রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/১৫



(১৫)

সমসের গাজি

 ত্রিপুরার সিংহাসন শূন্য হইয়া পড়িলে জয়মাণিক্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হরিধন ঠাকুর নবাব হইতে সনন্দ গ্রহণ পূর্ব্বক বিজয়মাণিক্য নামে ভূষিত হইয়া রাজদণ্ড ধারণ করেন। হস্তি সংগ্রহ করাই ছিল নবাব ও রাজার মধ্যে এক মাত্র সম্বন্ধ। বিজয়মাণিক্যের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কৃষ্ণমণি যুবরাজ। যতদিন বিজয়মাণিক্য যথারীতি হস্তিকর পৌঁছাইতে পরিবেন ততদিন সিংহাসন নিষ্কণ্টক, সুতরাং মহারাজ হাতীর খেদায় অত্যন্ত মনোযোগ দিলেন। কালের কি কুটিল গতি, যাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণের প্রতাপে বাঙ্গালার নবাব সন্ত্রস্ত থাকিত আজ তাঁহার কার্য্য হইতেছে কিরূপে চুক্তি অনুযায়ী হাতী ধরা যায়। বন তন্ন তন্ন করিয়া বহু চেষ্টা হইল কিন্তু হাতী মিলিল না, এখন উপায়?

 তখন বঙ্গের অধিপতি আলিবর্দ্দি খাঁর অধীনে ঢাকার নায়েব নাজিম ছিলেন নিবাইস মহম্মদ, হোসেন কুলি খাঁ ছিলেন তাহারই সহকারী। হোসেন কুলি খাঁর সহিত ত্রিপুরেশ্বরের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ ছিল। হোসেনের সহায়তায় বিজয়মাণিক্য সিংহাসন লাভ করেন, এখন হোসেন হইতে হাতীর জন্য ক্রমাগত তাগিদ আসিতে লাগিল, বিজয়মাণিক্য দশদিক অন্ধকার দেখিলেন।

 এই সময়ে ত্রিপুরার ইতিহাসে এক ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটে। ত্রিপুরার বাহুবল শক্তিহীন হইয়া পড়ায়, চতুর্দ্দিকে বিশৃঙ্খলা প্রবল হইয়া পড়িল, ক্ষমতার লোভে সাধারণ ব্যক্তিও মাথা তুলিতে লাগিল এবং দিগন্তব্যাপী অসন্তোষ দেখা দিল। সুযোগ পাইয়া দক্ষিণ শিক নিবাসী এক মুসলমান প্রজা ক্রমেই দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠিতেছিল, ইহার নাম সমসের গাজি। সমসের গাজির অভ্যুদয় উপন্যাসের ন্যায় চমকপ্রদ।

 জগৎমাণিক্য যখন মীর হবিবের সাহায্যে চাকলে রোশনাবাদের অধিপতি হন, তখন দক্ষিণ শিক নিবাসী এক দরিদ্র মুসলমান চাষ করিবার সময় বহুমূল্য বস্তু প্রাপ্ত হয় এবং রাজা জগৎমাণিক্যকে উহা অর্পণ করায় তিনি ঐ প্রজাকে দক্ষিণ শিকের জমিদারী স্বত্ব প্রদান করেন। ঐ প্রজার নাম সদা গাজি। সদাগাজির ভাগ্য পরিবর্ত্তন হইল, তিনি জমিদার হইয়া গেলেন। সদাগাজির পুত্র নাছির মহম্মদ ষখন পিতার মৃত্যুর পর দক্ষিণ শিকের জমিদার তখন তাঁহার শিশুপুত্রদের পাঠাভ্যাসকালে এক দরিদ্র মুসলমান বালক সেখানে পড়াশুনা করিবার অনুমতি প্রাপ্ত হয়। ইঁহার নাম সমসের গাজি। এক সামান্যা রমণীর গর্ভে ও জনৈক ফকিরের ঔরসে তাঁহার জন্ম হয়, তাঁহার জীবনী লেখক তাঁহাকে “পীরের নন্দন” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পাঠাভ্যাসে ও শক্তি চর্চ্চায় সমসের জমিদার নন্দন ছাদুল্লা ও বাদুল্লাকে শীঘ্রই অতিক্রম করিয়া গেলেন। ইহা দেখিয়া নাছির মহম্মদ সমসেরকে বাঁশপাড়া কাছারীর তহশীলদার নিযুক্ত করিলেন।

 সমসের তহশীলদারী করিতেছেন এমন সময় এক বিখ্যাত
ফকির বলিল—‘সমসের তুমি নিজকে চিনিতে পার নাই।’
ফকিরের (গদা হোসেন খন্দকার) সহিত তাঁহার নিভৃতে সাক্ষাৎ হয়। ফকির বলিলেন, “সমসের তুমি নিজকে চিনিতে পার নাই, বিধাতা তোমাকে তহশীলদার করিয়া পাঠান নাই—এই চাক্‌লে রোশ্‌নাবাদ একদিন তোমারই হইবে। তোমাকে আমি দৈবশক্তিসম্পন্ন একটি ঘোড়া ও একটি তরবারী দিব, ইহাদের শক্তি বলে তুমি যুদ্ধে অজেয় হইবে। দক্ষিণ শিকের জমিদার নাছির তোমাকে প্রতিরোধ করিতে যাইয়া সবংশে নিহত হইবেন তারপর তোমার সহিত ত্রিপুরেশ্বরের ঘোর সংগ্রাম বাধিবে কিন্তু তোমার জয় অনিবার্য্য। তোমার শক্তির বিষয় তুমি এখনও টের পাও নাই কিন্তু দিন আসিতেছে যখন মর্ম্মে মর্ম্মে যে কথা বলিলাম তাহার সত্যতা উপলব্ধি করিবে।” এই বলিয়া সেই ফকির সমসেরকে দৈব অশ্ব ও তরবারী প্রদান করিলেন।[]

 ফকির চলিয়া গেলেন, যতদূর দেখা যায় চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সমসের ফকিরকে দেখিতে লাগিলেন। সমসের বুঝিতে পারিলেন তাঁহার হৃদয়ে উচ্চাভিলাষের অনল জ্বালাইয়া ফকির বিদায় লইলেন। দৈব অশ্ব ও তরবারী তাঁহার হাতে রহিয়াছে, দুনিয়াতে কাহাকে ভয়? সমসেরের ইচ্ছা হইল এখন শক্তির পরীক্ষা হউক, তাই জমিদার নাছিরের নিকট তাঁহার কন্যা দৈয়া বিবির পাণিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠাইলেন। জমিদার ত অবাক! এ বলে কি? সামান্য তহশীলদার হইয়া এত বড় কথা! সমসেরকে শিক্ষা দিবার জন্য নাছির বিবাহের প্রস্তাবের প্রত্যুত্তর স্বরূপ একদল সৈন্য পাঠাইয়া দিলেন।

 সমসের অতটা প্রস্তুত ছিলেন না, তাই সহসা সৈন্যের আগমনে বেগতিক দেখিয়া দৈব অশ্বে চড়িয়া বেদরাবাদ পরগণায় কিছুকাল গা ঢাকা দিয়া রহিলেন, তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা অমিত বলশালী ছাদু গাজিও ফিরিতে লাগিলেন। সেখানে সমসের কতকগুলি লোককে হাত করিয়া তাহাদিগকে সামরিক শিক্ষা দিয়া সহসা দক্ষিণ শিকে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, জমিদার নাছিরের সৈন্য তাঁহার গতিরোধ করিতে পারিল না। সমসের অতুল বিক্রমে বিপক্ষ সৈন্য বিধ্বস্ত করিয়া জমিদার ও তাঁহার পুত্রগণের বিনাশসাধন করিলেন; দক্ষিণ শিক সমসেরের হস্তে চলিয়া আসিল। তখন জমিদার নন্দিনীর পাণিগ্রহণে বাধা দিবার কেহ রহিল না। এক চক্ষের পলকে সমসের তহশীলদার হইতে দক্ষিণ শিকের জমিদার হইয়া গেলেন। ফকিরের কথা আশ্চর্য্য রূপে ফলিয়া গেল, এখন বাকী রহিল ত্রিপুরেশ্বরের সহিত শক্তি পরীক্ষা।

 সমসের গাজির দক্ষিণশিক অধিকার করার কথা ত্রিপুরার মহারাজের কানে উঠিতেই তিনি বুঝিলেন ব্যাপার ভাল নয়, সত্বর ইহার দমন আবশ্যক। সমসেরকে ধরিবার জন্য লুচির্দপনারায়ণের অধীনে ত্রিপুরার ফৌজ ছুটিল, নিরুপায় দেখিয়া সমসের মহারাজকে কয়েক সহস্র মুদ্রা নজর স্বরূপ পাঠাইলেন। প্রীত হইয়া মহারাজ তাঁহাকে সনন্দ প্রদান করিলেন। এইভাবে সমসের প্রথম চোট সামলাইয়া লইলেন এবং অদূর ভবিষ্যতে শক্তি পরীক্ষার জন্য বিশেষ তোড়জোড় করিতে লাগিলেন। এই ঘটনার তিন বৎসর পর সমসের মেহেরকুল পরগণা ইজারা লইয়াছিলেন।

 পূর্ব্বে বলা হইয়াছে হোসেন কুলিখাঁ হইতে বিজয়মাণিক্যের নিকট ক্রমাগত হাতীর জন্য তাগিদ আসিতেছিল এবং মহারাজ হাতী ধরিতে না পারিয়া বড়ই ফাঁপরে পড়িয়াছিলেন। সুযোগ বুঝিয়া সমসের এক্ষণে মহারাজের সহিত গোপনে প্রতিযোগিতা আরম্ভ করিলেন। তিনি হোসেন কুলিখাঁর নিকট জানাইলেন বাঙ্গালার নবাবকে হাতী ধরিয়া দিতে তিনি সম্মত আছেন এজন্য বাঙ্গালা সরকার বিজয়মাণিক্যকে যে বৎসরে ১২ হাজার মাসহারা দিয়া থাকেন তাহা তিনি চাহেন না তবে ঐ কার্য্যের বিনিময়ে তিনি চাকলে রোশনাবাদের জমিদারী পাইতে চাহেন। হোসেন কুলিখাঁ দেখিলেন প্রস্তাব মন্দ নয়, বিজয়মাণিক্যের সহিত আলাপক্রমে ইহার পাকাপাকি ব্যবস্থা করিবার জন্য মহারাজকে ঢাকা লইয়া গেলেন। বিজয়মাণিক্য আর ঢাকা হইতে ফিরিলেন না, সেখানেই তাঁহার মৃত্যু হইল।

  বিজয়মাণিক্য প্রবাসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমসেরের উন্নতশির আকাশে উঠিতে লাগিল। রাজার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি রাজকর বন্ধ করিয়া দিলেন এবং কাল বিলম্ব না করিয়া নিজকে চাকলে রোশনাবাদের অধিপতিরূপে ঘোষিত করিলেন। এতদিনে ফকিরের কথা সম্পূর্ণ সত্য হইতে চলিল। ত্রিপুর সিংহাসনের দিকে ক্রমেই তাঁহার লুব্ধ দৃষ্টি পড়িতে লাগিল।

 বিজয়মাণিক্যের মৃত্যুতে ত্রিপুর সিংহাসন শূন্য হইয়া পড়িয়াছিল। ইন্দ্রমাণিক্যের অনুজ যুবরাজ কৃষ্ণমণির পরিচয় পূর্ব্বে দেওয়া হইয়াছে, অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় তিনি হেড়ম্ব রাজ্যে আশ্রয় লইয়াছিলেন। এই সুযোগে তিনি ত্রিপুর প্রজার আহ্বানে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্ত্তন করেন, সিংহাসনে বসিবার পক্ষে রাজ্যের ভিতরে কোন অন্তরায়ই ছিল না কিন্তু বাহিরে প্রবল বৈরী সিংহনাদ করিতেছিলেন। সমসের যখন শুনিলেন যুবরাজ কৃষ্ণমণি রিয়াঙ্গ অঞ্চলে সৈন্যসহ অগ্রসর হইয়াছেন তখন বিদ্যুদ্বেগে তাঁহার গতিরোধ করিতে সমসের কাল বিলম্ব করিলেন না। সমসেরের দৈব তরবারীরই জয় হইল, কৃষ্ণমণি পরাভূত হইয়া অরণ্যমধ্যে গা ঢাকা দিলেন। রাজধানী উদয়পুর সমসেরের হস্তগত হইল, সমসের এখন ত্রিপুরার অধিপতি।

 সমসের বুদ্ধিমান ছিলেন, তিনি দেখিলেন যুদ্ধে যদিচ তাঁহার জয় হইয়াছে কিন্তু ত্রিপুরার হৃদয় জয় করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। কেবল তরবারীর শক্তিতে নিজকে ত্রিপুরেশ্বররূপে চালান যাইবে না, সুতরাং ধর্ম্মমাণিক্যের পৌত্র বনমালীকে লক্ষ্মণমাণিক্য নামে ঘোষিত করিয়া সিংহাসনে বসাইলেন, নিজে আড়ালে রহিলেন। ইতিহাসের কি আশ্চর্য্য যুগধর্ম্ম, বঙ্গের সিংহাসনে সেই একই দৃশ্য চলিতেছিল। তখন পলাশীর অভিনয় শেষ হইয়াছে, নবাব সিরাজউদৌল্লার জীবনান্ত ঘটিয়াছে, বঙ্গের তক্‌ততাউসে মির্জ্জাফর ক্রীড়নকরপে বিরাজমান। সমসের বুঝিয়াছিলেন যদি হাতী কর বন্ধ হইয়া যায় তবে বাঙ্গালার সরকার হইতে তাঁহার উপর চাপ আসিবে। তাই লক্ষ্মণমাণিক্য দ্বারা মুর্শিদাবাদে নবাবের নিকট জানাইয়া দিলেন, হাতীর খেদা প্রস্তুত হইতেছে শীঘ্রই নবাবের কর পাঠান হইবে। এইভাবে লক্ষ্মণমাণিক্য দ্বারা দুইদিক সামলাইয়া লইলেন।

 ফকিরের বাক্য অব্যর্থ প্রমাণিত হইল। সমসের গাজি ত্রিপুরারাজ্যে সর্ব্বময় প্রভু হইলেন। চট্টগ্রাম নোয়াখালী ও ত্রিপুরায় দূরে দূরে কিল্লা প্রস্তুত করিয়া সমসের আপন অধিকার সুদৃঢ় করিয়াছিলেন। কালের প্রবাহে যদিচ ইহারা বিলুপ্তপ্রায় তথাপি সোণামুড়ার গড়খাই ‘গাজির কোঠ’ ও ফেণী নদীর তীরবর্ত্তী সমসেরের কিল্লাস্থান কিল্লাঘাট নামে আজিও সুপরিচিত। এই বিস্তৃত অঞ্চলে সমসের একাধিপত্য বিস্তার করিলেন। কিন্তু সমসেরের অর্থস্পৃহা দিন দিন বাড়িয়া চলিল; রাজকোষের মালিক হইয়াও সমসেরের অর্থশোষ মিটিল না। তাই অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দস্যুবেশে ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের জমিদারদিগের গৃহে গভীর রাত্রিতে হানা দিতেন। সমসের গাজির প্রিয়ভক্ত তদীয় জীবন চরিত লেখক সেখ মনোহরও এ বিষয়ে নীরব থাকিতে পারেন নাই। “সেখ মনোহর বলেন যে সমসের একজন কৃপণ জমিদারের গৃহ হইতে একলক্ষ টাকা ডাকাতি করিয়া আনিয়াছিলেন।” যখন এই ব্যাপার প্রকাশ হইয়া পড়িল তখন সমসেরের নামে চারিদিকে আতঙ্ক ও ভীতির সঞ্চার হইল। ইহা দ্বারা সমসেরের যেরূপ অপযশ হইয়াছিল তেমনি সর্ব্বহারা হইবার কারণেরও সূত্রপাত ঘটিল। আজ পর্য্যন্ত সমসেরের দস্যুবৃত্তির নানা কাহিনী এ অঞ্চলে কথিত হইয়া থাকে।

 কিছুকাল পূর্ব্বে সীতাকুণ্ড সন্নিহিত বাড়বকুণ্ড দর্শনান্তে জ্বালামুখী কালীবাড়ীতে বিশ্রাম করিবার কালে পুরোহিতের মুখে এসম্বন্ধে এক গল্প শুনিতে পাই। কালীবাড়ীর সিন্দুকে টাকা ভরিয়া উঠায় সেখানকার সেই সময়ের প্রধান পুরোহিত টাকাগুলি বাহিরে আনিয়া গণিয়াছিলেন। সুতরাং ইহা লোক মুখে কথায় কথায় অনেক দূর চলিয়া আসে। পুরোহিতকে কেহ কেহ সমসের গাজির নামে ভয় দেখাইলে তিনি নাকি নির্ভয়ে বলিয়াছিলেন—“প্রহরীর দরকার নাই, মার অর্থ কেহ লইতে পারিবে না। মা যদি ইচ্ছা করেন তবে মা-ই এ অর্থ রক্ষা করিতে পারিবেন।” পুরোহিতের বাক্য সত্য হইল। গভীর
কাতারে কাতারে সিপাহী বাহির হইয়া মার মন্দির পরিক্রমণ করিতে লাগিল।
রাত্রিতে অশ্বখুরের শব্দে সমসেরের আগমন জানা গেল, কিন্তু সমসেরকে কে রোধ করিতে যাইবে? সকলেই ঘরের ভিতরে ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া ব্যাপার দেখিতে লাগিল। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! সমসের যখনই নিজ সঙ্গীদের নিয়া কাছে ভিড়িতেছেন আর অমনি কাতারে কাতারে সিপাহী বাহির হইয়া মার মন্দির পরিক্রমণ করিতে লাগিল। সমসের ত অবাক, দেবালয়ে এত সিপাহী! তাই অপ্রস্তুত হইয়া দূরে সরিয়া গেলেন। সেই রাত্রিতে তিনি বারবার মন্দিরে আসিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন কিন্তু বার বার সঙ্গীনধারী সৈন্য টহল ফিরিতেছে দেখিতে পাইলেন, এই ভাবে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল, নিরাশ হইয়া সমসের ফিরিয়া গেলেন!

 এইভাবে দস্যুপণায় সমসেরের দুর্নাম রটিয়া গেল। রাজা হইয়া যদি প্রজার অর্থ হরণে মতি হয় তবে প্রজার রাজভক্তি কোথা হইতে আসিবে? রাজ্যশুদ্ধ প্রজা অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। ইহাতে সমসেরের প্রতিপক্ষ যুবরাজ কৃষ্ণমণির বিশেষ সুবিধা ঘটিল। সমসেরের হস্ত হইতে ত্রাণ পাইবার জন্য তাঁহাকে অনেকেই মনে মনে বরণ করিতে লাগিলেন। সমসেরের হস্তে পরাজিত হইয়া কৃষ্ণমণি উদয়পুর ত্যাগ করিয়া পুরাতন আগরতলা স্থাপন পূর্ব্বক সেইখানে বাস করিতে আরম্ভ করেন। ধীরে ধীরে অনেকেই তাঁহার দলভুক্ত হইতে লাগিলেন। সমসেরের সহিত শক্তি পরীক্ষার জন্য কৃষ্ণমণি হেড়ম্ব ও মণিপুর রাজ্যে সৈন্য সংগ্রহের প্রয়াস পাইয়াছিলেন। কিন্তু বাহুবলে সমসেরকে পরাভূত করা সম্ভবপর হইল না।

 সমসের বাহুবলে অজেয় থাকিলেও প্রজার চিত্ত হইতে তিনি ক্রমেই সরিয়া পড়িতেছিলেন। যদিচ হস্তিকর দিয়া সমসের বাঙ্গালার নবাবকে চুপ রাখিয়াছিলেন কিন্তু তাঁহার অত্যাচার কাহিনী নবাবের কানে উঠিতে বিলম্ব হইল না। যুবরাজ কৃষ্ণমণি নবাবকে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে এ বিষয় জানাইবার জন্য মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিলেন। তখন বঙ্গের সিংহাসনে ন্যায়পরায়ণ মীরকাশিম অধিষ্ঠিত। তিনি কাগজপত্র দেখিয়া কৃষ্ণমণিই যে রাজ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী বুঝিতে পারিলেন এবং তাঁহাকেই ত্রিপুরাপতিরূপে ঘোষিত করিলেন। সমসেরকে ধরিবার জন্য নবাবের ফৌজ চলিয়া আসিল, সমসের তজ্জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কাযেই বন্দী হইয়া গেলেন। সমসের গাজির সৌভাগ্য রবি অস্তমিত হইয়া আসিয়াছিল। ফকিরের বাক্য অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছিল—ত্রিপুরেশ্বর তাঁহার নিকট পরাজিত রহিয়া গেলেন কিন্তু নবাবের সৈন্যের নিকট তাঁহার হার হইল!

 মুর্শিদাবাদে সমসেরকে আনিয়া শৃঙ্খলিত করিয়া বন্দীশালায় রাখা হইল, নবাবের বিচারে তাঁহার প্রাণদণ্ডের আদেশ হইল। তখন বদ্ধাবস্থায় সমসেরকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হয়। বিচিত্র শক্তির পরিচয় দিয়া এইভাবে একটি বিস্ময়কর জীবনের অবসান ঘটিল![]

  1. নাছির যাইব মারা, পাইবা জমিদারী
    কিন্তু রাজার সঙ্গে তোমার হৈব মহারণ।
    আল্লা এ করিলে হৈবা রাজ্যের ভাজন॥
    এহি সুবর্ণ অশ্ব তোমা দিল তে কারণ।
    মুল্লুক বিজয়ে হৈব জানিয়া আপন॥
    —গাজীনামা।

  2. রাজমালায় সমসের গাজির বিস্তৃত বিবরণ নাই। কৈলাস সিংহ মহাশয় সমসের গাজিনামা পুস্তক ও অন্যান্য তথ্য হইতে এসম্বন্ধে সুন্দর বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছেন। এ আখ্যান তদুপরি রচিত। রাজমালা আফিসে গাজিনামা পুস্তক আছে উহার উপর কালীপ্রসন্ন সেন মহাশয় যে প্রবন্ধ লিথিয়াছেন তাহাও আলোচিত হইল।