রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৭
(৭)
রাজ্যশাসনে বীরচন্দ্র
১৮৬২ খৃষ্টাব্দে (১২৭২ ত্রিপুরাব্দে) মহারাজ ঈশানচন্দ্রের লোকান্তর প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই সিংহাসন লাভের জন্য এক অভূতপূর্ব্ব কলহের সৃষ্টি হইল। পূর্ব্বকালে মুক্ত কৃপাণের সম্মুখে যে বিবাদের মীমাংসা হইয়া যাইত বর্ত্তমানে আইনের কবলে পড়িয়া উহা দেশ দেশান্তর ঘুরিয়া একেবারে বিলাত যাইয়া তবে নিম্পত্তি লাভ করিল।
ঈশানচন্দ্রমাণিক্যের রোবকারীর বলে বীরচন্দ্র রাজক্ষমতা লাভ করেন এবং স্বীয় পুত্রদ্বয় ব্রজেন্দ্র ও নবদ্বীপচন্দ্র যথাক্রমে যুবরাজ ও বড়ঠাকুর নিযুক্ত হন। ঐ রোবকারী কোর্টে দাখিল করা হয়। তারিখ দৃষ্টে বুঝা যায় উহা মহারাজের মৃত্যুর পূর্ব্বদিন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। কিন্তু বীরচন্দ্রের বিবদমান ভ্রাতৃদ্বয় চক্রধ্বজ ও নীলকৃষ্ণ ‘এই রোবকারী অসত্য’ বলিয়া আদালতে দাবিদাররূপে আবেদন উপস্থিত করেন। ত্রিপুরার ম্যাজিষ্ট্রেট চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের নিকট এ সম্বন্ধে রিপোর্ট করেন। কমিশনার সাহেব গভর্ণমেণ্টকে বীরচন্দ্রের অনুকূলে মন্তব্য দিয়া লিখিলেন, ‘রোবকারী মতে বর্ত্তমানে যে ব্যবস্থা হইয়াছে তাহা চলিতে থাকুক, যাহারা ঐ রোবকারী মানেন না তাঁহারা বরং আদালত যোগে স্ব-স্ব দাবী প্রমাণ করুক।’ লেফটেনেণ্ট গভর্ণর উক্ত মন্তব্য অনুমোদন পূর্ব্বক বীরচন্দ্রকে defacto রাজা রূপে স্বীকার করেন এবং অন্য দাবিদারগণকে বিচারালয়ে নিজ নিজ পথ খুঁজিয়া লইতে পরামর্শ দেন।
এই ব্যবস্থা অনুযায়ী রাজকার্য্য অবাধে চলিতে লাগিল। প্রভু বিপিনবিহারীর শাসন ক্ষমতা তখনও অব্যাহত ছিল, তাঁহার কঠোর শাসনে রাজার আশ্রিত ব্যক্তিরাও রেহাই পাইত না। তাই তৎপ্রতি রুষ্ট হইলেও মুখ ফুটিয়া কেহই কিছু বলিতে পারিত না। ঈশানচন্দ্রের অন্তৰ্দ্ধানে তাহারা মাথা তুলিতে লাগিল। তীক্ষ্ণদৃষ্টি বীরচন্দ্র এইসব লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। কিয়ৎকাল পূর্ব্বে গুরুর কড়া শাসনে ঠাকুর লোকগণের বৃত্তি হ্রাস ও ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। বিচার সম্পর্কে সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত হওয়ায় তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন এইবার সুযোগ মিলিয়াছে। তখন কৌশলে বীরচন্দ্রকে তাঁহারা বুঝাইয়া দিলেন “হয় আমাদিগকে বিদায় দিন, নচেৎ গুরুকে অবসর করুন।”
বীরচন্দ্র বাক্যের তাৎপর্য্য বুঝিলেন। তাঁহার ভয় হইল, ইঁহাদের বিরক্তিতে শত্রু-পক্ষের শক্তি-বৃদ্ধি হইবে। যদি ইহাদিগকে খুসী করিবার জন্য প্রভুকে কর্ম্মচ্যুত করেন তবে প্রভু চক্রধ্বজ ও নীলকৃষ্ণের সহিত মিলিত হইতে পারেন। এইভাবে বীরচন্দ্র দেখিলেন প্রভুকে অবরুদ্ধ করা ছাড়া আর উপায় নাই। অদৃষ্টের চক্র পরিবর্ত্তনে কাহার কোন্ অবস্থা হয় কিছুই বলা যায় না। যে বিপিনবিহারীর প্রতাপে সকলে কাঁপিত আজ তিনি সকল দৃষ্টির অগোচরে অবরুদ্ধ। ভাগ্যবিপর্য্যয়ের দিক দিয়া প্রভু বিপিনবিহারীর সহিত Cardinal Wolsey-র অনেকটা ঐক্য দৃষ্ট হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায়ই প্রভুর মৃত্যু ঘটে।
প্রভু বিপিনবিহারীর হস্তে ন্যস্ত ক্ষমতা পুনরায় ব্রজমোহন ঠাকুরের স্বন্ধে অর্পিত হইল। ইহাতে ঠাকুরগণ অত্যন্ত প্রীত হইলেন এবং অল্পকাল মধ্যেই পূর্ব্ববৎ স্ব-স্ব প্রাধান্য খ্যাপনে তৎপর হইলেন। বীরচন্দ্র এই পরিবর্ত্তন বিশেষ ভাবেই লক্ষ্য করিলেন কিন্তু বিচারালয়ের আইনের যুদ্ধে, তখন ঘন ঘটা হইয়াছিল তাই চুপ করিয়া সহিয়া গেলেন। ঠাকুরগণের স্ব-স্ব প্রধানভাব কুমিল্লা ম্যাজিষ্ট্রেটেরও চক্ষু এড়ায় নাই, তাই তিনি চট্টগ্রামের কমিশনারের নিকট এক মন্তব্য প্রেরণ করেন, তাহাতে উক্ত হইয়াছিল বীরচন্দ্র, ঠাকুরগণের প্রাধান্যে কিছুমাত্র হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না, গুরু বিপিনবিহারীর শাসনে রাজ্যে টুঁ শব্দ ছিল না। ইহাতে বিপিনবিহারীর কার্য্যদক্ষতার প্রশংসাই পাওয়া যাইতেছে।
কুমিল্লার আদালতে বীরচন্দ্রের পক্ষে প্রায় অধিকাংশ ঠাকুর রোবকারী সমর্থন করিয়া সাক্ষ্য দেন। ঈশানচন্দ্রের রাণী মহোদয়ারা ঐ রোবকারী সমর্থন করিয়া কোর্টে বীরচন্দ্রের অনুকূলে আবেদন করেন। কতিপয় ঠাকুর, নীলকৃষ্ণ ও চক্রধ্বজের পক্ষে উহা অসত্য এই মর্ম্মে সাক্ষ্য দেন। কিন্তু স্থানীয় বিচারে বীরচন্দ্রের হার হইল। তখন তিনি হাইকোর্টে আপীল করিলেন। সেখানে বীরচন্দ্রেরই জয় হইল। অতঃপর ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে এই মামলা প্রিভিকৌন্সিলেও গিয়াছিল কিন্তু হাইকোর্টের ডিক্রিই অক্ষুণ্ণ রহিল।
তখন বীরচন্দ্র অভিষেক ক্রিয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। গভর্ণমেণ্ট হইতে তাঁহাকে খিলাত ও সনন্দ প্রদান করা হয়। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে (১২৭৯ ত্রিপুরাব্দে, ২৭শে ফাল্গুন) মহা সমারোহে বীরচন্দ্রের অভিষেক সম্পন্ন হয়। তৎপরবর্ত্তী বর্ষে (১২৮০ ত্রিপুরাব্দে) ১৬ই ভাদ্র বীরচন্দ্রমাণিক্য স্বীয় জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার রাধাকিশোরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। মহারাজ রামমাণিক্য হইতে বড়ঠাকুর পদ সৃষ্ট হয়, সেই হইতে বড়ঠাকুর পদের জন্য নানা বিড়ম্বনার সূত্রপাত ঘটিয়াছে, রাজার উত্তরাধিকার নির্ব্বাচনে ইহা দ্বারা জটিলতা এত বাড়িবে জানিলে রামমাণিক্য হয়ত ইহার প্রবর্ত্তন করিতেন না। রাধাকিশোর যৌবরাজ্য লাভ করায় নবদ্বীপচন্দ্র মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া তদীয় মাতা সহ কুমিল্লা চলিয়া আসেন, ইহার কিছুকাল পূর্ব্বে ঈশানচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ তনয় ব্রজেন্দ্রচন্দ্র পরলোক গমন করেন। অতঃপর নবদ্বীপচন্দ্রের জন্য মাসিক ৫২৫৲ টাকা বৃত্তি নির্দ্ধারিত হয়।
বীরচন্দ্র মাণিক্যের শাসন কালে ত্রিপুরা রাজ্য প্রাচীন যুগের শাসন পদ্ধতির ছাপমুক্ত হইয়া বর্ত্তমান ব্রিটিশ তন্ত্রে অনুপ্রাণিত হইয়াছে। তাঁহারই সময় সতীদাহ নিবারিত হয়।
রুষরাষ্ট্রে পিটার যেমন নূতন আকার দান করিয়া যশস্বী হইয়াছেন, বীরচন্দ্রমাণিক্যও তেমনি ত্রিপুরা রাজ্যকে এক নূতন রূপ দান করিয়া গিয়াছেন। রাজ্যের এই নূতন কাঠাম প্রস্তুত করিয়াছেন বাবু নীলমণি দাস। মহারাজের আবেদন অনুযায়ী ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষ নীলমণি বাবুকে সিভিল সার্ভিস হইতে পরিবর্ত্তন করিয়া ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দের ২৭শে আগষ্ট ত্রিপুরার সর্ব্বপ্রকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত দেওয়ানরূপে নিয়োগ করেন।
“নীলমণি দাস কার্য্যভার গ্রহণ করিয়া ব্রিটিশ অনুকরণে আবকারী বিভাগ, ষ্ট্যাম্প সৃষ্টি, দলিল ও রেজেষ্টারির নিয়ম প্রবর্ত্তিত করেন। তিনি দেওয়ানী ও ফৌজদারী সংক্রান্ত আইন সংশোধন এবং তমাদি আইন প্রণয়ন করেন। ত্রিপুরার দক্ষিণাংশকে উত্তর বিভাগের ন্যায় উন্নত করিবার অভিপ্রায়ে উদয়পুর বিভাগ সৃষ্টি করিয়া বাবু উদয়চন্দ্র সেনকে তাহার শাসন কার্য্যে নিযুক্ত করেন। কিন্তু উদয়পুর বর্ষাকালে নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর হইয় উঠে। এজন্য সোণামুড়া নামক স্থানে সদর ষ্টেশন স্থাপন করা হইল।
“বাবু নীলমণি দাস সর্বপ্রকার বিশৃঙ্খলা দূর করিয়া আয় বৃদ্ধি ও ঋণ পরিশোধের পন্থা পরিষ্কার করিয়াছিলেন।
এই সময় নীলমণি বাবুর যত্বে ত্রিপুরা রাজ্যে উকিলদিগের পরীক্ষার প্রথা প্রবর্ত্তিত হয়।”[১]
নীলমণি দাসের কার্য্যকালের পর খ্যাতনামা শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহকারী মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। তখন দীনবন্ধু ঠাকুর মন্ত্রী ছিলেন। তৎকালে প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব তত্ত্বজ্ঞ রাধারমণ ঘোষ কুমারগণের শিক্ষকরূপে কার্য্যে প্রবেশ করেন, পরে অসামান্য প্রতিভা বলে মহারাজের প্রাইভেট সেক্রেটারী পদে উন্নীত হন। এই সময়ে মহারাজ, সমরেন্দ্রচন্দ্রকে বড়ঠাকুর পদ প্রদান করেন। ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে রায় উমাকান্ত দাস বাহাদুর মন্ত্রী নিযুক্ত হন, তৎপূর্ব্বে ধনঞ্জয় ঠাকুর ও রায় মোহিনীমোহন বর্দ্ধন বাহাদুর মন্ত্রী পদে নিযুক্ত ছিলেন। ইহারা প্রত্যেকেই স্বনামধন্য পুরুষ এবং স্ব স্ব শক্তি অনুসারে ত্রিপুরা রাজ্যের কল্যাণ করিয়া গিয়াছেন। মহারাজ বীরচন্দ্রের রাজত্বকালে উমাকান্ত বাবুর উদ্যোগে ও যুবরাজ বাহাদুরের উৎসাহে স্থানীয় ইংরেজী বঙ্গ বিদ্যালয় হাইস্কুলে পরিণত হয়। রাধাকিশোরমাণিক্যের শাসনকালে উত্তম সৌধ নির্ম্মাণ করিয়া ঐ বিদ্যালয়টিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং উমাকান্ত বাবুর নামে ইহার ‘উমাকান্ত একাডেমী’ নামকরণ হয়। এই সৌধ সহরের সৌন্দর্য্যস্থল হইয়া মন্ত্রীবরের বিদ্যোৎসাহিতার ও মহারাজের ঔদার্য্যের কীর্ত্তি যুগপৎ ঘোষণা করিতেছে।
- ↑ কৈলাস সিংহ প্রণীত রাজমালা।