রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/৩

(৩)

দ্রুহ্যুর কাল নির্ণয়

 ইতিহাস বলিতেই সন তারিখ বুঝা যায়। দ্রুহ্যুর কিরাত জয় এবং ত্রিবেগে রাজ্যস্থাপন কখন হইয়াছিল বলা সহজ নয়। পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকের গবেষণায় প্রাচীন ভারতের কালনির্ণয় বুদ্ধদেব অবধি উঠিয়াছে, তার ঊর্দ্ধে যাইবার মত প্রমাণ মিলিতেছেনা। তাই বেদের যুগ ও রামায়ণ মহাভারতের কাল এখনো ঐতিহাসিকের গণায় ধরা দেয় নাই। এমন অবস্থায় দ্রুহ্যুর কাল-নির্ণয় পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকের মতে হইবার সুবিধা কই? সে যাহা হউক শিলালিপি-নিদর্শন এখানে না পাইলেও পঞ্জিকা মতে কল্যব্দের আলোচনা চলিতে পারে।

 শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের তিরোধান দিন হইতেই কলিযুগের প্রারম্ভ ধরা হয়। এই তিরোধান দিন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ২০ বৎসর পরে এবং সেই দিনেই মহারাজ যুধিষ্ঠির সিংহাসনে পরীক্ষিৎকে বসাইয়া বনে গমন করেন।[১] পঞ্জিকাতে সাধারণ ভাবে ঐ দিন লক্ষ্য করিয়া কলি-অব্দ ধরা হইয়া থাকে। কল্যব্দ খৃঃ পূঃ ৩১০০ বৎসর পূর্ব্ব হইতে আরব্ধ হইয়াছে, তদনুসারে ভগবানের তিরোধান হইতে এ পর্য্যন্ত প্রায় ৫০৩৮ বৎসর অতীত হইয়াছে। মৎস্য পুরাণে পরীক্ষিতের জন্ম হইতে মহারাজ নন্দের অভিষেক পর্য্যন্ত এক হাজার পঞ্চাশ বৎসর ধরা হইয়াছে।

যাবৎ পরীক্ষিতো জন্ম যাবন্নন্দাভিষেচনম্।
এবং বর্ষসহস্রন্তুজ্ঞেয়ং পঞ্চাশদুত্তরম্॥

—মৎস্যপুরাণ।

 নন্দের সহিত চন্দ্রগুপ্তের দ্বন্দ্ব এবং চাণক্যের সহায়তা এই সব কাহিনী পাশ্চাত্য মতে খাঁটি ইতিহাস বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। কিন্তু মৎস্যপুরাণে এই যে কালের ধারা ঊর্দ্ধ হইতে টানিয়া আনা হইয়াছে ইহার সহিত পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকের অনেকটা ঐক্য আছে। যাহা হউক, কল্যব্দ অনুযায়ী দ্রুহ্যুর কাল কিরূপ হয় দেখা আবশ্যক।

 শ্রীরাজমালায় উল্লেখ আছে দ্রুহ্যুর পরবর্ত্তী রাজা ত্রিলোচন যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক। কল্যব্দ ৩১০০ খৃষ্ট পূর্ব্ব হইলে, মহারাজ দ্রুহ্যুর ত্রিবেগ রাজ্য স্থাপনের কাল ইহা হইতে আরও পূর্ব্বে হইয়া পড়ে। এই ভাবে মোটামুটি সময়ের একটি ধারণা পাওয়া যায়।

 যুরুপীয় মনীষীরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন সময় অনুমান করেন। উইলফোর্ডের মতে ১৩৭০ খৃঃ পূঃ, সার উইলিয়ম জোন্সের মতে ১৩০৫ খৃঃ পূঃ, কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে ১০০০—৮০০ খৃঃ পূঃ। যদি যুরুপীয়দের মতে দ্রুহ্যুর সময় নিৰ্দ্ধারণ আবশ্যক হয় তবে ইহাদের যে কোনটির সহিত ১৫০ বৎসর যোগ করিলেই ঐ সময়ের ধারণা করিতে পারা যায় কারণ দ্রুহ্যু হইতে যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক ত্রিলোচন চারি পুরুষ।

 কাল বিচার দ্বারা ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীনত্ব অনুমান করা যায়। শেষোক্ত যুরুপীয় মত গ্রহণ করিলেও আদিপুরুষ দ্রুহ্যুর আবির্ভাব কালে পৃথিবীর মানচিত্রে কি দেখা যায়? যে যুরুপীয় জাতির প্রবল প্রতাপে পৃথিবী আজ তাহাদের করতলগত, সেই জাতির জন্ম হওয়া দূরে থাকুক তাহাদের পূর্ব্বপুরুষ গ্রীক রোমান জাতিরও জন্ম হয় নাই। এই প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখযোগ্য। বিবেকানন্দ এক সময়ে ভারতের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে তদীয় পাশ্চাত্য শিষ্যদ্বারা জিজ্ঞাসিত হইয়া বলিয়াছিলেন, ‘ভারত সুদূর অতীতের জাতি সমূহকে কবর দিয়াছে, যুরুপীয় বর্তমান জাতি সমূহকেও কবর দিবে, তৎপরেও স্বচ্ছন্দে বাঁচিয়া থাকিবে।’ মহাপুরুষের এই বাক্যের সাক্ষীস্বরূপ ত্রিপুরা রাজ্য স্মরণাতীত কাল হইতে স্বীয় গরিমায় আজিও বাঁচিয়া আছে, ভবিষ্যতেও বাঁচিয়া থাকিবে।

  1. The beginning of the Kali Age has been discussed by Dr. Fleet and he has pointed out that it began on the day on which Krishna died, which the chronology of the Mahabharata places, as he shows, some twenty years after the great battle and it was then that Yudhisthira abdicated and Parikshit began to reign.
    —Purana Text of the Kali Age by Pargiter, Introduction. P.X.