রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/১

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

(১)

কৃষ্ণমাণিক্য

 ১৭৬০ খৃষ্টাব্দে (১১৭০ ত্রিপুরাব্দে) ১লা পৌষ মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন। ইন্দ্রমাণিক্যের মৃত্যু ও কৃষ্ণমাণিক্যের শাসন আরম্ভ এই দুইয়ের ব্যবধান কাল প্রায় বিশ বৎসর। বিজয়মাণিক্য ও সমসের গাজির হস্তে ত্রিপুরা রাজ্য এই সময়ে ন্যস্ত ছিল। সমসের গাজির পতনে ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্ব্বাবস্থা পুনরায় ফিরিয়া আসিল, প্রজাবৃন্দের গৃহে গৃহে আনন্দধ্বনি জাগিল, যুবরাজ কৃষ্ণমণির দুঃখের রজনী প্রভাত হইল। কি দারুণ মনঃক্ষোভের মধ্যে তাঁহার জীবন কাটিয়াছে, শৈল হইতে শৈলান্তরে রাজ্যহারা কৃষ্ণমণি ব্যস্ত ত্রস্ত হরিণের ন্যায় ফিরিয়াছেন, সিংহাসন হারাইয়া মণিহারা ফণীর ন্যায় মনের দুঃখে রুষিয়া ফুসিয়া উঠিয়াছেন, স্বধর্ম্ম ও স্বদেশকে বিপন্ন দেখিয়া নিবিড়ে কত অশ্রুপাত করিয়াছেন! স্বদেশের উদ্ধারের জন্য কখনো মণিপুর কখনো হেড়ম্ব-রাজের দরবারে ম্লানমুখে অবনতশিরে কত না অপমান সহ্য করিয়াছেন! অবশেষে বিধাতা মুখ তুলিয়া চাহিলেন। নবাবের সহায়তায় তাঁহার জয় হইল, পবিত্র রাজবংশের নষ্ট গৌরব ফিরিয়া আসিল।

 কৃষ্ণমাণিক্য নিজ বাহুবলে যে সিংহাসনের উদ্ধার সাধন করিতে পারেন নাই সেই সিংহাসনকে সুদৃঢ় করিবার জন্য সামরিক শক্তি নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে চাহিলেন কিন্তু এ 


মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য

চেষ্টা কাহার নিকট? সময়ের পরিবর্ত্তনে ভারতের ভাগ্যবিপর্য্যয় ঘটিয়াছিল। পলাশীর পর হইতে নবোদিত সূর্য্যের ন্যায় ইংরেজ শক্তি ভারতের ভাগ্যাকাশে উদিত হইতে হইতে ক্রমে আসমুদ্র হিমাচল আয়ত্ত করিয়া ফেলিল। সেই বিপুল প্রতাপ ইংরেজের বল সে সময়ে সকলের চক্ষে হয়ত স্পষ্ট হইয়া ঠেকে নাই কারণ ইংরেজ, ক্লাইবের দ্বৈত শাসন মূলে আড়ালে রহিয়াছিলেন।

 সিংহাসনে বসিবার অল্পকাল মধ্যেই মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের সহিত চাকলে রোশনাবাদের রাজস্ব লইয়া ফৌজদারের বিরোধ উপস্থিত হয়। ফৌজদার মুর্শিদাবাদে নবাবের নিকট এবিষয় জানাইয়া মহারাজকে শিক্ষা দিবার জন্য সৈন্য প্রার্থনা করেন। ইংরেজের হস্তে নবাব তখন ক্রীড়নক মাত্র, কাযেই এ বিষয় ইংরেজ গভর্ণর ভান্সিটার্টের নিকট প্রেরিত হয়। ভান্সিটার্ট (Vansittart) বিষয়টিকে পরম উৎসাহে গ্রহণ করিলেন। ত্রিপুরা জয়ের উত্তম সুযোগ মনে করিয়া চট্টগ্রামের শাসন কর্ত্তাকে কাল বিলম্ব না করিয়া মহারাজের সহিত সংগ্রামে লিপ্ত হইতে লিখিয়া দিলেন। চট্টগ্রামে তৎকালে মোগল শক্তি বিধ্বস্ত করিয়া ইংরেজ শাসনের বনিয়াদ রচনা হইয়াছিল, হারিভার লেষ্ট চিফ্ অফিসার পদে নিযুক্ত হন এবং Thomas Rambold, Randolph Marriot ও Walter Wilkins-কে লইয়া মন্ত্রণা সভা গঠিত হয়।

 চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা ১৭৬১ খৃষ্টাব্দে লেফটেনেণ্ট মথি সাহেবকে যুদ্ধোপকরণ দিয়া কৃষ্ণমাণিক্যের বিরুদ্ধে সত্বর পাঠাইয়া দিলেন। এইভাবে হৃতবল ত্রিপুরার সহিত ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের সঙ্ঘর্ষ উপস্থিত হইল। ইংরেজ সৈন্যের গতিরোধ করিতে কৃষ্ণমাণিক্য প্রাচীন কৈলাগড় দুর্গে সাত হাজার সৈন্য ও কতকগুলি তোপসহ প্রস্তুত হইলেন। ইংরেজ সৈন্যের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০৬। এমতাবস্থায় যুদ্ধে মহারাজের সুবিধা হইবারই কথা ছিল কিন্তু পলাশীর রণাঙ্গনে যেমন বিশ্বাসঘাতকতার অভিনয় পাওয়া যায় এখানেও সেই দৃশ্য ঘটিয়াছিল। ত্রিপুর সৈন্যের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করিয়া এইরূপ বলা হইল, আর রক্ষা নাই—পর্ব্বতে পলায়নই একমাত্র কার্য্য। রণক্ষেত্র হইতে সহসা ত্রিপুর সৈন্য হঠিয়া গেল, কে যে কোথা হইতে যুদ্ধের অবস্থা এইভাবে শোচনীয় করিয়া তুলিল মহারাজ ভাল করিয়া বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। কিন্তু যখন অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করিলেন তখন ইংরেজসৈন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। বাঙ্গালার নবাবের ন্যায় ত্রিপুরার মহারাজ ইংরেজ শক্তির কবলে আসিয়া পড়িলেন, রেসিডেণ্টরূপে লিকসাহেব নিযুক্ত হইলেন, ইনিই ত্রিপুরার সর্ব্বপ্রথম রেসিডেণ্ট।

 ইহার কিছুকাল পরে ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষ জগৎমাণিক্যের পুত্র বলরামমাণিক্যকে চাকলে রোশনাবাদের অধিপতি করিয়া দেন। ইহাতে কৃষ্ণমাণিক্যের হৃতশক্তি আরও খর্ব্ব হইয়া পড়িল কিন্তু এ ব্যবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই। বলরামমাণিক্যকে দূর করিয়া কৃষ্ণমাণিক্য পুনঃ চাকলে রোশনাবাদের অধিকার প্রাপ্ত হইলেন। এ জন্য মহারাজকে কলিকাতা ইংরেজ কর্ত্তৃপক্ষের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতে হইয়াছিল। সেইখানে কালিঘাটে মার অর্চ্চনা করিয়া মহারাজ হারিভার লিষ্টের সহিত সাক্ষাৎ করেন, হারিভার সদাশয় লোক ছিলেন। তখনও প্রকাশ্যে নবাব শাসন চলিতেছিল তাই চাকলে রোশনাবাদের ভার মহারাজকে পুনঃ অৰ্পণ করিতে ইচ্ছুক হইয়া প্রথমতঃ মহারাজকে মুর্শিদাবাদ প্রেরণ পরে নিজেও তথায় গমন করেন। সাহেবের সাহায্যে মহারাজ সফলকাম হইলেন। ইহার কিছুকাল মধ্যেই ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী দেশের সর্ব্বময় কর্ত্তৃত্ব লাভ করেন এবং লিক সাহেব (Mr. Ralph Leeke) ত্রিপুরার রেসিডেণ্ট পদে স্থায়ী হন। লিক সাহেব চাকলে রোশনাবাদ শাসন উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের প্রবর্ত্তন করেন। পার্ব্বত্য ত্রিপুরার শাসন মহারাজের হস্তে পূর্ব্ববৎ রহিয়া গেল, এই ভাবে সেই সময় হইতে স্বাধীন ত্রিপুরা ও জমিদারী ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শাসিত হইতে লাগিল। মোগল শাসনের পরিবর্ত্তে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্ত্তিত হইয়া গেল।

 কৃষ্ণমাণিক্যের যৌবরাজ্য কালে তিনি আগরতলায় (পুরাতন আগরতলা) বসতি নির্ম্মাণ করেন এ কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। শৈলমালার বেষ্টনে স্থানটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলিয়া প্রতিভাত হওয়ায় তিনি সেখানে নদীর ধারে বসতি নির্ম্মাণ করিয়া সমসের গাজি হইতে আত্মরক্ষা করেন। ১১৭০ ত্রিপুরাব্দে রাজপদে অধিষ্ঠিত হইয়া তিনি পুরাতন আগরতলার প্রতি অধিকতর মনোনিবেশ করেন এবং উহাকে রাজধানীরূপে গড়িয়া তুলিতে ঐ সময় হইতে চেষ্টার ক্রটি করেন নাই। কৃষ্ণমালা গ্রন্থে এইরূপ উক্ত হইয়াছে।

এগারশ সত্তর সন হইল যখন
আগরতলা রাজধানী করিল রাজন্॥

 বঙ্গে ইংরেজ যুগ প্রবর্ত্তিত হইবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উদয়পুর হইতে রাজধানী পুরাতন আগরতলায় স্থানান্তরিত হয়। উদয়পুর হইতে রাজপাট লইয়া আসিবার সমকালেই বৃন্দাবনচন্দ্রের বিগ্রহ ও চতুর্দ্দশ দেবতা আনয়ন পূর্ব্বক তথায় স্থাপন করা হয়। ক্রমে ক্রমে রাজানুচরগণের আবাস নির্ম্মিত হইলে মহারাজ সকলকে লইয়া আগরতলা চলিয়া আসিলেন, উদয়পুর শূন্য হইয়া পড়িল। সুদূর অতীত হইতে যে উদয়পুর রাজশ্রীসমুজ্জ্বল হইয়া আসিতেছিল তাহার গৌরব স্তিমিত হইয়া পড়িল।

 কৃষ্ণমাণিক্য প্রসিদ্ধ কীর্ত্তি কুমিল্লার সতর রত্ন মন্দির।[] এ সম্বন্ধে কৃষ্ণমালা গ্রন্থে এইরূপ লেখা হইয়াছেঃ—

এক মঠে সপ্তদশ মঠের গঠন
সপ্তদশ রত্ন নাম হৈল সে কারণ॥
—৯ম খণ্ড ২৬৭ পৃঃ।

 কৈলাস সিংহ মহাশয়ের মতে রত্নমাণিক্যের সময় ইহার নির্ম্মাণ সুরু হয় এ কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। কিন্তু রাজমালায় বর্ণিত হইয়াছে যে ইহা কৃষ্ণমাণিক্য কর্তৃক নির্ম্মিত, তিনিই মন্দির মধ্যে জগন্নাথ মহাপ্রভু স্থাপন করেন।

বলভদ্র জগন্নাথ সুভদ্রা সহিত
সপ্তদশ রত্নে রাজা করিল স্থাপিত।
—পৃঃ ২৬৭।

 রাজধানী যখন উদয়পুর হইতে আগরতলা স্থানান্তরিত হইল তখন উদয়পুর হইতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ কেন কুমিল্লায় স্থাপিত হইলেন ইহা বুঝা গেল না। স্থানীয় জগন্নাথ বাড়ীর পাণ্ডা ঠাকুরের (অচ্যুতানন্দ) মুখে শুনিয়াছি তাঁহাদের নিকট যে সনন্দ রহিয়াছে উহা মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য প্রদত্ত।[]

 কৃষ্ণমাণিক্য বহু সদ্‌গুণান্বিত ছিলেন, তাঁহার বৈরী সমসের গাজি প্রদত্ত ব্রহ্মোত্তর ও অন্য নিষ্কর দান রহিত না করিয়া নিজ মহত্ত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন।

 সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর কাল রাজত্ব ভোগ করিয়া মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করেন।[]

  1. কৃষ্ণমণিক্যের অন্যতম কীর্ত্তি আখাউড়া ষ্টেশন সন্নিহিত রাধামাধব মন্দির। শিলালিপির কিয়দংশ এইরূপঃ—বিষ্ণবে কৃষ্ণপ্রীত্যা প্রাদাদ্ রম্যেষ্টকাভির্বিরচিতমমলং মন্দিরং পঞ্চরত্নং। ১৬৯৭ শক।
  2. শ্রীযুক্ত মোহিনী ত্রিপাঠী উড়িষ্যা হইতে মূল সনন্দ আনিয়া দেখার সুযোগ দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। সনন্দ ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে কৃষ্ণমাণিক্য কর্ত্তৃক রঘুনাথ দাসকে প্রথম প্রদত্ত হয়। তাঁহার বংশক্রম এইরূপঃ—
  3. মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের রাজত্বকাল অবলম্বনে কৃষ্ণমালা রচিত হইয়াছে। রাজমালায় কৃষ্ণমাণিক্য কাহিনী এত সংক্ষেপ করা হইয়াছে যে বুঝিতে অত্যন্ত কষ্ট হয়। কৃষ্ণমালা পাঠ করিলে এই সংক্ষিপ্ত স্থলগুলি সহজেই বুঝা যায়।
  4. রঘুনাথ
    রামচন্দ্র
    মুকুন্দ
    নরসিংহ
    প্রহ্লাদমুক্তেশ্বরআদিনাথসদানন্দ