রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ/৩
(৩)
দুর্গামাণিক্য
রাজধর মাণিক্যের মৃত্যুর পর ১৮০৪ খৃষ্টাব্দে (১২১৪ ত্রিপুরাব্দে) যুবরাজ দুর্গামণির অভিষেক হওয়ার কথা ছিল কিন্তু মহারাজকুমার বড়ঠাকুর রামগঙ্গা সিংহাসন অধিকার করেন। ইহাতে গোলযোগের সৃষ্টি হয়। প্রবল পরাক্রম ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট থাকিতে উভয়ের দাবী লইয়া যুদ্ধের সৃষ্টি না হইয়া মোকদ্দমার সৃষ্টি হইল। কর্ম্মচারিগণের মধ্যে কেহ এপক্ষ কেহ ওপক্ষ লইল। দুর্গামণির পক্ষে প্রধান সহায় ছিলেন রামরতন দেওয়ান। যুবরাজ দুর্গামণি ইহার ভগিণী সুমিত্রার পাণিগ্রহণ করেন। যুবরাজ দুর্গামণি কুকি সরদারগণের সাহায্যে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন কিন্তু ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষ তাঁহাকে জানাইয়া দেন তিনি যেন অস্ত্রত্যাগ করিয়া আইন অবলম্বনে দেওয়ানী আদালতে নিজ স্বত্ব প্রমাণিত করেন। দুর্গামণি তদনুযায়ী অস্ত্রত্যাগ করিয়া আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কৈলাস সিংহ মহাশয় এ সম্বন্ধে এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, “ইহা নিতান্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিযয় যে মহারাজ রামগঙ্গা ও তাঁহার অমাতাবর্গ কেবল রাজপরিবারের উত্তরাধিকার লইয়া সেই মোকদ্দমায় বহুবিধ তর্ক ও আপত্তি উপস্থিত করিলেন কিন্তু ব্রিটিশ আদালতে এবম্প্রকার মোকদ্দমা চলিতে পারে কি না এই তর্ক উপস্থিত করিবার জন্য তাঁহাদের মস্তিষ্ক সঞ্চালিত হইল না। এই ঘটনার ৬০ বৎসর পর কলিকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা ব্যারিষ্টার মনট্রি সাহেবের মস্তিষ্কে প্রথমে ইহা উদিত হইয়াছিল।”
আইনের অধিকার অনধিকার যাহাই থাকুক আদালতে এ বিচার কার্য্য সমাধা হইয়া গেল। “১৮০৮ খৃষ্টাব্দে এই মোকদ্দমা ঢাকা প্রভিন্সিয়েল কোর্টের প্রধান বিচারপতি মিঃ বার্ড ও দ্বিতীয় বিচারপতি মিঃ মেলবিল দ্বারা নিষ্পত্তি হইয়াছিল।” দুর্গামণিই রাজ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নির্ণীত হইলেন এবং জমিদারীর ক্ষমতা প্রাপ্ত ম্যানেজার হইলেন। মহারাজ রামগঙ্গা ইহার বিরুদ্ধে আপিল করিলেন কিন্তু কোন ফল হইল না।
১৮০৯ খৃষ্টাব্দে (১২১৯ ত্রিপুরাব্দে) যুবরাজ দুর্গামণি চাকলে রোশনাবাদের অধিকার প্রাপ্ত হন। তৎপর তিনি ত্রিপুরার সিংহাসনে দুর্গামাণিক্য নামে অভিষিক্ত হন।
সিংহাসনচ্যুত রামগঙ্গামাণিক্যের জীবন বড়ই দুঃখময় হইয়া উঠিল। তিনি নানাস্থান ঘুরিয়া অবশেষে বিশগ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ভ্রাতা কাশীচন্দ্র এ দুঃসময়ে তাঁহার সহচর হইয়াছিলেন।
দুই বৎসর রাজত্ব করিবার পর দুর্গামাণিক্য তীর্থ দর্শনের জন্য চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। হয়ত সংসারের অনিত্যতায় এবং অচিরে নিজ মৃত্যুর বিষয় ভাবিয়া তীর্থের জন্য তাঁহার মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। অগ্রহায়ণ মাসে যাত্রার দিন ধার্য্য হইল। রাজ্য ত্যাগ করিয়া যাইবার পূর্ব্বে রামগঙ্গামাণিক্যের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছুক হইয়া প্রবাসে তাঁহার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন। রামগঙ্গামাণিক্য সংবাদ পাইয়া দুর্গামাণিক্যের সহিত সাক্ষাৎ অভিলাষে সত্বর চলিয়া আসিলেন, উভয়ের মনোমালিন্য যেন কোন্ মন্ত্রবলে দূর হইয়া গেল!
গোমতীর মোহনায় উভয়ের সাক্ষাৎ হইল। দুর্গামাণিক্য রামগঙ্গামাণিক্যকে অতি সাদরে গ্রহণ করিলেন এবং অত্যন্ত বিনয়পূর্ব্বক বলিলেন “তীর্থযাত্রা করিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছি, এ রাজ্যে আর ফিরিব কিনা কে জানে?
কারণ—
জীবন মরণ লোকের আত্ম-ইচ্ছা নহে
নিমিত্তের ফলাফল কর্ম্ম হয় তাহে॥”
দুর্গামাণিক্য হয়ত মৃত্যুর পূর্ব্বাভাষ পাইয়াছিলেন তাই জীবন সম্বন্ধে এরূপ নিরাশবাণী কহিলেন। তারপর রামগঙ্গামাণিক্যকে এইভাবে সম্বোধন করিলেন—
রাজ ধর্ম্মমতে প্রজা করিবে পালন
স্বধর্ম্মে থাকিয়া রাজ্য করিবে রক্ষণ।
ভবিতব্য থাকে যদি পুনঃ আসিবার
তোমা সঙ্গে আর দেখা হইবে পুনর্ব্বার।
এই কথা বলিতে বলিতে দুর্গামাণিক্য বিষণ্ণ হইলেন—
এ সব কহিয়া রাজা থাকে বিমর্ষিয়া
রামগঙ্গামাণিক্য কহে নৃপ আশ্বাসিয়া॥
শরীর হইয়াছে জীর্ণ বলিতে সংশয়
পিতৃকার্য্যে চলিয়াছেন নিষেধ না হয়॥
মহারাজ দুর্গামাণিক্য, রামগঙ্গামাণিক্য ও কাশীচন্দ্র একসঙ্গে সে সময় বসিয়াছিলেনঃ—
এই মতে আলাপ করিছে তিন ভাই
পরস্পর রোদনের কিছু ক্ষেমা নাই॥
এইরূপে নৌকাযোগে মহারাজ, রাণী ও পরিজনসহ তীর্থ দর্শনে বাহির হইয়া গেলেন। সর্ব্বপ্রথমে কাশী আসিলেন তথা হইতে মাঘ মাসে প্রয়াগ গমন করেন, সেখান হইতে পুনরায় কাশী প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া শিবমন্দির স্থাপন করেন। বিশ্বেশ্বর অন্নপূর্ণা দর্শনে চিত্তের শান্তি হয়। ষোড়শোপচারে দানাদি কার্য্য সম্পন্ন করিয়া গয়া যাইবার জন্য নৌকাযোগে যাত্রা করেন। পাটনার নিকটে পৌঁছিয়া পূর্ব্বকূলে গঙ্গার তীরে নৌকা বাঁধা হয়, মহারাজের শরীর ক্রমেই যেন অবশ হইয়া আসিতেছিল, মহারাজ বুঝিতে পারিলেন অন্তিম সময় উপস্থিত। তখন ১২২২ সন, ২৫শে চৈত্র কালী-পূজার অনুষ্ঠান করা হয়। মার পূজা হইতেছে আর মহারাজ ব্যাকুল হইয়া প্রশ্ন করিতেছেন, পূজা সমাধা হইল কি? পুজা সমাধা হইবার সঙ্গে সঙ্গেই মহারাজ অন্তর্জলি করিলেন, অর্দ্ধ-অঙ্গ গঙ্গাজলে অর্দ্ধ-অঙ্গ স্থলে রহিল।
অর্দ্ধ অঙ্গ গঙ্গাজলে অর্দ্ধ অঙ্গ রহিবে স্থলে,
কেহবা লিখিবে ভালে কালী নামাবলী।
দুর্গামাণিক্যের সাধকের অভীষ্ট মৃত্যু হইল, কালী নাম করিতে করিতে দেহ কালবশ হইয়া গেল—
গঙ্গামধ্যে প্রাণত্যাগ গেল স্বর্গপুরে
মৃত্যুকালে মহারাজের মাত্র ৩৯ বৎসর বয়স হইয়াছিল। শ্রাদ্ধাদি কার্য্য সম্পন্ন করিয়া একমাস মধ্যে গয়ায় বিষ্ণুপাদে পিণ্ড দেওয়া হয়।