রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৯

(৯)

রাজর্ষি রাধাকিশোর

 ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে (১৩০৭ ত্রিপুরাব্দে) মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি পিতার উপযুক্ত পুত্র ছিলেন। প্রায় ৪০ বৎসর বয়ঃক্রম কালে তিনি রাজক্ষমতা প্রাপ্ত হন। আগরতলার বর্ত্তমান রূপ অনেকটা তাঁহারি হাতে গড়া। উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ নির্ম্মাণ দ্বারা যথার্থ রাজপুরীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইয়াছে নিঃসন্দেহে বলা যায়; ইহা বহুকালের অভাব দূর করিয়াছে। শ্রীশ্রীজগন্নাথ মন্দির, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, উমাকান্ত একাডেমী প্রভৃতি সুশোভন ইমারতে রাজধানী শোভিত করিয়াছেন। মাত্র বার বৎসর রাজত্বের পরমায়ু লইয়া তিনি যে বিচিত্র গঠন কার্য্যের পরিচয় নিয়াছেন, তাহা দেখিলে স্বতঃই মনে হয় তাঁহার অকাল মৃত্যু রাজত্বের কত বড় দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক। জাতির বহু পুণ্য ফলে এরূপ রাজার আবির্ভাব ঘটে। একটি দেশীয় রাজ্যের বাতায়নে বসিয়া তাঁহার মন


মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য বাহাদুর

ত্রিপুরার শৈলমালার বেষ্টনে আবদ্ধ থাকিতে পারিত এবং বহির্জগৎ তাঁহাকে জানিতে পারিত না কিন্তু স্বীয় অসামান্য প্রতিভাবলে স্বদেশের কল্যাণ চিন্তার সঙ্গে সমগ্র বঙ্গের কল্যাণ চিন্তাও একসূত্রে গাঁথিতে পারিয়াছিলেন দেখিয়া চমৎকৃত না হইয়া থাকা যায় না!

 তাঁহার দরবারে একটি উজ্জ্বল রত্ন ছিলেন কর্ণেল মহিমচন্দ্র ঠাকুর। তদীয় ‘দেশীয় রাজ্য’ পুস্তকে রাধাকিশোরমাণিক্য সম্বন্ধে তিনি যে বিবরণ প্রদান করিয়াছেন তাহা নিম্নে অংশতঃ উদ্ধৃত করা যাইতেছে।

 বীরচন্দ্রের মৃত্যুর পর রাধাকিশোরমাণিক্য ত্রিপুরার সিংহাসন লাভ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমারও জীবনের পার্শ্ব পরিবর্ত্তন হইল। বৃদ্ধ মহারাজের বাৎসল্য রসের চালে ৩০ বৎসর পর্য্যন্ত অতিবাহিত হইয়াছিল। হঠাৎ আমাকে শুয়া পোকা হইতে পূর্ণ প্রজাপতির রূপ ধারণ করিতে হইল। নূতন নূতন জটিল সমস্যা ও কার্য্যভার আমার স্কন্ধদেশে চাপিয়া বসিল!

 রবিবাবুর সঙ্গে রাধাকিশোরমাণিক্যের যুবরাজ-জীবনে কলিকাতায় পিতার দরবারে একবার মাত্র ক্ষণকালের জন্য দেখা হইয়াছিল। বিশিষ্ট ইংরেজ কর্ম্মচারীর হঠাৎ আবির্ভাবে আলাপ বেশীদূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। সেই মুহূর্ত্তকাল দর্শনেই একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়েন। চুম্বক যেমন লোহাকে টানে, গুণীব্যক্তি গুণীকে আকর্ষণ করে।

 “রাধাকিশোর যখন ত্রিপুরার ‘মাণিক’ হইলেন, তখন বহু দিনের সঞ্চিত অভিলাষ কার্য্যে পরিণত করিতে শক্তি সঞ্চয় করিতে লাগিলেন। যুবরাজী আমলে নানা কারণ বশতঃ নিজ রাজধানীর বাহিরের কাহাকেও ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনিবার সুযোগ পান নাই। বন্ধুবল বলিতে তাঁহার কিছুই ছিলনা। তিনি বলিতেন, অর্থবল কিম্বা যে কোন প্রকারের বলই বলনা, বন্ধুবল সকলের অপেক্ষা মূল্যবান্। তিনি প্রথমে রবিবাবুকে কাছে টানিয়া লইলেন। রবিবাবু সেইবার প্রথম আগরতলা রাজধানীতে আসিলেন, তখন বসন্তকাল, রাজধানীর উত্তর ভাগে পাহাড়ের উপব কুঞ্জবনে বসন্তোৎসবে কবি-সম্মেলনের ঘটা, কবি রবীন্দ্রনাথের যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময় উৎপাদন করিল। মহারাজ রাধাকিশোরের চরিত্রের মহানুভবতা দেখিয়া কবি পরমানন্দ লাভ করিলেন।

 “ক্রমে ক্রমে রবিবাবর যোগে স্যার আশুতোষ চৌধুরী, স্যার জগদীশ বসু, মহারাজ স্যার যতীন্দ্রনাথ, নাটোরের মহারাজ, জগদীন্দ্রনাথ প্রভৃতি বঙ্গের খ্যাতনামা মহাপুরুষেরা রাধাকিশোরের বন্ধুতার জালে আসিয়া ধরা দিলেন। একে অন্যের সহযোগে দেখিতে দেখিতে স্যার সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন (Lord Sinha) স্যার রাজেন্দ্রলাল, স্যার টি. এন. পালিত, স্যার রাস বিহারী ঘোষ, দ্বারকানাথ চক্রবর্ত্তী প্রভৃতি মহারাজের গুণাকৃষ্ট হইয়া বন্ধুবল বৃদ্ধি করিলেন। এ বন্ধুবলের দ্বারা যেমন রাজনৈতিক অনেক সমস্যার সমাধান করিলেন, অপরদিকে ত্রিপুরার রাজা বঙ্গ-হৃদয় জয় করিলেন।

 “সে সময়ে কলিকাতা সঙ্গীত সমাজে মহারাজের অভ্যর্থনার যে আয়োজন হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করা অসাধ্য। তাঁহাকে দেখাইবার নিমিত্ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁহারই রচিত “বিসর্জ্জন” নাটকে “রঘুপতির” ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। আর নাটোরের মহারাজ, রবীন্দ্রনাথ-রচিত গীত

‘রাজ অধিরাজ তব ভালে জয় মালা
ত্রিপুর-পূরলক্ষ্মী বহে তব বরণ ডালা।
ক্ষীণ-জন-ভয়-তারণ অভয় তব বাণী
দীনজন দুঃখহরণ নিপুণ তব পাণি।
অরুণ তব মুখচন্দ্র করুণ রস ঢালা।
গুণী রসিক সেবিত উদার তব দ্বারে
মঙ্গল বিরাজিত বিচিত্র উপচারে
গুণ-অরুণ-কিরণে তব সব ভুবন আলা৷’

গাহিয়া মাল্য-চন্দনে মহারাজ রাধাকিশোরের সম্বর্দ্ধনা করিয়াছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি এবং বিসর্জ্জনে ত্রিপুরার নাম অমর এবং জগদ্বিখ্যাত হইল, একি ত্রিপুরার কম গৌরবের কথা!

 “ত্রৈপুরী ১৩১৫ সালে ১৭ই আষাঢ় আগরতলার উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ের প্রশস্ত গৃহে সাহিত্য-সভা স্থাপনোপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দিত করিতে এক সভার অনুষ্ঠান হয়। সে বিরাট সভার মঞ্চোপরি একটি আসন মহারাজ রাধাকিশোরের জন্য, অপরটি সভার সভাপতি রবীন্দ্রনাথের জন্য নির্দ্দিষ্ট ছিল। সভারম্ভে রবিবাবুকে সভাপতি পদে বরণ করিয়া মহারাজ রাধাকিশোরমাণিক্য সর্ব্বসাধারণের সমসূত্রে আসন গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ সসঙ্কোচে মহারাজকে নির্দ্দিষ্ট আসনে বসিতে অনুরোধ করিলে, মহারাজ বলেন—‘সাহিত্য ক্ষেত্রে আপনার স্থান সর্ব্বোপরি, আপনি সাহিত্যের রাজা, আমি আপনার ভক্ত বন্ধুমাত্র, এ উচ্চ মঞ্চ আমার স্থান নহে।’ ত্রিপুরা রাজ্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের গভীর আকর্ষণের কারণ তিনি সেদিনকার অভিভাষণে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করিয়া ছিলেন। তাহারই কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি—

 ‘এই ত্রিপুর রাজ্যের রাজচিহ্নের মধ্যে সংস্কৃত বাক্য অঙ্কিত দেখিয়াছি “কিল বিদুর্বীরতাং সারমেকম্” বীর্য্যকেই সার বলিয়া জানিবে। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য। পার্লামেণ্ট সার নহে, বাণিজ্যতরী সার নহে, বীর্য্যই সার। এই বীর্য্য দেশ কাল পাত্র ভেদে নানা আকারে প্রকাশিত হয়। কেহ বা শাস্ত্রে বীর, কেহ বা ত্যাগে বীর, কেহ বা ভোগে বীর, কেহ বা ধর্ম্মে বীর, কেহ বা কর্ম্মে বীর।’

 “একবার কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানাচার্য্য জগদীশচন্দ্র, রবিবাবু প্রভৃতি বন্ধুদিগকে স্বীয় গবেষণার ফলাফল দেখাইবার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। তখনও রাধাকিশোরের সহিত জগদীশবাবুর সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। ১৯০০ খৃষ্টাব্দের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ আমাকে জানাইয়াছিলেন ‘আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসুর নূতন তত্ত্ব সম্বন্ধে প্রেসিডেন্সি কলেজে অদ্য রাত্রে Experiment হইবে। যদি তুমি পার উপস্থিত হইও।”

 “এই টোকাখানা লইয়া আমি মহারাজ সকাশে উপস্থিত হইলাম এবং বিদায় চাহিলাম। তিনি অভিমানভরে বলিলেন ‘তুমি যাইবে আর আমি যাইতে পারিব না? আমিও অদ্য রাত্রে যাইব।’ মহারাজ বিনা নিমন্ত্রণে উক্ত কলেজের বিজ্ঞানাগারে যথাসময়ে উপস্থিত হইয়া সকলকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন। রবিবাবু মহারাজকে দেখিয়া পুলকিত হইলেন এবং আচার্য্য জগদীশবাবুর সহিত পরিচয় করিয়া দিলেন। মহারাজ বলিলেন বাঙ্গালাতে আপনার আবিষ্কার সম্বন্ধে যে সব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় তাহা আমি পড়িয়াছি এবং বিজ্ঞান আলোচনায় আমি বিশেষ আনন্দ পাই, আমিও আপনার একজন ছাত্র।”

 “তখন সমবেত জনমণ্ডলীর সঙ্গে মহারাজ বসিয়া গেলেন এবং Experiment দেখিতে লাগিলেন। প্রায় দুই ঘণ্টাকাল লাগিয়াছিল। Experiment শেষ হইয়া গেলে ডাক্তার বসু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন আমি ইংরাজীতে বলিয়াছি, আপনি কিছু বুঝিয়াছেন কি? তখন মহারাজ তাঁহাকে বলিয়াছিলেন—‘আমি ইংরাজী জানিনা। তবে যদি আপনি আমাকে আপনার যন্ত্র দেখিতে দেন তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারিব—বুঝিতে পারিয়াছি কিনা।’ জগদীশ বাবুর যন্ত্রে হস্তক্ষেপ করা তিনি সাবধানতার সহিত নিষেধ করিয়া থাকেন। কিন্তু তিনি ঐ যন্ত্রের নিকট মহারাজকে নিয়া গেলেন এবং পরীক্ষার নয়নে তাঁহার প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। তখন মহারাজ একখানি পুঁথি লইয়া যন্ত্রের সম্মুখে ধরিয়া দিলেন এবং ডাক্তার বসুকে অনুরোধ করিলেন, ‘আপনি এক্ষণে shock দিয়া দেখুন কিন্তু respond করিতেছে না।’ তৎপর মহারাজ বইখানি উল্টাইয়া দিলেন এবং shock দিতে অনুরোধ করিলেন। তখন ঠিক যন্ত্রে respond করিয়া গেল। জগদীশ বাবু পুলকিত হইয়া গেলেন এবং বলিলেন, ‘মহারাজ, আপনি বুঝিতে পারিয়াছেন বুঝিতে পারিলাম। Lord Elgin-কে আমি বুঝাইতে পারি নাই, আমার এম. এ. ক্লাসের ছাত্রবর্গও বুঝিতে পারে না। আপনি আমাকে অবাক্ করিয়া দিলেন।

 “তারপর একদিন রবিবাবুর তলবে জগদীশ বাবুর গৃহে উপস্থিত হইয়া জানিতে পারিলাম, প্রাইভেট্ কার্য্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানাগার ব্যবহার করা কর্ত্তৃপক্ষের অভিপ্রেত নহে। রবিবাবু ইহাতে মর্ম্মান্তিক বেদনা অনুভব করিলেন। বিশেষতঃ বুঝিলেন, জগদীশ বাবুর নিজের বিজ্ঞানাগার না হইলে তাঁহার বিজ্ঞানের নূতন তথ্য আবিষ্কারের পথ চিরতরে বন্ধ হইয়া যাইবে। পরামর্শ হইল ২০,০০০ হাজার টাকা সংগ্রহ করিতে হইবে। ১০,০০০ হাজার টাকা রবিবাবু নিজে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের নিকট হইতে সংগ্রহ করিবেন, বাকি টাকার জন্য ত্রিপুর-রাজ-দরবারে তিনি স্বয়ং ভিক্ষা করিতে উপস্থিত হইবেন।

 “মহারাজ রাধাকিশোর তখন কলিকাতায় উপস্থিত ছিলেন। কবিকে ভিক্ষুক বেশে আসিতে দেখিয়া বলিলেন ‘এ বেশ আপনাকে সাজেনা, আপনার বাঁশী বাজানই কায, আমরা ভক্তবৃন্দ ভিক্ষার ঝুলি বহন করিব। প্রজাবৃন্দের প্রদত্ত অর্থই আমাদের রাজভোগ যোগায়। আমাদের অপেক্ষা জগতে কে আর বড় ভিক্ষুক আছে? এ ভিক্ষার ঝুলি আমাকেই শোভা পায়, আমাকে ইহা পূর্ণ করিতে হইবে।’ তখন যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোরের বিবাহ উপস্থিত। মহারাজ বলিলেন—‘বর্ত্তমানে আমার ভাবী বধূমাতার দু এক পদ অলঙ্কার না-ই বা হইল, তৎপরিবর্ত্তে জগদীশ বাবু সাগর পার হইতে যে অলঙ্কারে ভারত মাতাকে ভূষিত করিবেন, তাহার তুলনা কোথায়?’

 ‘জগদীশ বাবুর বিজ্ঞানাগারের ব্যবস্থা হইল। তৎপর জগদীশবাবু বৈজ্ঞানিক সমাজে স্বীয় গবেষণা প্রচারের বাসনায় বিলাত যাত্রা করেন। তথায় নানা কারণে তাঁহার আবিষ্কারের প্রতিষ্ঠা স্থাপনে বিলম্ব হইতে লাগিল। অথচ ছুটি ফুরাইয়া আসায় ভগ্নমনোরথ হইয়া তাঁহাকে ফিরিতে হইত এমনি অবস্থায় রাধাকিশোরের ঐকান্তিক উৎসাহ বাণী এবং ২০,০০০ হাজার টাকার অর্থ সাহায্য লাভে, বিলাতের বৈজ্ঞানিক সমাজের জয়মাল্য লইয়া দেশে ফিরিলেন। সে কাহিনী স্বয়ং আচার্য্য জগদীশ বাবু বিজ্ঞান মন্দিরের অভিভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করিয়াছিলেন। নীরব দাতা রাধাকিশোরের বিশেষ অনুরোধে একথা আমরা ছাড়া কেহই জানিত না—অদ্য তিনি অমর লোকে হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাইবার এ সুযোগ জগদীশ বাবু ত্যাগ করিতে পারিলেন না—

 “It was the special request of the Late Maharaja that he wished to remain unknown in this connection. He has now passed away and it is permissible to speak now of one who stood by him at a time when such friendship was most needed.” The Englishman—12th March, 1918.

 “রাধাকিশোরমাণিক্যের বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ ছিল বলিয়াই তিনি সাহিত্যিকদিগের সঙ্গ পাইতে ইচ্ছা করিতেন এবং প্রয়োজন বোধে তাঁহাদিগকে পুরস্কৃত করিতে মুক্তহস্ত ছিলেন। কিন্তু এসব কথা যাহাতে গোপন থাকে সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকিতেন। সঞ্জীবনী পাঠে কবি হেমচন্দ্র যখন অন্ধ এবং অর্থাভাবে বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছেন জানিতে পারিলেন তখন নিজ তহবিল হইতে মাসিক ৩০৲ টাকা বৃত্তি তাঁহার সাহিত্য সাধনার প্রতিদান স্বরূপ দিবার প্রস্তাব রবিবাবুর মারফত কবিবরের নিকট উপস্থিত করিলেন এবং এ সংবাদ গোপন রাখিবার ভার গ্রহণ করিতে রবিবাবুকে সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ জানাইলেন। এ সম্বন্ধে রবিবাবু আমাকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি।

 ‘হেমবাবুর সাহায্যার্থ মহারাজ যে বন্দোবস্ত করিয়াছেন তাহাতে এখানে চতুর্দ্দিকে ধন্য ধন্য পড়িয়াছে। একথা গোপন রাখা আমার সাধ্যাতীত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহাতে হেমবাবুও অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা বোধ করিতেছেন। মাঝ হইতে মহারাজের কল্যাণে যশের কিয়দংশ আমার কপালেও পড়িয়াছে।’

 “তারপর হেমবাবু সম্বন্ধে এরূপ বন্দোবস্ত হইবার দরুণ তিনি স্বচ্ছন্দে গ্রাসাচ্ছাদন পাইয়াছিলেন এবং কতকটা আরামে শেষ জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন, সে দৃশ্য আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। যখন আমি সে সংবাদ মহারাজের নিকট পেশ করি তখন মহারাজ কাঁদ কাঁদ স্বরে বলিয়াছিলেন—

 আমি বাঙ্গালার ক্ষুদ্র রাজা হইলেও, আমি বর্ত্তমানে তাঁহাকে যদি কবি মাইকেল মধুসূদনের মত দাতব্য চিকিৎসালয়ে পড়িয়া মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে হয়, তবে দেশের পরম দুর্ভাগ্য। তোমরা আমার পারিষদেরা নিশ্চয় নিরয়গামী হইবে, আর আমাকে যে কত দূর যাইতে হইবে তাহা জানিনা। তোমাদের চক্ষু কর্ণ যেন এইরূপ ব্যাপারে বন্ধ না থাকে এবং মুখ যেন সদা সর্ব্বদা খোলা থাকে।”[১]

 রাজাদিগের অনুচরেরা রাজার চক্ষু স্বরূপ হওয়ায় তাঁহারা ‘চারচক্ষু’ আখ্যা লাভ করেন। কর্ণেল মহিমচন্দ্র যে মহারাজ রাধাকিশোরের চক্ষুষ্মান্ অনুচর ছিলেন ইহাতে তিলমাত্র সন্দেহ নাই। কেবল যে তাঁহার দেখিবার মত চক্ষু ছিল তাহা নহে লিখিবার মত মনও ছিল। তাই মহারাজের সহিত বিশ্ববিখ্যাত পুরুষদ্বয়ের পরিচয় প্রসঙ্গ এরূপ নিখুঁত ভাবে পরবর্ত্তী যুগের জন্য রাখিয়া যাইতে পারিয়াছেন। রাজসভা নবরত্নে ভূষিত হইলেই বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হয় কিন্তু নবরত্ন না মিলিলেও রাজসন্নিধিতে এরূপ একটি রত্নের অস্তিত্ব থাকিলেও পরবর্ত্তী যুগের ঐতিহাসিকের রচনাকার্য্য অপূর্ব্ব সাফল্য লাভ করে।

 ১৯০৯ সালে পুণ্যস্থান সারনাথ যাত্রাকালে মোটর দুর্ঘটনায় তাঁহার প্রাণ বিয়োগ হয়।

  1. কর্ণেল মহিম ঠাকুর প্রণীত—‘দেশীয় রাজ্য’।