রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/১২
(১২)
মহারাজ প্রতীত ও হেড়ম্বরাজ
মহারাজ প্রতীত ত্রিপুর সিংহাসনে আরোহণ করিলে এক আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটে। হেড়ম্বরাজের সহিত ত্রিপুররাজের প্রণয় ও যুদ্ধের কথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। হেড়ম্বরাজের সহিত বিবাহ বন্ধন দ্বারা যেমন দুই রাজ্যের প্রণয় হয়, আবার সেই সূত্রেই উভয়ের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা হয়। যুদ্ধের ফলে ত্রিপুররাজধানীর স্থানপরিবর্ত্তন ও নানা দুর্ভোগ ঘটিয়াছে। প্রতীত যখন রাজপদে অধিষ্ঠিত তখন হেড়ম্বরাজ প্রাচীনকালের ইতিহাস স্মরণ করিয়া ভাবিলেন আমরা পাশাপাশি রাজ্য, বৃথা কেন শত্রুতা করি! ত্রিপুররাজ ত্রিলোচনের জ্যেষ্ঠ পুত্রের বংশধর আমি, আর প্রতীত হইতেছে কনিষ্ঠপুত্রের বংশধর; কাযেই প্রতীত ও আমি দুই ভাই। আমি বড় প্রতীত ছোট, আমাদের উভয়ের বিবাদ ঘুচিয়া যাক্। রক্তের সম্বন্ধে আমরা পুনঃ ভাই ভাই কেন হইয়া না যাই! এইরূপ আলোচনা করিয়া হেড়ম্বরাজ প্রতীতের নিকট দূত পাঠাইলেন। দীর্ঘকাল বিবাদের পর দূতমুখে সংবাদ পাইয়া প্রতীত বিস্মিত হইলেন। যে হেড়ম্বরাজের সহিত বংশপরম্পরা যুদ্ধ হইতেছে, তাঁহার সহিত বিবাদ মিটিয়া যাইবে ইহা ত সুসংবাদ কিন্তু ইহা কি সম্ভব? অবশেষে উভয় রাজার সাক্ষাতের দিন স্থির হইল।
শুভদিনে মহারাজ প্রতীতের সহিত হেড়ম্বরাজের সাক্ষাৎ হইল। একে অন্যকে জড়াইয়া ধরিয়া আলিঙ্গন করিলেন। হেড়ম্বরাজ কহিলেন, ভাই প্রতীত, পূর্ব্বপুরুষের বিবাদ ভুলিয়া যাও, আজ হইতে আমরা ভাই ভাই! যেমন কথা তেমনি কায। উভয়ে একাসনে বসিলেন, একত্রে ভোজন করিলেন, হেড়ম্বরাজকে প্রতীত “দাদা” বলিয়া সম্বোধন করিলেন। দুই রাজাতে এমনি গলাগলি হইল যে প্রজারা দেখিয়। অবাক্! যুদ্ধের আশঙ্কা দূর হইয়া গেল, প্রজাদের আনন্দ আর ধরেনা। উভয় রাজাতে মিলিয়া উভয় রাজ্যের সীমানা চিহ্নিত করিলেন, প্রেমের ডোর ধরিয়া যেমন সীমা নির্দ্দেশ হইল, প্রেমের ডোরে তেমনি দুই রাজার হাত বাঁধা পড়িল। উভয়ে সমস্বরে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যদি কাকের কাল রঙ সাদাও হইয়া যায় তথাপি আমাদের প্রণয়ের পরিবর্ত্তন হইবে না, আমরা দুইজনে মৃত্যু পর্য্যন্ত একে অন্যকে ভাল বাসিতে থাকিব। যদি আমরা একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস হারাই তবে যেন আমরা নির্ব্বংশ হই। এইরূপ প্রীতি প্রেমে কিছুদিন কাটিল।
এদিকে হেড়ম্বরাজ্যের প্রতিবেশী কামাখ্যা জয়ন্তী প্রভৃতির রাজগণ গোপনে একত্রিত হইল। ত্রিপুরা ও হেড়ম্বের প্রণয়ে ইহাদের বড়ই দুশ্চিন্তা হইল। এখন উপায়? যদি ইহারা দুই রাজাতে এক সঙ্গে মিলিয়া আমাদের প্রতি দৃষ্টি দেয় তবে ত আমাদের সর্ব্বনাশ অনিবার্য্য। যতকাল ইহারা পরস্পর লড়িয়াছে ততকাল আমরা পরম সুখে কাল কাটাইয়াছি। আমাদের সে সুখের দিন বুঝি ফুরাইল। এখন আমাদের বাঁচিতে হইলে ইহাদের মধ্যে বিবাদ বাঁধাইতে হইবে। এইরূপ আলোচনাক্রমে সকলে স্থির করিল এক পরমা সুন্দরী রমণী পাঠাইয়া ইহার দ্বারা দুই রাজার মধ্যে বিবাদবাঁধানই উত্তম উপায়। কারণ নারীর প্রতি লোভ করিয়া সোণার লঙ্কা ছারখার হইয়াছে, রাবণ সবংশে ধ্বংস হইয়াছে।
এই ষড়যন্ত্রের সংবাদ ত্রিপুর ও হেড়ম্বরাজ্যে পৌঁছে নাই। একদিন হেড়ম্বরাজ ও প্রতীত একত্র বসিয়াছেন এমন সময় এক পরমা সুন্দরী নারী উভয় রাজার দৃষ্টির সম্মুখে স্বর্ণমৃগের ন্যায় ক্ষণিক দাঁড়াইয়া সহসা অদৃশ্য হইল। বিজলী চমকের ন্যায় এই নারীর রূপ উভয়কে মুগ্ধ করিল। প্রতীত নীরবে রহিলেন, হেড়ম্বরাজের মহাকৌতূহল হইল—এ কে, কেনই বা এই নিভৃতস্থানে আসিয়াছে। রাজদূত পাঠাইয়া খবর লইলেন, দূত আসিয়া বলিল—এই নারী মহারাজের সাক্ষাৎ কামনা করিয়া আসিয়াছে। হেড়ম্বরাজ উঠিয়া গেলেন, একটু আড়ালে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—তুমি কে, এখানে কেনই বা আসিয়াছ? সুন্দরী হেড়ম্বরাজকে আড়চোখে চাহিয়া ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বিরক্তির সঙ্গে বলিল—তুমি হেড়ম্বরাজ, তোমাকে ত আমি চাইনা, তুমি প্রৌঢ় হইতে চলিয়াছ, এখনও কি তোমার রমণীতে সাধ আছে? ছিঃ, আমি কন্দর্পতুল্য প্রতীতকে কামনা করি।
এই কথাগুলি যেন তপ্ত লৌহশলাকার ন্যায় হেড়ম্ব-রাজের হৃদয়ে বিদ্ধ হইল। কি! এত বড় রাজ্যের রাজা, তাহাকে এই অপমান! হেড়ম্ব-রাজ ক্রোধে জ্বলিতে লাগিলেন, পরিচারকগণকে তৎক্ষণাৎ আদেশ দিলেন—এর সৌন্দর্য্যে বড় অহঙ্কার হইয়াছে, শূৰ্পণখার ন্যায় ইহার নাক কান কাটিয়৷ দে। পরিচারকগণ ধারাল অস্ত্র লইয়৷ ইহার দিকে ছুটিতেই, নারী ভয় পাইয়া যেখানে প্রতীত ছিলেন সেদিকে এই বলিয়া ধাবিত হইল—হেড়ম্বরাজ বিনা দোষে আমাকে মারিতে চাহিতেছে, ত্রিপুররাজ অবলাকে রক্ষা কর। কথাগুলি ত্রিপুররাজের কর্ণগোচর হইল।
বিষয়টি লিখিতে এবং পড়িতে যত সময় লাগিল তাহার তিলাৰ্দ্ধ সময়ের মধ্যে একটা ঘূর্ণিবায়ুর মত এই ঘটনাগুলি ঘটিয়া গেল। মহারাজ বাহিরে আসিয়া দেখিলেন এক প্রলয় কাণ্ড, রমণী বধের পূর্ণ আয়োজন! তখন তাঁহার লোকজন দিয়া রমণীকে ঘেরাও করিয়া তাহাদের সহিত প্রতীত সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন। এই সুন্দরীকে লইয়া মহারাজ প্রতীতের সেনা বহুদূর অগ্রসর হইলে, হেড়ম্বরাজ প্রতীতের পশ্চাদ্ধাবন না করিয়া রণডঙ্কা বাজাইয়া দিলেন, আবার যুদ্ধের ডামাডোল বাজিয়া উঠিল। সুন্দরীর জন্য দুই রাজ্য যুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়িল। অদৃষ্ট দেবতা অদৃশ্যে হাসিলেন, কোথায় রহিল উভয় রাজার ভ্রাতৃপ্রতিজ্ঞা! কাক কাল বর্ণই রহিল, সাদা হইল না, তথাপি উভয় পক্ষের সৈন্য কাকের ন্যায় দুই পক্ষে সারি দিয়া দাঁড়াইল।
এই সংবাদে ষড়যন্ত্রকারী কামাখ্যা জয়ন্তী প্রভৃতি রাজার আনন্দের সীমা রহিল না। তাহারা পরমানন্দে আত্মকলহের সংবাদ উপভোগ করিতে লাগিল।