রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/১০

(১০)

বীরেন্দ্রকিশোর

 ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোর সিংহাসন আরোহণ করেন। পিতার ন্যায় তিনিও নানা সদ্‌গুণে ভূষিত ছিলেন। পিতার অনারব্ধ কার্য্য সমাপ্তির জন্য তাঁহার বিশেষ উৎসাহ ছিল। তিনি ছিলেন একজন অতি উচ্চশ্রেণীর চিত্রকর, তাঁহার চিত্রপ্রতিভা যে কেবল রং তুলিতেই নিবদ্ধ ছিল এমন নহে পরন্তু উহা ইট পাথরেও শিল্পনৈপুণ্য ফুটাইয়াছিল। তাঁহার পরিকল্পনা অনুযায়ী যে সকল ইমারৎ গড়া হইয়াছিল সেগুলির প্রত্যেকটি আপন আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হইয়া আছে। দুর্গামন্দির ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, প্রশস্ত সরোবরের গায়ে দুইটি শ্বেত পদ্মের আকারে ফুটিয়া রহিয়াছে। রাজপ্রাসাদের সংলগ্ন ‘লালমহল’ আর একটি স্থপতি বিদ্যার উত্তম নিদর্শন।


মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য বাহাদুর

বীরেন্দ্রকিশোরের চিত্র প্রতিভার সর্ব্বোত্তম দান হইতেছে ‘কুঞ্জবন’ নির্ম্মাণ। যাঁহারা আকবরের ‘ফতেপুর শিক্রী’ দেখিয়াছেন তাঁহারাই বুঝিতে পারিবেন স্থান নির্ব্বাচনের তুলনায় ‘ফতেপুর শিক্রী’ হইতে কুঞ্জবন কোনও অংশে ন্যূন নহে। ফতেপুর শিক্রীর উচ্চতা অধিক নহে, কুঞ্জবনও তদনুরূপ, শিক্রীর চতুষ্পার্শ্বে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে নুতনত্ব কিছুই নাই, শিক্রী নিজের সৌন্দর্য্যেই নিজে উদ্ভাসিত কিন্তু কুঞ্জবন তাহা নহে। কুঞ্জবনের মধ্যে এমন একটি লুক্কায়িত মহিমা আছে যাহা শিল্পী বীরেন্দ্রকিশোরের দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই। তিনি সেই মহিমার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই কুঞ্জবনের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। সেই মহিমাটি কি?

 আগরতলা সম্বন্ধে বাহিরের লোকের ধারণা আছে যে ইহা পার্ব্বত্যস্থান কিন্তু সহরে প্রবেশ অবধি ভিতরে আসিয়াও পর্ব্বতের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না। মনে হয় কি ভুল ধারণা! এখানে ত মোটেই পাহাড় নাই, একেবারে গ্রামদেশেরই মত বেশ সমতল। কুঞ্জবনের পথে অগ্রসর হইতে হইতেও এ ভুল ভাঙ্গে না। যখন পথিক কুঞ্জবন প্রাসাদ শিখরে উঠিয়া সহরের দিকে মুখ করিয়া তাকায় তখন অবাক্ হইয়া দেখিতে পায় দক্ষিণের পর্ব্বতমালা উত্তরের শৈলশ্রেণীর সহিত মিশিয়া গিয়া এক হইয়া গিয়াছে এবং কয়েক মুহূর্ত্ত পূর্ব্বেও যে সহরকে সমতল মনে করা গিয়াছিল তাহা যেন কোন্ যাদুমন্ত্রে বনের মধ্যে অস্তিত্ব হারাইয়া ফেলিয়াছে। উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের চূড়া ও অন্যান্য হর্ম্ম্যের উচ্চভাগগুলি কেবল যেন সহরের সাক্ষীস্বরূপ গভীর অরণ্যের মধ্যে আত্মগোপন করিতে পারিতেছে না। এইটিই কুঞ্জবনের লুক্কায়িত মহিমা, ফতেপুর শিক্রীতে ইহার নাম গন্ধও নাই, প্রকৃতির এইরূপ পটপরিবর্ত্তনে কুঞ্জবনের জোড়া আছে কিনা জানি না!

 নিপুণ চিত্রকর বীরেন্দ্রকিশোর সেই লুক্কায়িত মহিমার কুঞ্জবনে একটি অপূর্ব্ব প্রাসাদ নির্ম্মাণ করিয়া ইহার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিলেন। উদয়পুরের জলপ্রাসাদের যেরূপ ঐতিহাসিক খ্যাতি, কুঞ্জবনের শৈলপ্রাসাদেরও সেইরূপ একটি অপূর্ব্ব নৈপুণ্য রহিয়াছে যাহা কালে প্রসিদ্ধি লাভ করিবে। এই প্রাসাদের পরিকল্পনায় শিল্পী একটি চমকপ্রদ কৌশল ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। প্রাসাদটি দেখা মাত্রই মনে হয় ইহা দ্বিতল অথচ আসলে তাহ নহে। সূর্য্যের উদয়াচল অভিমুখী বড় প্রকোষ্ঠটি স্পষ্ট দ্বিতল অথচ ভিতরের কোঠা একতালা। এইরূপ একটি বিস্ময়ের বেষ্টনে যেন এই শোভন হর্ম্ম্য আবৃত হইয়া রহিয়াছে, ছাদপ্রকোষ্ঠে বিশালমুকুরে দূরের উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের চিত্র প্রতিফলিত করিয়া ইহা যেন অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ স্থাপনে যত্নশীল।

 বনপ্রাসাদের অনতিদূরে একটি সুগোল শৈলশিখরে শ্বেত বাঙ্গলো প্রস্তুত হইয়াছিল, শিক্রীর প্রাসাদের নীচে নীচে যেমন আবুল ফজলফৈজীর বাসগৃহ দৃষ্ট হয় বনপ্রাসাদের অনতিদূরে এই মর্ম্মরকল্পভবনেও মহারাজের বিশিষ্ট অতিথি কখনো কখনো বাস করিতেন। সেই শৈলশিখরে উঠিলেই পৃথিবী যে গোল ইহা এক পলকে চোখে ঠেকিয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ একবার সেই শৈলভবনে ছিলেন, ইহার উদয়াচল ও অস্তাচল পর্ব্বতদ্বয়ের মনোরম শোভায় তিনি মুগ্ধ হন। শুনিয়াছি তিনি নাকি শান্তিনিকেতনে তাঁহার পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতির লীলা-নিকেতন দর্শন প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন—পৃথিবীতে প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র অনেক দেখিয়াছি কিন্তু ঐ ত্রিপুরার কুঞ্জবনের শৈল শ্বেতভবন আমার স্মৃতি হইতে মলিন হইতে পারিতেছে না।

 মহারাজ যখন রাজকার্য্যে ক্লান্ত হইতেন আকবরের শিক্রীবাসের ন্যায় তিনি কখনো কখনো বন-বাস করিতে এখানে চলিয়া আসিতেন। প্রকৃতির মধুময় নিবিড় বেষ্টনে থাকিয়া সংসারের তাপ ভুলিয়া যাইতেন। তাঁহার অঙ্কিত ছবিগুলি উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ আলো করিয়া রহিয়াছে, যে কোন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পীর রচনার পার্শ্বে ইহারা আপন আসন করিয়া লইতে পারে। চিত্র সাধনার সহিত চলিত সঙ্গীতচর্চ্চা—বাদ্যযন্ত্রে তাঁহার অতুলনীয় প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটিয়াছিল। বীরচন্দ্রের হাত তাঁহার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিতে দেখা যাইত। তাঁহার মন্দ্রিত বাঁশী রেকর্ডে উঠিয়াছিল শুনিয়াছি কিন্তু ইহার প্রচার নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ হইয়া যায়।

 এই সকল বিধিদত্ত গুণে ভূষিত হইয়া তিনি যে প্রকৃতির ললাট সৌন্দর্য্য একা পান করিতেন এমন নহে কিন্তু বসন্ত উৎসবচ্ছলে কুঞ্জবনে মহা সমারোহের ঘটা পড়িয়া যাইত। প্রকৃতিপুঞ্জকে মিষ্টিমুখ করাইবার জন্য সন্দেশ রসগোল্লার রসাল পর্ব্বত সজ্জিত হইত এবং নিজে বসিয়া থাকিয়া রাজার হৃদয় লইয়া এই ভোজন উৎসবের তৃপ্তি আস্বাদন করিতেন।

 তাঁহার রাজত্বকালে রাজ্যের প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ বিভাগে উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়া শিক্ষা বিস্তারের প্রচুর সহায়তা করিয়াছে। পূর্ব্বে রাজধানীস্থ উমাকান্ত একাডেমীতে দূর প্রান্ত হইতে ছাত্রেরা পাঠের জন্য সমবেত হইত কিন্তু এই সকল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাহাদের ঘরের কোণে শিক্ষার আলয় পাইয়া ইহাদের মধ্যে যে শিক্ষা বিস্তারের প্রবল সাড়া জাগিয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য।

 এতকাল যাবৎ ত্রিপুরা রাজ্য বিদেশী ব্যবসায়ীর নিকট একরূপ terra incognito ছিল। পি. কে. দাসগুপ্তের মন্ত্রিত্বকালে মহারাজ বহুকালের সে আবরণ ঘুচাইয়া দিয়া বিদেশী ব্যবসায়ীর অর্থ আকর্ষণের পথ করিয়া দিলেন। ডাঃ ভট্টাচার্য্যের পরীক্ষার ফলে ত্রিপুরার মৃত্তিকা চা বাগানের পক্ষে উপযোগী বিবেচিত হওয়ায়, এগার বৎসরের মধ্যে চল্লিশটি বাগানের সৃষ্টি হইয়া প্রায় কোটি টাকার মত অর্থ রাজত্ব মধ্যে টানিয়া আনিল। ইহার দ্বারা রাজত্বের আয় যেমন বাড়িয়াছে অপর দিকে বহু শ্রমিকের অন্ন সংস্থানেরও উপায় হইয়াছে।

 To quote from “Tea Cultivation in Tripura” by Mr. Girija Mohan Sanyal, the Managing Director of Harishnagar Tea Co., Ltd.—

 “In the meantime an enthusiastic young chemist of Tripura, my friend Dr. A. C. Bhattacharjee, Ph. D. published his first report on the soils of Tripura State strongly recommending the soils as suitable for tea cultivation, as he found the soils to be as good as that of Surma Valley. The gardens in the Tripura State were then opened one after another. During the brief period of eleven years as many as 40 gardens have been started. Up-to-date well-equipped factories have been erected in some of the gardens and most of the gardens are progressing fairly well.”—‘Progressive Tripura’ by Apurba Chandra Bhattacharjee, Editor, Chunta Prakash. P. 60.

 লর্ড কারমাইকেললর্ড রোনাল্ডসে বাঙ্গালার এই গভর্ণরদ্বয় বীরেন্দ্রকিশোরের রাজত্বকালে রাজধানীতে শুভাগমন করেন। লর্ড কারমাইকেলের স্বহস্তে চিহ্নিত হইয়া হাওড়া নদীর উপর সেতু নির্ম্মিত হওয়ায় দক্ষিণের পর্ব্বতমালা রাজধানীর সহিত সংযোজিত হইয়া পড়ে। এই সেতুর “কারমাইকেল ব্রিজ” নামকরণে সেই স্মৃতি অদ্যাপি রক্ষিত হইতেছে। সেই সেতুর সংলগ্ন রাস্তা রোনাল্ডসে রোড রূপে ঘোষিত হইয়া নদীর উত্তর পার হইতে সেতুযোগে দক্ষিণের বন মধ্য দিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে। এই ভাবে বিশালগড় ও প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর বর্ত্তমান রাজধানীর সহিত সংযুক্ত হইয়া পড়িয়াছে এবং মোটর চলার উপযোগী হইয়াছে।

 একটি উল্কাশিখার স্যায় বীরেন্দ্রকিশোর ত্রিপুরার রাষ্ট্রগগনে ক্ষণিক জ্বলিয়া মাত্র ৪০ বৎসর বয়সে মর্ত্ত্যলোক ত্যাগ করেন। যৌবনের প্রগল্‌ভ চাঞ্চল্য যখন প্রৌঢ় বয়সের সীমারেখায় পৌঁছিয়া স্তব্ধ গাম্ভীর্য্যে সুসম্বৃত হয় সেই বয়সের কোলে পদার্পণ করিতে না করিতেই মহারাজের হৃদয়বীণার তার সমস্ত রাজ্যে এক অশ্রুময় ঝঙ্কার তুলিয়া সহসা থামিয়া গেল। দিনের পর দিন যেমন চলিয়া যায় মহারাজ তেমনি অনায়াসে আজিকার দিনেও হয়ত বার্দ্ধক্যের একটি মাত্র রেখাও মুখের উপর না ফুটাইয়া সেই চির প্রফুল্ল আননে বিরাজ করিতে পারিতেন। কিন্তু কালের নখরাঘাতে ফুটিতে না ফুটিতেই সেই কমল বৃন্তচ্যুত হইয়া ঝরিয়া গিয়াছে।

 ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে মহারাজের মৃত্যু হয়।