রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৮
(৮)
প্রতিভাবান্ বীরচন্দ্র
বীরচন্দ্রমাণিক্যের রাজত্বকাল তাঁহার গুণ গরিমায় উদ্ভাসিত হইয়া আছে। তিনি একাধারে কবি, গায়ক, সুনিপুণ বাদক ও চিত্রকর ছিলেন। সঙ্গীত প্রতিভায় ভারতবর্ষে তৎকালে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন বলিলে হয়ত অত্যুক্তি হয় না। আজ পর্য্যন্ত সঙ্গীতরসজ্ঞমহলে বীরচন্দ্র অম্লানজ্যোতিতে বিরাজ করিতেছেন। সুদূর কাশ্মীরে যখন গায়ক চূড়ামণি বিষ্ণুপুর নিবাসী যদুভট্ট রাজভবনে গান গাহিয়া চমক লাগাইতেছিলেন তখন কাশ্মীররাজ যদুভট্টকে বলেন, “আপনার দেশে একজন বাঙ্গালী রাজা সঙ্গীতে অসামান্য খ্যাতি লাভ করিয়াছেন, আপনি কি তাঁহাকে স্বরচিত সঙ্গীত শুনান নাই?” গায়কপ্রবর যদুভট্ট লজ্জায় অধোবদন হইলেন। তিনি তৎপর কলিকাতা নিবাসী রাজাদিগম্বর মিত্রের পরিচয়পত্র লইয়া বীরচন্দ্রের দরবারে উপস্থিত হইলে মহারাজ তাঁহাকে সাদরে গ্রহণ করিলেন।
“এবার বিধাতা ত্রিপুর দরবারে মণিকাঞ্চন যোগ করিয়া দিলেন। সে মণিকাঞ্চন যোগে তৎকালে বীরচন্দ্রের দরবারে যে সঙ্গীত উৎসব দেখিতে পাইয়াছিলাম তাহা স্মরণে আসিলে মরমে আজিও ব্যথা পাই। এখন পর্য্যন্ত কলিকাতা, কাশী প্রভৃতি স্থানে ভট্ট মহাশয়ের স্বরচিত সঙ্গীত এবং তাহাতে ত্রিপুরার বীরচন্দ্র নাম সংযুক্ত থাকা শুনা যায়।
“বীরচন্দ্রের দরবারে শ্রীযুক্ত মদনমোহন মিত্র ছিলেন রাজকবি। সঙ্গীত শাস্ত্রে তাঁহার সহায় ছিলেন প্রসিদ্ধ তানসেনের বংশধর বীণ-বাদ্যকর কাশীমালী খাঁ। তিনি লক্ষ্ণৌ নিবাসী ছিলেন। কাশ্মীর হইতে আসিয়া জুটিলেন কুলন্দর বক্স নাট্যাচার্য্য। ইনি সঙ্গীতের হাবভাব দেখাইয়া সুন্দর নাচিতে পারিতেন, তাঁহার উপাধি ছিল কথক। গোয়ালিয়র রাজ্য হইতে আসিলেন প্রসিদ্ধ হায়দর খাঁ, ইনি ছিলেন সুরশিঙ্গা এবং এসরাজ বাদ্যকর। কলিকাতা নিবাসী পঞ্চানন্দ মিত্র সঙ্গীতশাস্ত্ররসে ডুবিয়া যখন সর্ব্বস্বহারা হইয়াছিলেন, তখন তিনি বীরচন্দ্রের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। সঙ্গীত বিদ্যাবিশারদ বীরচন্দ্রের দরবারে তিনি পাখোয়াজ ঢোল উত্তম বাজাইতে পারিতেন এবং তাঁহার চেহারাখানা ছিল শিবতুল্য। পঞ্চানন্দ মিত্র আর একজন ভদ্র সন্তানকে আকর্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি স্বর্গীয় স্যর রমেশ মিত্রের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কেশব মিত্র। তিনি শিক্ষিত এবং সঙ্গীত শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন।
“মহারাজ বীরচন্দ্র ছিলেন বাংলার বিক্রমাদিত্য। তিনি একাধারে বৈষ্ণবকাব্যরসিক কবি এবং সঙ্গীত ও ললিতকলাবিদ্ ছিলেন। প্রিয়তমা প্রধানা মহিষীর অকাল মৃত্যুতে বীরচন্দ্রের হৃদয় অসহনীয় প্রিয়-বিরহে শোকাকুল হইয়া পড়ে। তখন তিনি বিরহীর মর্ম্মবেদনা কবিতার লহরে লহরে গাঁথিতে ছিলেন।
“দেবি! তুমি ত স্বরগপুরে, জানিনাকো কতদূরে
কোন্ অন্তরালদেশে করিতেছ বাস।
পশিতে কি পারে তথা মানবের আশালতা
বিরহের অশ্রুজল প্রাণ ভরা ভালবাসা?
হেথা আমি আছি পড়ে হৃদয়ের ভাঙ্গা ঘরে
গণিতেছি সারাদিন জীবনের বেলা
যেন রে উপলদেশে সাথী হীন একা বসে
জানিনা ফুরাবে কবে এ মরতের খেলা৷”
“এমনি সময় কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথ বিলাত হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া “ভগ্নহৃদয়” নামে এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। কবি বীরচন্দ্রের তখনকার মানসিক ভাবের সহিত “ভগ্নহৃদয়ের” কবিতাগুলি সায় দিয়াছিল। গুণগ্রাহী বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের তখনকার এই কাঁচা লেখার মধ্যেও তাঁহার অদ্যকার বিশ্ববিমোহন কাব্যপ্রতিভার প্রথম সূচনা দেখিতে পাইয়া তাঁহার প্রাইভেট সেক্রেটারী রাধারমণ ঘোষকে কলিকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট “ভগ্নহৃদয়” কাব্যগ্রন্থ মহারাজকে প্রীত করিয়াছে, তজ্জন্য অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতে প্রেরণ করেন। এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার জীবন স্মৃতিতে লিখিয়াছেন—
‘মনে আছে এই লেখা বাহির হইবার কিছুকাল পরে কলিকাতায় ত্রিপুরার স্বর্গীয় মহারাজ বীরচন্দ্রমাণিক্যের মন্ত্রী আমার সহিত দেখা করিতে আসেন। কাব্যটি মহারাজের ভাল লাগিয়াছে এবং কবির সাহিত্যসাধনার সফলতা সম্বন্ধে তিনি উচ্চ আশা পোষণ করেন, কেবল এইটি জানাইবার জন্যই তিনি তাঁহার অমাত্যকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।’[১]
“মহারাজ বীরচন্দ্রমাণিক্য বাহাদুরের আকৃতি নাতিদীর্ঘ নাতি খর্ব্ব, বর্ণ বিশুদ্ধ গৌর, তিনি সর্ব্বাঙ্গসুন্দর, মুখশ্রী অনেকটা বাঙ্গালীর ন্যায়, চক্ষু সুন্দর, নাসিকা উন্নত।
“মহারাজ বাঙ্গালা ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন, তিনি একজন সুকবি। তৎপ্রণীত দুইখানা কবিতাপুস্তক আমরা দর্শন করিয়াছি। উভয়গ্রন্থই গীতিকাব্য। তাঁহার গীতির অনেকগুলি ‘বর্জ্জি’ বুলিতে রচিত, সেগুলি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিগণের অনুকরণে লিখিত; অনুকরণ হইলেও তাহাদের ভাব সরল, মধুর ও মর্ম্মস্পর্শী। তাঁহার সমস্ত গীতি কবিতাই প্রেমের কাকলিপূর্ণ ও মধ্যে মধ্যে দর্শনাত্মক ভাবের ছায়াপাতে সমুজ্জ্বল হইয়াছে। দুঃখের বিষয় এই যে এই সকল সুন্দর কবিতাকুসুমের সৌরভ আগরতলার গণ্ডি অতিক্রম করিয়া কদাচিৎ কাহাকেও আকুলিত করিয়া থাকে। সেগুলি প্রকাশ করিতে মহারাজ অনিচ্ছুক। কিন্তু প্রকাশিত হইলে তিনি বঙ্গীয় কবি সমাজে উচ্চ আসন পাইতেন সন্দেহ নাই।
“মহারাজ উর্দ্দূ ভাষায় মাতৃভাষার ন্যায় আলাপ করিতে পারেন এবং সঙ্গীত শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত। তিনি পানাদি দোষবর্জ্জিত, বুদ্ধিমান ও অত্যন্ত বাকপটু। তাঁহার বাক্যন্যাসশক্তি এইরূপ প্রবল যে তৎপ্রতি ভীষণ বিদ্বেষভাবাপন্ন কোন ব্যক্তি ক্ষণকাল তাঁহার সহিত আলাপ করিলে, সেই ভাব পরিত্যাগ না করিয়া থাকিতে পারেন না।”[২]
শাস্ত্র ও সৎসাহিত্য প্রচারে তিনি প্রভূত অর্থ ব্যয় করিয়া বাঙ্গালা দেশের বহু উপকার সাধন করিয়া গিয়াছেন। শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থের একখানি রাজসিক সংস্করণ করিতে ইচ্ছুক হইয়া তিনি পণ্ডিত রামনারায়ণ বিদ্যারত্নকে রাজধানীতে আনাইয়া ছিলেন কিন্তু গঙ্গাস্নান করিতে না পারিয়া এখানে থাকিতে অসম্মত হওয়ায় বিদ্যারত্ন দ্বারা বহরমপুরে থাকিয়াই উক্ত পুস্তক সম্পাদনের ব্যবস্থা করেন এবং তজ্জন্য প্রেস ক্রয় করা হইয়াছিল এরূপ শুনিয়াছি। ঐ পুস্তক মুদ্রণে প্রায় অর্দ্ধ লক্ষ ব্যয় হইয়া থাকিবে। ভাগবতের এইরূপ বহু টীকাযুক্ত শোভন সংস্করণ অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। ঐ প্রেসে বৈষ্ণবস্মৃতি শ্রীহরিভক্তিবিলাস মুদ্রিত হয়। ব্রহ্ম সূত্রের গোবিন্দভাষ্য সম্বলিত একখানি সংস্করণ প্রচারের সাহায্য দ্বারা তিনি বঙ্গদেশে দার্শনিক সমাজে সুপরিচিত হইয়াছেন। দীনেশচন্দ্রের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ মহারাজের সাহায্যেই প্রকাশিত হইয়া বঙ্গসাহিত্যের একটি অভাব পূর্ণ করিতে পারিয়াছিল। ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে (১৩০৬ ত্রিপুরাব্দে) কলিকাতা মহানগরীতে মহারাজ পরলোকগমন করেন।
- ↑ কর্ণেল মহিমচন্দ্র ঠাকুর প্রণীত—দেশীয় রাজ্য।
- ↑ কৈলাস সিংহ প্রণীত রাজমালা।