রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/প্রথম পরিচ্ছেদ/৬
(৬)
ত্রিপুরা নামের হেতু ও ত্রিপুর রাজচিহ্ন
ত্রিপুরের অমিত বিক্রম হইতে ত্রিপুরা নামোৎপত্তির কথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। ত্রিপুরের নামে তাঁহার বংশ ত্রৈপুর আখ্যা পাইয়াছিল। মহাভারতের সভাপর্ব্বে সহদেব দিগ্বিজয় অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছেঃ—
মাদ্রীসুতস্ততঃ প্রায়াদ্বিজয়ী দক্ষিণা দিশং।[১]
ত্রৈপুরং স্ববশে কৃত্বা রাজানমমিতৌজসম্॥ ৬০
ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি ত্রিপুরারি শিবের সহিত জড়িত। সতীর দক্ষিণপদ ত্রিপুরাতে পড়িয়াছে, তাই পীঠস্থানে ত্রিপুরাসুন্দরীর বিগ্রহ রহিয়াছে। যেখানে দেবীর আসন থাকে সেখানে ভৈরবও বাস করেন। বর্ত্তমানে উদয়পুরে ত্রিপুরাসুন্দরী বিরাজিতা, সেখানে ভৈরব ত্রিপুরেশ শিব। শিবের প্রসাদেই চতুর্দ্দশ কুলদেবতার আবির্ভাব হয়। সুতরাং শিবের ত্রিপুরারি নামের সহিত এ রাজ্যের সব কিছু জড়িত। দিগ্বিজয়ী দুর্দ্দান্ত ত্রিপুরের নামেও ত্রিপুরারি শিবের স্মৃতিই রক্ষিত।
রাজচিহ্ন সম্বন্ধে শিবের নির্দ্দেশ পূূর্ব্বে উক্ত হইয়াছে। এখানে ত্রিপুরার রাজচিহ্নের একটু বিবরণ দেওয়া যাইতেছে।
১। চন্দ্রধ্বজ—ইহা সোণার অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি চিহ্ন, রৌপ্যদণ্ডের উপরিভাগে সংযুক্ত; ইহা সিংহাসনের দক্ষিণ পার্শ্বে ধারণ করা হয়।
২। ত্রিশূলধ্বজ—ইহাও সুবর্ণ নির্ম্মিত ত্রিশূলাকার চিহ্ন, রৌপ্যদণ্ডের উপর সংযুক্ত।
৩। মীন মানব—ইহার ঊর্দ্ধভাগ কটিদেশ পর্য্যন্ত নারীমূর্ত্তি, তন্নিম্ন ভাগ মীনাকৃতি। এই চিহ্ন জলদেবী গঙ্গার প্রতিমূর্ত্তিরূপে গণ্য হইয়া থাকে, ইহার দক্ষিণ হস্তে একটি পতাকা, প্রজার নিকট ইহা রাজধর্ম্মের সুরধুনীতুল্য পবিত্রতা ঘোষণা করিতেছে। প্রতি বৎসর এই রাজ্যে গঙ্গা পূজা হইয়া থাকে। মীন মকরস্থলীয় হইয়া গঙ্গার বাহন।
৪। শ্বেতচ্ছত্র—ইহা চন্দ্রবংশীয় নৃপতি ও প্রধান ব্যক্তির একটি বিশেষ চিহ্ন, মহাভারতে ভীষ্মের উপর শ্বেতচ্ছত্র বিরাজিত এইরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়।
৫। আরঙ্গী—ইহা শ্বেতচ্ছত্র নির্ম্মিত ব্যজন বিশেষ। মহারাজ ত্রিলোচনের বিবাহ যাত্রাকালেও শ্বেতচ্ছত্রের সহিত এ চিহ্ন সঙ্গে ছিল।
৬। তাম্বুল পত্র (পান)—এই চিহ্ন রৌপ্য নির্ম্মিত। ইহা সিংহাসনের বাম পার্শ্বে ধারণ করা হয়। হিন্দুগণ শান্তি ও মঙ্গলের চিহ্নস্বরূপ তাম্বুল ব্যবহার করিয়া থাকেন।
৭। হস্তচিহ্ন (পাঞ্জা)—এই চিহ্নটিও রৌপ্য নির্ম্মিত। ইহা সিংহাসনের বাম পার্শ্বে ধারণ করা হয়। জগন্মাতা আদ্যাশক্তির ‘অভয়মুদ্রা’ হইতে এই চিহ্ন গৃহীত হইয়াছে।
৮। রাজলাঞ্ছন (Coat of Arms)—এই চিহ্নের সর্ব্বোপরি ত্রিশূলধ্বজ, তন্নিম্নে চন্দ্রধ্বজ, তাহার দুই পার্শ্বে চারিটি পতাকা ও দুইটি সিংহ অঙ্কিত রহিয়াছে। মধ্যস্থলে একটি ঢাল। সিংহ ক্ষাত্রবীর্য্যের বা রাজশক্তির পরিচয় জ্ঞাপক; পতাকা চতুষ্টয় হস্তী, আরোহী, ঢালী, তীরন্দাজ এবং গোলন্দাজ—এই চতুরঙ্গ বাহিনীর নির্দ্দেশ স্বরূপ। মধ্যস্থলে অঙ্কিত ঢালকে চারিভাগে বিভক্ত করিয়া এক একভাগে নিম্নোক্ত এক একটি চিহ্ন অঙ্কন করা হইয়াছে যথাঃ
১। মীন মানব ২। তাম্বুল পত্র ৩। হস্তচিহ্ন (পাঞ্জা) ৪। পাঁচটি তারা, তারা পাঁচটি পঞ্চশ্রী সমন্বিত রাজশ্রীর পরিচায়ক, পাঁচ শ্রী ব্যবহারের অর্থও আছে যথাঃ
আদ্যা কীর্ত্তিদ্বিতীয়া প্রকৃতিষু করুণা দাম্ভতাসাং তৃতীয়া
তুর্য্যাস্যাৎ দানশৌণ্ড্যং নৃপকুলমহিতা পঞ্চমী রাজলক্ষ্মী
উক্তচিহ্নের নিম্নভাগে দেবনাগরী অক্ষরে একটি প্রবচন অঙ্কিত আছে। “কিল বিদুর্বীরতাং সারমেকম্”। ইহার তাৎপর্য্য—বীর্য্যই একমাত্র সার। এই সুদৃঢ় নীতি-বাকোর উপর ত্রিপুর রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত।
৯। সিংহাসন—ইহা ষোলটি সিংহধৃত অষ্টকোণ বিশিষ্ট আসন। মহারাজ ত্রিলোচনের রাজ্যাভিষেক কালেও সিংহাসন ছিল, শ্রীরাজমালায়ই তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। ষোলটি সিংহের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে অষ্টকোণে সংস্থাপিত আটটি সিংহ কর্ত্তৃক উক্ত সিংহাসন ধৃত হইয়াছে—ক্ষুদ্রাকারের অপর আটটি সিংহ উপলক্ষ্য মাত্র।
এই সিংহাসন অনেকবার সংস্কৃত হইয়া থাকিলেও প্রাচীন উপকরণ যতদূর সম্ভব স্থিরতর রাখা হইয়াছে। ত্রিপুরেশ্বরগণ রাষ্ট্রবিপ্লবে বিধ্বস্ত হইয়া সময় সময় রাজপাট পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেও সিংহাসন এবং চতুর্দ্দশ দেবতা কোন কালেই পরিত্যাগ করেন নাই, সর্ব্বদাই সঙ্গে সঙ্গে রাখিতেন এবং তাহা অসম্ভব হইলে বিশ্বস্ত পার্ব্বত্য প্রজার আলয়ে গচ্ছিত রাখিতেন। কোন কোন সময় সিংহাসন, নিভৃত গিরিনির্ঝরিণীতে নিমজ্জিত করিয়া রাখিবার কথাও শুনা যায়। এই কারণে সমসের গাজী উদয়পুরের রাজধানী অধিকার করিয়াও সিংহাসন না পাওয়ায় বাঁশের সিংহাসন নির্ম্মাণ করাইয়া ‘লক্ষ্মণমাণিক্যকে’ সিংহাসনে স্থাপন করিয়াছিলেন।
যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞকালে ত্রিপুরেশ্বরকে বর্ত্তমান সিংহাসন প্রদান করেন, ত্রিপুরা রাজ্যে এইরূপ প্রবাদ আছে। সিংহাসন সম্মুখে প্রতিদিন চণ্ডীপাট এবং যথানিয়মে উক্ত আসনের অর্চ্চনা হয়। তৎসহ কতিপয় শালগ্রামচক্রও অর্চ্চিত হইয়া থাকেন।[২]
- ↑ ত্রৈপুর নামে ত্রিপুরের রাজ্যের উল্লেখ আরও পাওয়া যায়:—
প্রাগ্জ্যোতিষাদনু নৃপঃ কৌশল্যোঽথ বৃহদ্বলঃ।
মেকলৈঃ কুরুবিন্দৈশ্চ ত্রৈপুরৈশ্চ সমন্বিতঃ॥…মহাভারত ভীষ্মপর্ব্ব ৮৭ অঃ, ৯ম শ্লোক।বরেন্দ্রতাম্রলিপ্তঞ্চ হেড়ম্বমণিপুরকম্।
লৌহিত্যত্রৈপুরং চৈব জয়ন্তাখ্যং সুসঙ্গকম্।—বিশ্বকোষধৃত ভবিষ্য পুরাণ–ব্রহ্মখণ্ড। - ↑ স্বর্গীয় কালীপ্রসন্ন বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের রাজচিহ্ন প্রবন্ধ হইতে সংগৃহীত।