রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৫
(৫)
কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য
১৮২৬ খৃষ্টাব্দে (১২৩৬ সনে) রামগঙ্গামাণিক্যের অনুজ কাশীচন্দ্র রাজক্ষমতা পরিচালন করিতে আরম্ভ করেন। ঐ বৎসর ফাল্গুন মাসে ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষ তাঁহাকে খিলাত প্রদান করেন। ইহার পর তাঁহার অভিষেক কার্য্য সম্পন্ন হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই রামগঙ্গামাণিক্য-তনয় কৃষ্ণকিশোর যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হন। তখন কাশীচন্দ্রের পুত্র কুমার কৃষ্ণচন্দ্রের বয়স মাত্র ৩ বৎসর। সেই শিশু অবস্থায়ই তাঁহাকে বড়ঠাকুর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের আয়ু শেষ হইয়া আসিয়াছিল, তাঁহার মৃত্যুতে মহারাজ কাশীচন্দ্র হৃদয়ে অতীব ব্যথা পাইলেন। পুত্রের মৃত্যুতে শান্তি না পাইয়া তিনি উদয়পুরে চলিয়া আসেন এবং ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে (১২৩৯ সনে) মাত্র তিন বৎসর রাজত্ব করিয়া পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে মহারাজের মাত্র ৪১ বৎসর হইয়াছিল।
১৮২৯ খৃষ্টাব্দে (১২৩৯ সনে) যুবরাজ কৃষ্ণকিশোর রাজদণ্ড গ্রহণ করেন, এবং কিছুকাল পরে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁহারই রাজত্বকালে রাজমালার শেষভাগ রচিত হয়। ইহাতে কাশীচন্দ্র মাণিক্য অবধি রাজ্যের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের রাজত্ব কালের প্রসিদ্ধ ঘটনা বর্ত্তমান আগরতলার স্থান নির্ব্বাচন এবং নগর নির্ম্মাণ পূর্ব্বক সেখানে রাজপাট স্থাপন।
মহারাজ কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের সিংহাসন আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই তদীয় জ্যেষ্ঠপুত্র ঈশানচন্দ্র আড়াই বৎসর বয়ঃক্রম কালে যৌবরাজ্য প্রাপ্ত হন। মহারাণী সুদক্ষিণার গর্ভে যুবরাজ ঈশানচন্দ্র, উপেন্দ্রচন্দ্র ও বীরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। এতদ্ব্যতীত নীলকৃষ্ণ, চক্রধ্বজ (কালা রাজা), মাধবচন্দ্র, যাদবচন্দ্র, সুরেশকৃষ্ণ ও শিবচন্দ্র নামে মহারাজের আরও ছয় পুত্র হয়। দ্বিতীয় পুত্র উপেন্দ্রচন্দ্রকে তিনি বড়ঠাকুর পদে নিযুক্ত করেন। ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে (১২৫৯ সন) মহারাজ কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়।
মহারাজ কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের মৃত্যু সম্বন্ধে একটি আখ্যান শুনিতে পাওয়া যায়। জ্যোৎস্না রাত্রিতে মহারাজ প্রাসাদে উপবেশন করিয়া আছেন এমন সময় দ্বারদেশে কাহাদের ছায়া দেখা গেল। মহারাজ ভাবনিমগ্ন ছিলেন, সহসা চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন, একি! তাঁহার আসন সম্মুখে দীর্ঘকায় তিন জন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী, মহারাজ শিহরিয়া উঠিলেন! সন্ন্যাসীত্রয় যুগপৎ কহিয়া উঠিলেন—“মহারাজ, আমাদের চিনিতে পারেন কি?” মহারাজ ভয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হইয় রহিলেন, মুখ হইতে কথা সরিতেছিল না; তাই ত, ইঁহারা কে! একজন অমনি বলিলেন—“মহারাজ, রাজভোগে একেবারে চূর হইয়া আছেন আমাদের কথা একেবারেই স্মরণে আসিতেছে না? ওঃ, কি
মহারাজ সহসা চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন সম্মুখে তিনজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসী। সর্ব্বনাশা এই রাজ্য নেশা!” অপ্রস্তুত হইয়া মহারাজ আসন ত্যাগ করিয়া ইঁহাদিগকে সসম্মানে বসাইলেন তারপর নিজে বসিলেন। তখন অত্যন্ত বিনীত ভাবে বলিলেন, “আমি আপনাদের কখনো দেখিয়াছি মনে হয় না।” এই বলিয়া মহারাজ অধোবদনে রহিলেন। মহারাজের কথা শুনিয়া সন্ন্যাসীত্রয় যুগপৎ হাসিয়া উঠিলেন—“হাঃ হাঃ, এ সব ভুলিয়াছে, সব ভুলিয়াছে! মায়া মোহে একেবারে মজিয়াছে।”
সন্ন্যাসীগণের হাসি থামিল। তাঁহারা সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন—“মহারাজ, সুদূর হিমালয় হইতে আমরা আপনার নিকট একটি প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি। বলুন, আমরা যাহা চাহিব তাহাই দিবেন।” মহারাজ প্রমাদ গণিলেন—“আপনার কি চাহেন, না জানিয়া কেমন করিয়া কথা দিব?” তখন সন্ন্যাসীদের মধ্যে একজন বলিলেন “আপনি কথা দিন, তারপর আমরা আমাদের কথা বলিব।” পাছে ইহারা রুষ্ট হন এই ভাবিয়া মহারাজ প্রতিশ্রুতি দিলেন। অমনি একজন সন্ন্যাসী প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন,—“আমরা মহারাজের প্রসাদ পাইতে আসিয়াছি।” মহারাজ ইহা শুনিয়া একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেলেন, তাঁহার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। “আপনারা তবে কি আমার মৃত্যু কামনা করিয়া এখানে আসিয়াছেন?” ইহাতে সন্ন্যাসীরা কিছুই বলিলেন না, শুধু মহারাজকে এই কথাটি বলিলেন—“আগামী বৎসর ঠিক এই দিনে আমরা আসিব, ইহার মধ্যে দেখুন আমাদের স্মরণ হয় কিনা।” এই বলার সঙ্গে সঙ্গেই মহারাজ লক্ষ্য করিলেন সন্ন্যাসীদের আকৃতি অস্পষ্ট হইতে লাগিল। সভয়ে মহারাজ দেখিতে লাগিলেন সন্ন্যাসীরা ক্রমে মিলাইয়া গেলেন।
বৎসর কাটিয়া গেল,—আবার সেই দিন উপস্থিত। চাঁদের আলোতে রাজপ্রাসাদ ঝলমল করিতেছে, তোরণদ্বারে সিপাহীর কড়া পাহারা, যেন কেহ প্রাসাদ অভিমুখে বিনা সংবাদে না আসিতে পারে। মহারাজ একাকী সেই কক্ষে বসিয়া আছেন, প্রদীপ জ্বলিতেছে। এই বৎসর কাল যাবৎ মহারাজ ভোগ বিলাস ত্যাগ করিয়া কঠোর সংযমে কাটাইয়াছেন কারণ তাঁহার স্পষ্ট ধারণা হইয়াছিল যে তাঁহার কাল পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে। একটু শব্দ হইল, মহারাজ চমকিত হইয়া দেখিলেন সেই সন্ন্যাসীত্রয়ের মূর্ত্তি ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। তাঁহারা ইসারায় মহারাজকে অভিবাদন করিয়া আসনে বসিয়া পড়িলেন।
মহারাজ বলিলেন—“আপনাদের প্রতীক্ষায় রহিয়াছি এখন কি করিতে হইবে আদেশ করুন।” সকলেই সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন—“মহারাজ, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন!” মহারাজ তখন আসন হইতে উঠিয়া সুস্বাদু ফল পূর্ণ একটি সোণার থালা তাঁহাদের কাছে ধরিলেন। একজন সন্ন্যাসী কহিলেন—“আপনি স্বয়ং গ্রহণ করুন, তারপর আমাদিগকে দিন।” মহারাজ তাহাই করিলেন। সোণার থালা হইতে গুটিকয় ফল সরাইয়া লইলেন। তখন সন্ন্যাসীরা সেই ফল গ্রহণ করিলেন।
মহারাজ অত্যন্ত বিষণ্ণ অন্তরে আসনে উপবেশন করিয়া বলিলেন—“আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিলাম কিন্তু আপনাদের পরিচয় ত পাইলাম না।” তখন জটাজুট এলাইয়া একজন সন্ন্যাসী কহিলেন—“মহারাজ, বহুকাল পূর্ব্বে আমরা চার সন্ন্যাসীতে তপস্যায় বসিয়া ছিলাম। এইরূপে কিছুকাল গত হইলে আপনি বলিয়াছিলেন, ভোগ লালসা আপনার মন হইতে সরিয়া যায় নাই, তাই ভোগের মধ্যে আপনাকে জন্ম গ্রহণ করিতে হইবে। জন্মগ্রহণ করিলে আমরা নিশ্চয় টের পাইব তখন যেন আপনাকে এ বিষয় স্মরণ করাই এইরূপ প্রতিশ্রুতি চাহিয়াছিলেন। অদ্য আমরা সেই প্রতিশ্রুতিমতে আপনাকে পূর্ব্বজন্ম স্মরণ করাইতে আসিয়াছি। আপনি আর এক বৎসর ইহলোকে থাকিবেন, পুনরায় তপস্বী জীবনের জন্য প্রস্তুত হউন।” এই বাক্য সমাপ্ত হইতে না হইতেই সন্ন্যাসীত্রয় অদৃশ্য হইলেন।
ইহার এক বৎসর পর অকস্মাৎ বজ্রাঘাতে মহারাজের মৃত্যু হয়। মহারাজের মৃত্যু সম্পর্কিত এই আখ্যান দ্বারা গীতায় শ্রীভগবানের বাক্য স্মরণ হয়—
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে।
অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্।
এতদ্ধি দুর্ল্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্॥
পূর্ব্বোক্ত আখ্যান ভগবদ্বাক্যের মহিমাই কীর্ত্তন করিতেছে।[১]
- ↑ কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যের মহারাণী সুলক্ষণা ১৭৬৬ শকাব্দে কুমিল্লায় শ্রীশ্রীজগন্নাথের জন্য নূতন মন্দির প্রস্তুত করেন। কুমিল্লায় শিলালিপির কিয়দংশ এইরূপ—“সুলক্ষণা……গুণৈকালয়া প্রাসাদঃ পরিনির্ম্মিতঃ খলু তয়া শ্রীকৃষ্ণসন্তুষ্টয়ে।”