রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৪



(৪)

রামগঙ্গামাণিক্য

 ১৮১৩ খৃষ্টাব্দে (১২২৩ ত্রিপুরাব্দে) দুর্গামাণিক্যের মৃত্যু সংবাদ দেশে প্রচারিত হইলে রামগঙ্গামাণিক্য স্বীয় দাবী কর্ত্তৃপক্ষের গোচর করিলেন। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট রামগঙ্গামাণিক্যকে সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী ঘোষণা করিলেন কিন্তু আরও অনেক দাবীদার জুটিয়া গেল। দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্য-তনয় রামচন্দ্র ঠাকুর, তাঁহার পুত্র শম্ভুচন্দ্র, রাজধরমাণিক্যের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র অর্জ্জুনমণি এবং সুমিত্রা দেবী, ইঁহারা সকলেই সিংহাসনে স্ব স্ব দাবী জানাইলেন। কিন্তু ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষের অঙ্গুলি সঙ্কেতে সকল দাবীদারই নিরস্ত হইয়া গেলেন—রামগঙ্গামাণিক্য পুনঃ রাজদণ্ড ধারণ করিলেন। গোবিন্দমাণিক্যের ন্যায় তাঁহার রাজযোগে ভঙ্গযোগ লক্ষিত হয়, তাই বহু কষ্ট সহিয়া পুনঃ সিংহাসন লাভ করেন। ১২২৩ ত্রিপুরাব্দে রাজদণ্ড ধারণ করিলেও তাঁহার অভিষেককার্য্য প্রতিপক্ষদের জন্য কিছুকাল স্থগিত থাকে।

 আইন বলে আঁটিয়া উঠিতে না পারিয়া শম্ভুচন্দ্র রামগঙ্গামাণিক্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন—কুকিদের উত্তেজিত করিয়া মহারাজের সহিত বিগ্রহ উপস্থিত করেন।

 মহারাজ রামগঙ্গামাণিক্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন,  উদয়পুরে সৈন্য সজ্জা হইতে লাগিল। মহারাজ আগরতলা ছিলেন বলিয়া শম্ভুচন্দ্র হালাম সৈন্য দিয়া রাজধানী অবরোধ করিতে প্রয়াস পাইলেন কিন্তু মহারাজের চতুর ব্যবস্থায় শম্ভুচন্দ্রের হার হইল। শম্ভুচন্দ্র চট্টগ্রাম যাইয়া আশ্রয় লইলেন এবং মোকদ্দমার তদ্বির করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে মহারাজ রামগঙ্গামাণিক্য মোগড়া গ্রামের সান্নিধ্যে এক বিপুল আকারের দীঘি খনন কার্য্য আরম্ভ করেন, উহাতে সহস্র মাটিয়াল নিযুক্ত হয় এবং ৩৭ হাজার টাকা ব্যয়ে উক্ত দীঘি খনন কার্য্য সমাধা হয়। ট্রেনে যাইতে ইহা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ইহার নাম গঙ্গাসাগর। বর্ত্তমানে এ দীঘির পারে তহসিল আফিস রহিয়াছে। বাস করিবার অভিপ্রায়ে সেখানে মহারাজ এক সুরম্য ভবন প্রস্তুত আরম্ভ করেন এবং তদুদ্দেশ্যে বাস্তু পূজার অনুষ্ঠান করা হয়।

 ১২৩১ সনে মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হয়। তাহাতে শম্ভুচন্দ্র প্রভৃতির দাবী সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা হয়। তখন রাজধানীতে অভিষেকের জন্য বিপুল আয়োজন চলিতে থাকে। বেদবিধি অনুসারে মহারাজ শুভদিনে অভিষিক্ত হইলেন। রামগঙ্গামাণিক্যের পুনরভিষেক কার্য্য গোবিন্দমাণিক্যের পুনরভিষেক কথা স্বতঃই স্মরণ করাইয়া দেয়। কামান গর্জ্জনে অভিষেক সমাপ্তি দিকে দিকে ঘোষিত হইল। অভিষেক ক্রিয়ান্তে অনুজ কাশীচন্দ্রকে যৌবরাজ্য ও স্বীয় তনয় কৃষ্ণকিশোরকে বড়ঠাকুর পদ দেওয়া হয়। ব্রিটিশ প্রতিনিধি সাক্ষাতে অভিষেক সম্পন্ন হইলে তিনি তিন দিন আগরতলা থাকিয়া বিদায় লইলেন। নৃত্যগীতে রাজ্য মুখরিত হইয়াছিল ইহা বলাই বাহুল্য।

 রামগঙ্গামাণিক্যের রাজত্বকালে প্রসিদ্ধ ব্রহ্মযুদ্ধ ঘটে এবং তাহাতে তিনি ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের পক্ষে থাকিয়া সৈন্য সাহায্য করিয়াছিলেন। মণিপুররাজ জয়সিংহের কন্যা চন্দ্ররেখার সহিত রাজধরমাণিক্যের বিবাহ সম্বন্ধ দ্বারা উভয় রাজত্ব মধ্যে কুটুম্বিতা বন্ধন সুদৃঢ় হয়। কিন্তু জয়সিংহের মৃত্যুর পর মণিপুর সিংহাসনের উপর নানা বিপর্য্যয়ের স্রোত বহিয়া যাইতে লাগিল। জয়সিংহ-তনয় লাবণ্যচন্দ্র সিংহাসন আরোহণ করার পরই ষড়যন্ত্রের ফলে নিহত হন। তখন মধুচন্দ্র রাজা হন, তিনি শীঘ্রই চৌরজিৎ হস্তে প্রাণ হারান। চৌরজিতের অভিলাষ পূর্ণ হইল না, তাঁহার ভ্রাতা মারজিৎ তাঁহাকে দূর করিয়া দিয়া সিংহাসন দখল করেন। বিতাড়িত চৌরজিৎ নিরুপায় দেখিয়া আগরতলা আসিয়া উপস্থিত হন। মহারাজ তাঁহাকে নিঃস্ব দেখিয়া কিছু অর্থ প্রদান করেন। অতঃপর চৌরজিৎ হেড়ম্বরাজের অনুগ্রহ ভাজন হইয়া সেখানে বাস করিতে থাকেন। মারজিৎও অতি সত্বর গম্ভীরসিংহ কর্ত্তৃক রাজ্য হইতে বিতাড়িত হন। যখন গম্ভীরসিংহ সিংহাসনে সমাসীন তখন ব্রহ্মসৈন্য আসিয়া মণিপুরে হানা দিল। উপায়ান্তর না দেখিয়া গম্ভীরসিংহও হেড়ম্ব রাজ্যে যাইয়া আশ্রয় খুঁজিলেন। অদৃষ্টের তাড়নায় এখন চৌরজিৎ, মারজিৎ ও গম্ভীরসিংহ তিন ভাই-ই হেড়ম্বরাজ্যে প্রজাভাবে কাল কাটাইতে লাগিলেন!

 হেড়ম্বরাজ গোবিন্দচন্দ্র ইহাদের প্রতি কৃপাপূর্ব্বক আতিথ্য প্রদান করেন। কিন্তু ইহারা ষড়যন্ত্র করিয়া সহসা রাজ ক্ষমতা অধিকার করিয়া মহারাজ গোবিন্দচন্দ্রকে তাড়াইয়া দেন। এইবার ব্রহ্মসৈন্য হেড়ম্বরাজ্য ঘিরিয়া ফেলিল, তখন চৌরজিৎ, মারজিৎ ও গম্ভীরসিংহ শ্রীহট্টে আসিয়া কোম্পানীর শাসনে বাস করিতে লাগিলেন। ক্রমে ব্রহ্মসৈন্যদের সহিত ইংরেজশক্তির সঙ্ঘর্ষ উপস্থিত হইল, এই যুদ্ধে রামগঙ্গামাণিক্য ইংরেজদিগকে যথাশক্তি সাহায্য করেন।

 মহারাজ রামগঙ্গামাণিক্য অত্যন্ত ধর্ম্মপ্রাণ ছিলেন এবং নিতান্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করিতেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অভ্যন্তরে ত্রিপুরা মহারাজের অত্যুজ্জ্বল কীর্ত্তি হইতেছে গোপীনাথ মন্দির। গোপীনাথের নাটমন্দির ভগ্ন দশা প্রাপ্ত হইয়াছিল, মহারাণীর প্রযত্নে উহার সংস্কার সাধন হয়। শুনিয়াছি ঐ নাটমন্দির পুনঃ ভগ্নদশায় আসিয়াছে এবং অচিরে সংস্কার আবশ্যক। গোপীনাথের সেবার জন্য উড়িষ্যা দেশে দেবোত্তর সম্পত্তি ক্রয় করিয়া পাণ্ডার অধিকারে রাখা হইয়াছে। গোপীনাথের মন্দির ত্রিপুরারাজ্যের শির বঙ্গের বাহিরে উন্নত করিয়া রাখিয়াছে।

 শেষ জীবনে রাজধর মাণিক্যের পত্নী চন্দ্ররেখা বৃন্দাবনে বাস করিতে থাকেন এবং কালক্রমে ধাম প্রাপ্ত হন। মহারাজের চিত্তে শ্রীশ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের মূর্ত্তি দিবারাত্র বিরাজ করিত তাই সেই লীলাভূমিতে ভগবানের বিগ্রহ স্থাপন করিতে তাঁহার ইচ্ছা হইয়াছিল। এই উদ্দেশ্যে তিনি খণ্ডল দেশের কাশীবাসী গৌরীচন্দ্র চৌধুরীকে বৃন্দাবনে মন্দির স্থাপন করিবার জন্য পাঠান। গৌরীচন্দ্র বৃন্দাবনে পৌঁছিলে মহারাজ পঁচিশ হাজার টাকা পাঠাইয়া দেন। গৌরীচন্দ্র স্থান নির্ব্বাচন করিয়া কুঞ্জ নির্ম্মাণ করিলেন—শুভদিনে কুঞ্জ মধ্যে রাসবিহারী প্রতিষ্ঠিত হইলেন। অদ্যাপি ‘ত্রিপুরা মহারাজ কুঞ্জ’ নামে এই স্থান বৃন্দাবনে সুপরিচিত। মহারাজ রামগঙ্গা দীর্ঘকাল স্বর্গীয় হইয়াছেন কিন্তু তাঁহার কীর্ত্তি লোক চক্ষে তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিয়াছে।

 মহারাজ অত্যন্ত গুরুভক্ত ছিলেন। স্বীয় গুরু ভুবনমোহনের মূর্ত্তি নির্ম্মাণ করিয়া তাঁহার নিকট হৃদয়ের ভক্তি নিবেদন করিতেন। মৃত্যুকালে গুরু-পাদপদ্মে মাথা রাখিয়া শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে (১২৩৬ সনে) মহারাজ রামগঙ্গার মৃত্যু হয়।