুরুষে শতাব্দী ধরিয়া কয়েকটি দীর্ঘরাজত্বের জন্য ১৫০ বৎসর অতিরিক্ত)
৫২ পুরুষ বিমার পর্য্যন্ত
৩। শ্যাম্বলে রাজত্ব ১৫০ খৃ: পূ: – ৫৯০ খৃষ্টাব্দ ১৩ পুরুষ প্রতীত পর্য্যন্ত
৪। ত্রিপুরায় রাজত্ব ৫৯০ খৃষ্টাব্দ হইতে বর্ত্তমান কাল পর্য্যন্ত