রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/৫

(৫)
ত্রিশূলাঘাতে ত্রিপুরের মৃত্যু ও চতুর্দ্দশ
দেবতার প্রকাশ

 ত্রিপুর রাজা হইয়া গর্ব্বে দেশ জয় আরম্ভ করেন—একে ত দুর্দ্দান্ত প্রকৃতি তাতে আবার বীর যোদ্ধা, তাঁহার নিকট অনেক রাজাই হারিতে লাগিল। পার্ব্বত্য বহু রাজা তাঁহার বশ মানিল। এইরূপ প্রভুত্ব পাইয়া ত্রিপুরের অত্যাচার ক্রমেই দুঃসহ হইল। প্রজারা শিবের আরাধনা করিতে লাগিল—‘হে মহাদেব, রাজার পীড়ন হইতে আমাদিগকে রক্ষা কর।’ শিবের দয়া হইল। একদা ত্রিপুরের রাজ্যে শিব আবির্ভূত হইলেন, আসিয়া দেখেন ত্রিপুর অতি দুরাচার, ঈশ্বর মানে না। শিব তখন সংহার রূপ ধারণ করিয়া ত্রিপুরের বুকে ত্রিশূল আঘাত করিলেন।
শিব তখন সংহার রূপ ধারণ করিয়া ত্রিপুরের বুকে ত্রিশূল আঘাত করিলেন
ত্রিপুরের মৃত্যু হইল; শিবের ত্রিশূলে মৃত্যু হওয়ায় ত্রিপুর মরিয়া স্বর্গে গেলেন।

 ত্রিপুর নিজ অধিকৃত দেশের সহিত নিজ নাম যোগ করিয়া দেন, সেই হইতে ‘ত্রিপুরা’ নামের উৎপত্তি এবং স্ব-জাতি ত্রিপুরের নামে পরিচিত। ত্রিপুর নিজকে এত বড় মনে করিতেন যে পিতৃ-পিতামহের স্মৃতি লোপ করিয়া নিজের নামে জাতীয় পরিচয় দেন এবং দেশের নামের স্মৃতি লোপ করিয়া তাহার উপরও নিজের নামের ছাপ বসাইয়া দেন।

 শিবের ত্রিশূলাঘাতে ত্রিপুরের মৃত্যু হইল বটে, কিন্তু প্রজাগণের দুঃখ দূর হইল না। রাজ্য অরাজক হইল, দৈব কোপে রাজ্যে নানা অশান্তি ঘটিতে লাগিল। অন্নাভাবে বস্ত্রাভাবে প্রজার দুঃখের সীমা রহিল না। প্রজাগণ নিকটস্থ হেড়ম্বরাজ্যে ভিক্ষা করিয়া আহার যোগাইতে লাগিল। কখনও বা হেড়ম্ববাসীরা দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিত, ভিক্ষা করিতে যাইবার কালে বস্ত্রের অভাবে তাহারা কখনও বা গাছের ছাল পরিত। এইরূপ অরাজকরাজ্যে বহু দুঃখে কাল কাটাইয়া প্রজারা ঠিক করিল পশুপতির আরাধনা করিবে। কিরাত ভাবে তাহারা পূজা আরম্ভ করিল এবং সাতদিন সাতরাত শিবের নামে বাদ্যগীতে বিভোর হইয়া রহিল। শিবের দয়া হইল। বাঘছাল পরণে, গলে ফণিহার, ললাটে অর্দ্ধচন্দ্র, হস্তে শিঙ্গা ডম্বরু, নন্দী ভৃঙ্গী সঙ্গে দেবদেব মহাদেব আবির্ভূত হইলেন। প্রজাগণ মাটিতে লুটাইয়া কহিতে লাগিল, ‘প্রভো, ত্রিপুরের পাপে আমরা কত না কষ্ট পাইতেছি; অবোধ সন্তানদের ক্ষমা কর। ত্রিপুরকে মারিয়া রাজপাট শূন্য করিয়াছ। অরাজক রাজ্যে বাস করা যায় না। আমাদিগকে রাজা দাও।

 শিব প্রসন্ন হইলেন। আদেশ হইল—ত্রিপুরের রাণী হীরাবতী শিব-প্রসাদে পুত্রবতী হইবেন, শিবের বরে যে পুত্র জন্মিবে তাঁহার দ্বারা রাজ্যের অশেষ কল্যাণ হইবে। চন্দ্রবংশ বলিয়া ইঁহার যেমন চন্দ্রধ্বজা হইবে তেমনি ত্রিশূলধ্বজাও হইবে।[১] দেবকৃপা ভিন্ন রাজ্যের মঙ্গল অসম্ভব, সেইজন্য নিত্য পূজার্চ্চনের জন্য শিব-আজ্ঞায় নির্ম্মিত চতুর্দ্দশ দেবতার মুখ প্রজাগণের নিকট প্রকাশিত হইল। চতুর্দ্দশ দেবতার নামঃ—

 হর, উমা, হরি, মা (লক্ষ্মী), বাণী (সরস্বতী), কুমার (কার্ত্তিকেয়), গণেশ, ব্রহ্মা, পৃথিবী, সমুদ্র, গঙ্গা, অগ্নি, কামদেব ও হিমালয়।

সংস্কৃত  হরোমাহরিমাবাণীকুমার-গণপা বিধিঃ।
ক্ষাব্ধী গঙ্গা শিখী কামো হিমাদ্রিশ্চ চতুর্দ্দশ॥

 চতুর্দ্দশ কুলদেবতার যথাবিধি পূজার আদেশ করিয়া শিব অন্তর্হিত হইলেন।

 এদিকে রাণী হীরাবতী শিব ধ্যান করিতে লাগিলেন এবং কালক্রমে শিব-বরে এক পুত্র-রত্ন প্রসব করিলেন। রাজ্যে আনন্দের বন্যা বহিল।

  1. ত্রিপুর রাজচিহ্নঃ—(১) চন্দ্রধ্বজ, (২) ত্রিশূলধ্বজ, (৩) মীন মানব, (৪) শ্বেতচ্ছত্র, (৫) আরঙ্গী (ব্যজন), (৬) তাম্বুল পত্র, (৭) হস্তচিহ্ন, (৮) রাজলাঞ্ছন (Coat of Arms); দরবার উপলক্ষ্যে এই চিহ্নসকল ব্যবহৃত হয়।