রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৬

(৬)

ঈশানচন্দ্রমাণিক্য

 পিতার মৃত্যুর পর যুবরাজ ঈশানচন্দ্র ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে (১২৫৯ ত্রিপুরাব্দে) সিংহাসন লাভ করেন। কিন্তু নবীন মহারাজের স্কন্ধে ১১ লক্ষ টাকার ঋণভার রাজমুকুট ধারণ করিবার সঙ্গে সঙ্গেই ন্যস্ত হইল। ইহাতে রাজত্বের প্রকৃত সুখ তাঁহার ভাগ্যে ঘটিল না। রাজপরিবারের সম্পর্কিত বলরাম হাজারির হস্তে রাজ্য ও জমিদারীর ভার অর্পিত হইল। হাজারি নিতান্ত কঠোর প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাঁহার কঠোর শাসনে আয় বৃদ্ধি পাইবে এবং ঋণ দেওয়া সহজ হইবে এরূপ ভাবিয়া মহারাজ শান্তি পাইয়াছিলেন কিন্তু ঘটনা দাঁড়াইল অন্যরূপ। বলরাম ও তাঁহার ভ্রাতা শ্রীদামের কঠোর হস্তচালনায় চতুর্দ্দিকে অসন্তোষের বহ্নি চাপা ভাবে জ্বলিতে লাগিল, পরিশেষে একদিন আত্মপ্রকাশ করিল। পরীক্ষিৎ ও কীর্ত্তি নামে দুইজন পার্ব্বত্য সরদার কুকি সৈন্য লইয়া গভীর রজনীতে বলরাম ভবন ঘেরাও করিল। বলরাম পলায়ন করে কিন্তু শ্রীদাম কীর্ত্তির হস্তে হত হন। মহারাজ ঈশানচন্দ্র বলরামের শত্রুগণকে বন্দীশালায় আটক করিলেন।

 কিন্তু বলরামের প্রকৃতি পরিবর্ত্তন হইল না। বলরাম ইশানচন্দ্রমাণিক্যকে বধ করিবার জন্যও ষড়যন্ত্র চালাইতে লাগিলেন। সর্দ্দার খাঁ, ছোবান খাঁ প্রভৃতির সহিত পরামর্শ চলিতে লাগিল। বলরামের অভিপ্রায় ছিল যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্রকে সিংহাসন প্রদান করা। কিন্তু ষড়যন্ত্র বাহির হইয়া পড়িল এবং ঈশানচন্দ্র বিপক্ষ নেতৃগণকে ধৃত করিয়া রাজ্য হইতে বাহির করিয়া দিলেন। এইরূপ গুরুতর ষড়যন্ত্রের ফলে কাহারও গুরুদণ্ড না হওয়া মহারাজের মহত্ত্বের পরিচায়ক সন্দেহ নাই।

 অতঃপর ব্রজমোহন ঠাকুর বলরামের পদে অধিষ্ঠিত হইয়া রাজ্য ও জমিদারী পরিচালন করিতে লাগিলেন। ১২৬১ ত্রিপুরাব্দে যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্র পরলোক গমন করেন। মহারাজ ঈশানচন্দ্রের বড় মহারাণী রাজলক্ষ্মী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। মধ্যম মহারাণী মুক্তাবলীর গর্ভে কুমার ব্রজেন্দ্রচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন, চতুর্থ মহারাণী জাতীশ্বরী দেবীর গর্ভে কুমার নবদ্বীপচন্দ্র জাত হন।

 ব্রজমোহন ঠাকুর মহা ফাঁপরে পড়িলেন। ঋণভার কমাইবার কোন উপায় খুজিয়া না পাইয়া অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন এদিকে ঋণের দায়ে চাকলে রোশনাবাদ বিক্রয় হইবার মত হইয়া উঠিল। মহারাজ ঈশানচন্দ্র ব্রজমোহনের অবস্থা বুঝিয়া যোগ্যতম লোকের অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়কে (যিনি পরে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন) উক্ত পদে মনোনীত করিবার জন্য মহারাজের সান্নিধ্যে আহ্বান করিয়া আনা হয়। এমন সময় রাজগুরু প্রভু বিপিনবিহারী গোস্বামী উক্ত নির্ব্বাচনে বাধা দেন। মহারাজের গুরুভক্তি অপরিসীম ছিল, তাই তিনি মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের নিয়োগ পত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়া তাঁহাকে বিদায় করিয়া দেন এবং সেই ভার স্বীয় গুরুর চরণে সমর্পণ করেন। তেজস্বী বিপিনবিহারী উহা গ্রহণ করেন।

 তখন হইতে বিপিনবিহারী রাজকার্য্যে মহারাজের কর্ণধার হইলেন। তিনি যে মহারাজের অকৃত্রিম শুভানুধ্যায়ী ছিলেন ইহাতে তিলমাত্র সন্দেহ নাই। যাহাতে রাজত্ব সুপরিচালিত হয় ইহাতে বিন্দু পরিমাণেও তাঁহার যত্নের ক্রটি ছিল না। চাণক্যের ন্যায় কঠোর শাসনে অচিরে রাজ্যমধ্যে জড়তা দূর হইল এবং আয় বাড়িয়া চলিল। যেমন রাজত্বের আয় বাড়িল তেমনি ব্যয় কমাইয়া দিলেন, ইহাতে রাজভাণ্ডারে বেশ সঞ্চয় হইতে লাগিল এবং সঞ্চিত অর্থে ঋণ শোধ হওয়ায় চাপ কমিয়া আসিতে লাগিল।

 ইতিমধ্যে সিপাহী বিদ্রোহের তুমুল বিপ্লব ঝটিকার ন্যায় দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িল। চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সৈন্যবাহিনী ত্রিপুরা রাজ্যের অভিমুখে আসিতেছে জানিয়া মহারাজ ঈশানচন্দ্র তৎক্ষণাৎ ইহাদের গতিরোধ করিবার জন্য স্ব-সৈন্য পাঠাইয়া দেন। সিপাহীরা মহারাজের নিকট হইতে আশ্রয় পাওয়ার পরিবর্ত্তে বাঁধাপ্রাপ্ত হইয়া কাছাড় অভিমুখে প্রস্থান করে। যাহারা ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় লইয়াছিল তাহাদিগকে তিনি ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষের হস্তে সমর্পণ করেন। এইভাবে এক ভীষণ বিপদের মধ্য হইতে ত্রিপুরা রাজ্যকে স্বীয় প্রতিভাবলে রক্ষা করেন। মহারাজের শক্রস্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁহার ও রাজত্বের ঘোর অনিষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে তিনি যে সিপাহীদের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করিয়াছিলেন ইহা প্রমাণ করিতে চেষ্টা পাইয়াছিল কিন্তু ব্রিটিশ বিচারের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সে সকল দুরভিসন্ধি প্রকাশ পাইয়া যায় এবং ত্রিপুরেশ্বরের গুণে ত্রিপুরা রাজ্য অক্ষতভাবে সে অগ্নিপরীক্ষায় টিকিয়া উঠে।

 এই সময়ে কুকিগণের প্রভাব লক্ষিত হওয়ায় গ্রেহাম সাহেব আগরতলা আসেন। যুবরাজ ও বড় ঠাকুর পদে তখন পর্য্যন্ত কাহাকেও নিযুক্ত করা হয় নাই—ইহাও গ্রেহাম সাহেবের আলোচ্য বিষয় ছিল। ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে গভর্ণমেণ্টের নিকট তিনি এক সুদীর্ঘ রিপোর্ট করেন, ইহাতে মহারাজের ভাব বুঝিয়া তিনি লিখিয়াছিলেন যে নীলকৃষ্ণ ও বীরচন্দ্রকে উপেক্ষা করিয়া স্বীয় পুত্রদ্বয়কে উক্ত পদে নির্ব্বাচন করেন ইহাই মহারাজের মনোগত অভিপ্রায়। শেষ পর্য্যন্ত কর্ত্তৃপক্ষ এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন নাই, ‘মহারাজের ইচ্ছার উপরই ইহা নির্ভর করে’ এরূপ জানাইয়া মহারাজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন।

 এ দিকে গুরু বিপিনবিহারী মহারাজের আয় বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য করিয়া চাকলে রোশনাবাদের অন্তর্গত নিষ্কর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য চেষ্টা পাইতে লাগিলেন। যেখানে দানপত্র দুর্ব্বল সেখানে আইনের সাহায্যে উহাকে অসিদ্ধ প্রমাণ করিতে লাগিলেন। মহারাজের নিকট ইহা নিতান্ত অপ্রীতিকর ঠেকিয়াছিল তাই তিনি প্রভুর পদযুগল ধরিয়া এ বিষয়ে নিবৃত্ত হইতে প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু প্রভু দমিলেন না, তিনি মহারাজকে বলিলেন—“বাবা, তোমার সমস্ত পাপ আমি গ্রহণ করিলাম। লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত করিয়া আমি তোমার আয় প্রায় লক্ষ টাকা বৃদ্ধি করিব।”

 এইরূপে বিপিনবিহারী মহারাজের নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও একজন রাজপুরোহিতের ব্রহ্মোত্তর বাজেয়াপ্ত করিয়া তাহার কর ধার্য্য করিলেন, তাহার বন্দোবস্তী পাট্টাতে মহারাজের মোহর অঙ্কিত করিবার জন্য গুরু সেই পাট্টা লইয়া রাজসমক্ষে উপস্থিত হইলে মহারাজ পুনর্ব্বার গুরুকে বলিলেন, “প্রভো! এই কার্য্য হইতে বিরত হউন!”

 “গুরুভক্তি পরায়ণ নৃপতি গুরুর আজ্ঞা পালন করিবার জন্য “শ্রীগুরু আজ্ঞা” মোহর তাহাতে অঙ্কিত করিলেন। কিন্তু ধর্ম্মভয়ে ধর্ম্মভীরু নৃপতির হৃদয় ও হস্ত কম্পিত হইল। ইহার কয়েক মুহুর্ত্ত পরে মহারাজ একখণ্ড চিঠি লিখিতে ইচ্ছা করিয়া লেখনী ধারণ করিলেন কিন্তু লেখনী সঞ্চালন করিতে পারিলেন না, তাঁহার দক্ষিণ হস্ত কম্পিত হইতে লাগিল। এইরূপে ৩৩ বৎসর বয়ঃক্রমে (১২৭১ ত্রিপুরাব্দে) মহারাজ ঈশানচন্দ্রমাণিক্য জীবনান্তকর বাতব্যাধি রোগে আক্রান্ত হইলেন।”

 “মহারাজ ঈশানচন্দ্র রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্ব্বে সপরিবারে বাস করিবার জন্য একটি নূতন অট্টালিকা নির্ম্মাণ আরম্ভ করেন। সেই অট্টালিকা প্রস্তুত হইলে ১২৭২ ত্রিপুরাব্দের ১৬ই শ্রাবণ মহারাজ নূতন গৃহে প্রবেশের দিন অবধারণ করিলেন। নির্দ্দিষ্ট ১৬ই শ্রাবণ পুত্র কলত্র সমভিব্যাহারে মহারাজ ঈশানচন্দ্র নূতন নিকেতনে প্রবেশ করিলেন। তৎপর দিবস (প্রায় ১০ ঘটিকার সময়) অসাধারণ গুরুভক্তি-পরায়ণ প্রজারঞ্জক মহারাজ ঈশানচন্দ্রমাণিক্য ৩৪ বৎসর বয়ঃক্রমে পরলোক গমন করেন।”[১]

  1. কৈলাসসিংহ প্রণীত রাজমালা—পৃঃ ১৭৪-৭৬।