রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/২

(২)
ত্রিপুররাজমালার আদিপুরুষ দ্রুহ্যুর কিরাত জয়

 মহারাজ যযাতির রাজধানী ছিল প্রতিষ্ঠানপুরে। পুরাণের বর্ণনা অনুসারে বুঝা যায় এইস্থান প্রয়াগ-প্রদেশে গঙ্গার উত্তর তীরে বর্ত্তমান ছিল। পুরাণের যুগ হইতে এ পর্য্যন্ত প্রয়াগের পবিত্রতার হ্রাস হয় নাই, পিতৃকার্য্যের জন্য প্রয়াগ প্রসিদ্ধ তীর্থ। সেই পুণ্যভূমিতে পুরু অভিষিক্ত হইলেন। প্রতিষ্ঠানপুর[] রাজধানী হইলেও পুরুর রাজ্য বর্ত্তমান উত্তর ভারতের অধিকাংশ স্থল ব্যাপিয়া বিস্তৃত ছিল। যদুর অধিকারে মথুরা ও নর্ম্মদার কিয়দংশ রহিল। দ্রুহ্যুর অধিকার বর্ত্তমান চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগ ও ব্রহ্মভূখণ্ডে ন্যস্ত হইল। এইভাবে অন্য ভ্রাতৃগণ তাঁহাদের নিজ নিজ অংশ পাইলেন। ত্রিপুর রাজমালার আদি পুরুষই হইতেছেন মহারাজ দ্রুহ্যু। ইনি পিতার শাপে নির্ব্বাসিত হইয়া ভারতের পূর্ব্বাঞ্চলে চলিয়া আসিতে বাধ্য হন। দ্রুহ্যু কিরাত দেশে আসিয়া প্রথম রাজ্য স্থাপন করেন। কপিল নদীর তীরে ত্রিবেগ স্থলে তাঁহার রাজপাট স্থাপিত হয়।

 প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক কিছুই সঠিক ভাবে জানিবার উপায় নাই। গৃহস্বামীর পরিবর্ত্তনে যেমন গৃহের আকার পরিবর্ত্তিত হয় এই ভারতবর্ষেরও তেমনি আকারের অনেক পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে, কাজেই পূর্ব্বের পুস্তকে যেরূপ বর্ণনা আছে তদনুরূপ দেশ খুঁজিয়া বাহির করা সব সময় চলে না। এক্ষেত্রেও সেইরূপ। সেই অতি প্রাচীন কালের ত্রিবেগ বর্ত্তমানে কি নাম ও রূপ ধরিয়াছে তাহা লইয়। ঐতিহাসিকের মধ্যে অনেক মতভেদ উপস্থিত হইয়াছে। ‘ঢাকার ইতিহাসে’ এ সম্বন্ধে এইরূপ লেখা আছে:–“ব্রহ্মপুত্র ধলেশ্বরী ও লাক্ষ্যা এই নদ ও নদীত্রয়ের সঙ্গম স্থান ত্রিবেণী বলিয়া পরিচিত। এইস্থান নারায়ণগঞ্জের বিপরীত কূলে সোণারগাঁও পরগণায় অবস্থিত।

 “কথিত আছে, যযাতির পুত্রচতুষ্টয়ের মধ্যে মহাবল পরাক্রান্ত তৃতীয় পুত্র দ্রুহ্যু কিরাতভূপতিকে রণে পরামুখ করিয়া কোপল (ব্রহ্মপুত্র) নদের তীরে ত্রিবেগ বা ত্রিবেণী নগর সংস্থাপন পূর্ব্বক তথায় স্বীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।”

—ঢাকার ইতিহাস, ৪৭২ পৃঃ

 ত্রিবেগ, সুবর্ণগ্রাম পরগণার অন্তর্গত। এই স্থানেই প্রথম রাজপাট স্থাপিত হয়। কোপল নাম ‘কপিলে’রই অপভ্রংশ। সুবর্ণগ্রাম সম্বন্ধে ঢাকার ইতিহাসে এইরূপ লেখা আছেঃ—

 “জনশ্রুতি যে মহারাজ দ্রুহ্যুর অনন্তরবংশীয় মহারাজ জয়ধ্বজের সময়ে এই বিস্তীর্ণ ভূভাগের উপর সুবর্ণ বর্ষিত হইয়াছিল বলিয়া ইহা সুবর্ণগ্রাম আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে তৎপূর্ব্বে ইহা কিরাতাধিকৃত দেশ বলিয়া অভিহিত হইত।”

—ঢাকার ইতিহাস

 ত্রিবেগ হইতে রাজপাট কালক্রমে স্থানান্তরিত হইলেও রাজবংশের একটি শাখা সেখানে রহিয়া গেল। দ্বিতীয় বিজয়মাণিক্যের মৃত্যুর পর সমসের গাজী রাজদ্রোহী হইয়া যখন নিজকে ত্রিপুর-রাজ বলিয়া ঘোষণা করিল এবং প্রজা কর্ত্তৃক উপেক্ষিত হইল তখন সমসের কৌশল করিয়া সুবর্ণগ্রাম হইতে ত্রিপুর-রাজ বংশের একজনকে আনিয়া সাক্ষীগোপাল রাজারূপে অভিষিক্ত করিল।[] ইনিই লক্ষ্মণমাণিক্য নামে পরিচিত হইয়াছিলেন। পূর্ব্বেই বর্ণিত হইয়াছে দ্রুহ্যু কিরাতদেশে আসিয়া প্রথম রাজ্যস্থাপন করেন। সুবর্ণগ্রাম পরগণার অন্তর্গত ত্রিবেগেই তাঁহার রাজত্ব স্থাপিত হয়। এতদ্দেশে কিরাত বসতি সম্পর্কে ‘ঢাকার ইতিহাস’ প্রণেতা শ্রীযুক্ত যতীন্দ্র মোহন রায় লিখিয়াছেনঃ—

 “সুবর্ণগ্রামে কিরাতব্যবসায়ী আদিমশূদ্রের আজিও অসদ্ভাব ঘটে নাই।”

 সোণারগাঁ যে কিরাত স্থান ছিল তাহার অন্য নিদর্শনও আছে। সুপ্রসিদ্ধ গ্রীক ভৌগোলিক টলেমী ‘কিরাডিয়া’ নামে কিরাত দেশের যে সংস্থান নির্দ্দেশ করিয়াছেন, তাহা ‘বিশ্বকোষ’-কার কর্ত্তৃক লৌহিত্য বা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব্বদিগ্বর্ত্তী বলিয়া অনুমিত হইয়াছেঃ—

 “টলেমী কিরাডিয়া নামক জনপদের উল্লেখ করিয়াছেন উহা পুরাণোক্ত লৌহিত্য-নদের পূর্ব্ববর্ত্তী বলিয়া বোধ হয়।”

—বিশ্বকোষ (আর্য্যাবর্ত্ত)৷

 মহাভারতেও কিরাতগণ ব্রহ্মপুত্র তীরে অধিষ্ঠিত হইয়াছে।[]

 সোণারগাঁ যে মহাভারতের সময় বর্ত্তমান ছিল এবং পবিত্রস্থান রূপে পরিণত হইয়াছিল তাহার স্মৃতি ‘লাঙ্গলবন্ধ’ ও ‘পঞ্চমী ঘাট’ তত্রত্য এই দুইটি স্থান বহন করিয়া আসিতেছে। অষ্টমী স্নান উপলক্ষে প্রতিবৎসর এখানে বহু সহস্র লোকের সমাগম পুরাকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থল হইতে কর্ষণের পর যে স্থানে বলরাম লাঙ্গল থামাইয়াছিলেন, সে স্থান ‘লাঙ্গলবন্ধ’ নামে অধুনা পরিচিত এবং ‘পঞ্চমী ঘাট’ নাম পঞ্চপাণ্ডবের বার বৎসর বনবাসের সময় এখানে স্নান হইতে হইয়াছে।[]

 এইভাবে সোণারগাঁর প্রাচীনত্ব সহজে অনুমান করিতে পারা যায়।

  1. রাজ্যং স কারয়ামাস প্রয়াগে পৃথিবীপতিঃ, উত্তরে জাহ্নবীতীরে প্রতিষ্ঠানে মহাযশাঃ। [খিলহরিবংশ, ২৬।৪৯।]
  2. Samser obtained the government .... but the people not recognising him as the legitimate heir, he then installed, as Raja, one of the Tripura family, who resided at Sonargaon, but they still refused.
    —Analysis of Rajmala
  3. ”The Mahabharata locates them on the Brahmaputra.”
  4. On the bank of the old Brahmaputra river, 2 miles to the west of Painam, there are two bathing ghats held in great reverence by the Hindus, on account of their supposed connection with the history of Pandus. Nangalband or ‘plough-stopped’ is the place where Balaram checked his plough when he ploughed the Brahmaputra from its source. Close by is Panchamighat where the Pancha Pandava or five Pandava brothers used to bathe during their twelve years’ wanderings.
    —Archæological Survey of India Reports XV. (Behar and Bengal) by A. Cunninghum, P. 144-45