রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/৯

(৯)

ত্রিলোচনের দিগ্বিজয়

 ত্রিলোচন সেকালের প্রথা মতে দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়াছিলেন। তাঁহার বিজয় বাহিনীর নিকট কেহ তিষ্ঠাইতে পারে নাই। ঝড়ের বেগে তাঁহার সৈন্য কাঈফেঙ্গ, চাকমা, খুলঙ্গ লঙ্গাই ও তনাউ তৈরঙ্গ দেশ ভাসাইয়াছিল। তাঁহার প্রভুত্ব সকলে মানিয়া লইল এবং ত্রিপুর সৈন্য মধ্যে বিদেশী সৈন্য ভুক্ত হইয়া গেল। এই দিগ্বিজয় অভিযানের ফলে স্বর্ণগ্রামের পূর্ব্বদিকে বর্ত্তমান শ্রীহট্ট ও পরে বর্ত্তমান ত্রিপুরা পর্য্যন্ত ত্রিলোচনের রাজ্যভুক্ত হয়। “লিকা” রাঙ্গামাটি যাহা ত্রিপুরার দক্ষিণে ছিল তাহাও ত্রিপুরার অন্তর্গত হয়।

এই সকল রাজ্যজয় দ্বারা ত্রিলোচনের যশ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। ঠিক সেই সময় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ হইতেছিল। তাহাতে যে কত রাজার নিমন্ত্রণ হইয়াছিল তাহার সঠিক নির্ণয় নাই। পূর্ব্বে সহদেবের দিগ্বিজয়ের কথা বলা হইয়াছে। সহদেব ত্রৈপুর নরপতিকে বশে আনিয়াছিলেন এ কথা মহাভারতে আছে, এই ত্রৈপুর নৃপতিই ত্রিলোচন। পাণ্ডব বীর সহদেবের সৌজন্যে, ত্রিলোচন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হইয়া হস্তিনাপুর গমন করেন। ত্রিলোচন মহাসমারোহে সসৈন্যে ভারতের রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হন। তাঁহার সঙ্গে মণিপুরের রাজাও আসেন। ইহা ত্রিপুরার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব্ব ঘটনা। বিধির বিচিত্র বিধানে আজ পর্য্যন্ত ভারতের রাজধানী প্রায় সেইখানেই রহিয়া গিয়াছে।

 মহারাজ ত্রিলোচন হস্তিনাপুর পৌঁছিয়া দেখিলেন তাঁহার জন্য সুন্দর পর্ণাবাস রচিত হইয়াছে। বহু রাজার আবাসে সেস্থান শোভিত ছিল। পরম আদরে সেইখানে তিনি অভ্যর্থিত হইলেন। শুভদিনে রাজসূয় যজ্ঞ আরম্ভ হইল। যথা সময়ে ভীমসেন ত্রিলোচনকে সঙ্গে লইয়া মহারাজ যুধিষ্ঠিরের

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ


যথা সময়ে ভীমসেন ত্রিলোচনকে সঙ্গে লইয়া মহারাজ
যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎ করাইলেন।

সহিত সাক্ষাৎ করাইলেন। এই শুভ সম্মিলন ত্রিপুরার ইতিহাসকে অমর করিয়া রাখিবে। ত্রিলোচনের প্রতি রাজসম্মানে ত্রিপুরার আসন ভারতের দিকে দিকে প্রতিষ্ঠালাভ করিল। নির্দ্দিষ্ট দিনে ত্রিলোচন গৌরব মুকুট পরিয়া দেশে ফিরিলেন।

 কথিত আছে মহারাজ ত্রিলোচন মানুষের পূর্ণ আয়ু ১২০ বছর বাঁচিয়াছিলেন। তাঁহার জীবনে পুণ্যকার্য্য যে তিনি কত করিয়াছিলেন তাহার বুঝি পরিমাণ নাই! দুর্গোৎসব, দোলোৎসব, চৈত্রে জলোৎসব, শ্রাবণে মনসা পূজা, মাঘে সূর্য্যপূজা এই সব তাঁহার বার্ষিক কৃত্য ছিল। পিতৃলোকের উদ্দেশে শ্রাদ্ধাদি করিতেন, ব্রাহ্মণে অন্নদান ও দান তাঁহার নিরন্তর ছিল। এতদ্ব্যতীত নিত্য নৈমিত্তিক ক্রিয়ায় তিনি সদা তৎপর ছিলেন।

 ত্রিলোচনের শেষ বয়সে তাঁহার পর সিংহাসনে কে বসিবে ইহা লইয়া বিচার বিতর্ক হয়। ত্রিলোচনের জ্যেষ্ঠ পুত্র দৃক্‌পতি হেড়ম্বরাজ্যে বাস করিতেন ইহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। তিনি হেড়ম্বরাজের সিংহাসনে বসিবেন এরূপ কথা পূর্ব্বেই আলোচিত হইয়াছে। দৃক্‌পতি যে হেড়ম্বরাজ্যের ভাবী রাজা ইহা স্থির হইয়া গিয়াছিল। কিছুকাল পরে হেড়ম্বরাজের মৃত্যু হইলে দৃক্‌পতি মাতামহ-সিংহাসনে বসিয়া রাজদণ্ড ধারণ করিলেন। ইহাতে মহারাজ ত্রিলোচন তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র দাক্ষিণকে যুবরাজ করিলেন। পিতার মৃত্যুতে দাক্ষিণই ত্রিপুরার সিংহাসন পাইবেন ইহা স্থির হইয়া রহিল। দুই ভাই দুই রাজ্যে রাজা হইবেন এ ব্যবস্থা উত্তম। কালপূর্ণ হইলে ত্রিলোচনের মৃত্যু হইল। মর্ত্ত্যলোক ত্যাগ করিয়া তিনি শিবলোকে গমন করিলেন।