রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/১০

(১০)

হেড়ম্বরাজ ও ত্রিপুররাজের যুদ্ধ

 ত্রিলোচনের সিংহাসনে দাক্ষিণ বসিলেন। ইহাতে প্রজাগণ যারপরনাই প্রীত হইল। পিতৃশ্রাদ্ধ শাস্ত্রবিধানে উত্তমরূপে সমাধা হইল। পিতার ধনরাশি এগার ভাই বাঁটিয়া লইলেন। দাক্ষিণ রাজা হইলে তাঁহার ছোট দশ ভাই হইলেন তাঁহার সেনাপতি। পাঁচ পাঁচ হাজার করিয়া এক এক ভাইয়ের অধীনে সৈন্য দেওয়া হইল। এইভাবে মহারাজ দাক্ষিণ তাঁহার অনুজ দশ ভ্রাতার সহিত পরমানন্দে রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন। সংসারের নিয়ম এমনি যে সুখের পাছে পাছে দুঃখ আসিয়া দেখা দেয়। মহারাজ দাক্ষিণের জন্য এক বিপদের সূচনা হইল।

 দৃক্‌পতি হেড়ম্ব সিংহাসনে বসিয়া রাজদণ্ড চালনা করিতেছেন এমন সময় খবর শুনিলেন যে পিতার মৃত্যু হইয়াছে। আরও শুনিলেন যে তাঁহার কনিষ্ঠ ভাই পিতার সিংহাসনে বসিয়াছেন। এ সংবাদ তাঁহার নিকট মোটেই ভাল লাগিল না—এ কেমন কথা আমি জ্যেষ্ঠ থাকিতেই কনিষ্ঠ রাজা হইয়া বসিল! ইহা ত ভারী অন্যায়! তখন তিনি এক পত্র রচনা করিয়া দূতহস্তে ত্রিপুর-রাজের নিকট পাঠাইয়া দেন। ইহাতে লেখা ছিল, “দাক্ষিণ, তুমি আমার ছোট ভাই, রীতি অনুযায়ী পিতার সিংহাসন জ্যেষ্ঠে পায়। আমি বর্ত্তমান থাকিতে তুমি কেমন
আমি বর্ত্তমান থাকিতে তুমি কেমন করিয়া পিতৃসিংহাসনে বসিলে?
করিয়া পিতৃসিংহাসনে বসিলে? ইহা কি তোমার উচিত হইয়াছে? হেড়ম্বরাজ্যে মাতামহ আমাকে রাজা করিয়া গিয়াছেন, তাই বলিয়া কি আমার পিতৃরাজ্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ হইয়া যাইবে?”

 দূত-হস্ত হইতে পত্র পড়িয়া দাক্ষিণ ত অবাক! তাঁহার কনিষ্ঠ দশ ভাইকে ডাকাইলেন, সকলে মিলিয়া ইহার উত্তর রচনা করিলেন। লেখা হইল আপনি ঠিকই লিখিয়াছেন যে জ্যেষ্ঠপুত্রের সিংহাসনে অধিকার, সেইমতে এ রাজপাট আপনারই। কিন্তু পিতা বর্ত্তমানে আপনাকে মাতামহ, হেড়ম্বরাজ্যের যৌবরাজ্য দেন, তখন পিতৃদেব আমাকে ত্রিপুরা রাজ্যের যুবরাজ করেন। যদি পিতা ত্রিপুরার সিংহাসন আপনাকে দিতে চাহিতেন তবে আপনাকে তখনই আনাইয়া অভিষেক করাইতেন। পিতা যখন তাহা করেন নাই তখন তাঁহার ব্যবস্থার ব্যতিক্রম করি কি করিয়া?

 পত্র পাইয়া হেড়ম্ব-রাজ ক্রোধে জর্জ্জরিত হইলেন। কি এমন কথা! সিংহাসন অমনি দিবে না, আচ্ছা দিবার ব্যবস্থা আমি করিব। হেড়ম্বরাজ স্থির করিলেন, যে অধিকার লেখনীর দ্বারা মিলিল না তাহা তরবারি সাহায্যে অবশ্যই মিলিবে। এই ভাবিয়া বিপুল সৈন্য সমাবেশ করিলেন। দেখিতে দেখিতে হেড়ম্ব-সৈন্যের ঘনঘটায় ত্রিপুরা রাজ্যে বিষম ঝড়ের সূচনা হইল। সাতদিন অবিরত অস্ত্র বর্ষণ হইল, বিপক্ষ সৈন্যের দুর্ব্বার স্রোত রোধ করিতে না পারিয়া দাক্ষিণ রণে ভঙ্গ দিলেন। দৃক্‌পতির জয় হইল, লেখনীর দ্বারা যাহা পান নাই, অসির সাহায্যে তাহা অধিকার করিলেন। পিতৃরাজ্য দৃক্‌পতির করতলগত হইল।