রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।


বঙ্গে স্ত্রীশিক্ষার আয়োজন।

১৮৪৬—১৮৫৩ পর্য্যন্ত।

 ১৮৪৬ সালের ১লা জানুয়ারি মহাসমারোহ সহকারে কৃষ্ণনগর কালেজ খোলা হইল। কৃষ্ণনগরের পক্ষে সে দিন এক স্মরণীর দিন। সে সময়ে শ্রীশচন্দ্র নদীয়ার রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি এই নব-প্রতিষ্ঠিত কালেজের উৎসাহদাতা হইলেন। তৎপূর্ব্বে নদীয়ার রাজবংশের কোনও সন্তান সাধারণের সহিত এক সঙ্গে শিক্ষালাভ করে নাই। রাজারা নানা স্থান হইতে সুযোগ্য ওস্তাদ আনাইয়া স্বীয় পরিবারের বালকদিগের শিক্ষার ব্যবস্থা করিতেন। শ্রীশচন্দ্র সে নিয়মের ব্যতিক্রম করিয়া স্বীয় পুত্র সতীশচন্দ্রকে কালেজে পড়িতে দিবার সংকল্প করিলেন; এবং নিজে কালেজ কমিটীর একজন সভ্য হইলেন। কেবল যে নামমাত্র সভ্য হইলেন তাহা নহে, কমিটীর প্রত্যেক অধিবেশনে উপস্থিত থাকিয়া কার্য্য-নির্ব্বাহ বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করিতে লাগিলেন।

 সুপ্রসিদ্ধ ডি, এল, রিচার্ডসন সাহেব কালেজের প্রথম অধ্যক্ষ হইয়া গমন করিলেন; এবং লাহিড়ী মহাশয় এক শত টাকা বেতনে দ্বিতীয় শিক্ষক নিযুক্ত হইয়া গেলেন। সে সময়ে যাঁহারা কৃষ্ণনগর কালেজে লাহিড়ী মহাশয়ের ছাত্র ছিলেন, তাঁহাদের মুখে যখন তাঁহার তৎকালীন উৎসাহ ও অনুরাগের কথা শুনি তখন চমৎকৃত হইয়া যাই। তিনি যখন পড়াইতে বসিতেন তখন দেখিলে বোধ হইত যেন পৃথিবীতে তাঁহার করিবার বা ভাবিবার অন্য কিছু নাই। সমগ্র দেহ-মন-প্রাণ তাহাতে ঢালিয়া দিতেন। তিনি স্বীয় কার্য্যে এমনি তন্ময় হইয়া যাইতেন যে এক এক দিন কালেজের অধ্যক্ষ বা হেড মাষ্টার তাঁহাকে কিছু বলিবার অভিপ্রায়ে তাঁহার ঘরে প্রবেশ কমিয়া পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়া অবাক হইয়া তাঁহার পড়ান শুনিতেন; একটু অবসর পাইলে কথা কহিবেন বলিয়া অপেক্ষা করিতেন। তাঁহার পাঠনার রীতি এই ছিল যে কোনও পাঠ্য বিষয়ের প্রসঙ্গে কোনও জ্ঞানের কথা পাইলে তিনি সে সম্বন্ধে বালকদিগের জ্ঞাতব্য যাহা কিছু আছে তাহা সমগ্রভাবে না বলিয়া সস্তুষ্ট হইতে পারিতেন না। পড়াইতে পড়াইতে যদি আরবের নাম কোথাও পাইলেন তাহা হইলে আরবের প্রাকৃতিক অবস্থা, তাহার অধিবাসীদের স্বভাব ও প্রকৃতি, মহম্মদের জন্ম ও ধর্ম্ম প্রচারের বিবরণ প্রভৃতি বালকদিগকে না জানাইয়া সন্তুষ্ট হইতে পারিতেন না। এইরূপ অধ্যাপনায় পাঠ্যগ্রন্থগুলি পাঠের বিষয়ে বিশেষ উন্নতি লক্ষিত হইত না বটে, কিন্তু বালকের যথার্থ জ্ঞান লাভ করিত; এবং তাহা অপেক্ষা অধিক প্রশংসার বিষয় এই যে ইহা তাহাদের অন্তরে জ্ঞানানুরাগ উদ্দীপ্ত করিত। কেবল তাঁহা নহে তিনি কালেজের ছুটীর পর ডিরোজিওর ন্যায় বালকদিগের সহিত কথাবার্তাতে অনেকক্ষণ যাপন করিতেন। অনেক সময়ে কলেজের মাঠে তাহাদের সঙ্গে খেলিতেন। এইভাবে তাঁহার কৃষ্ণনগরের শিক্ষকতা কার্য্য আরম্ভ হইল।

 এই সময়ে দুই দিক হইতে দুই স্রোত আসিয়া ক্ষুদ্র কৃষ্ণনগর সমাজে মহা তরঙ্গ উত্থিত করিল। তাহার বিবরণ ক্ষিতীশবংশাবলি-চরিত হইতে উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ—

 “১২৪৩ কি ৪৪ বাং অব্দে কৃষ্ণনগরনিবাসী দেশহিতৈষী শ্রীযুক্ত শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ী (রামতনু বাবুর কনিষ্ঠ) নিজ নিকেতনে এক অবৈতনিক ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। * * * তৎকালে শ্রীপ্রসাদের স্বদেশীয় প্রচলিত ধর্ম্মের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল, সুতরাং তিনি প্রথমে এই ধর্ম্মবিরুদ্ধ কোনও উপদেশ দিতেন না। কিয়ৎকালানন্তর তিনি ও তাঁহার সমবয়স্ক দুই তিন জন ছাত্র স্বদেশের ধর্ম্ম ও রীতি-নীতির গুণাগুণের বিষয় আলোচনা করিতে আরম্ভ করেন; এবং ক্রমশঃ সাকার উপাসনার অলীকতা ও প্রচলিত আচার ব্যবহারের দোষ গুণ বুঝিতে পারেন। তিনি পূর্ব্বে ছাত্রগণের মনোবৃত্তির উন্নতিসাধনে যেমন যত্ন করিতেন, ইদানীং ধর্ম্ম-প্রবৃত্তির উৎকর্ষ সম্পন্ন করণেও তেমনি যত্নবান হইলেন।”

 “কিছুদিন পরে তাঁহার মতাবলম্বী ছাত্রগণ আপন আপন প্রতিবেশী ও আত্মীয়গণের কুসংস্কার দূরীভূত, করিতে প্রগাঢ় যত্ন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে সোণাডেঙ্গানিবাসী, অধুনা কৃষ্ণনগরবাসী, শ্রীযুক্ত ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় এই নগরস্থ মিশনারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মিশনারিরা তাহাকে খ্রীষ্ট্ৰীয়-ধর্ম্মাবলম্বী করিতে বহু প্রয়াস পাইয়াছিলেন; কিন্তু সফল-প্রযত্ন হইতে পারেন নাই। তিনি এক-ব্রহ্ম-বাদী হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু খ্রীষ্টের ঈশ্বরত্বের প্রতি তাঁহার বিশ্বাস হয় নাই। তিনিও শ্রীপ্রসাদের অনুকরণ করিয়া আপনার ছাত্র ও বান্ধবদিগের দূষিত সংস্কার সকল দূরীভূত করণে প্রবৃত্ত হন; এইরূপে কৃষ্ণনগরে প্রচলিত ধর্ম্মের বিপ্লব ঘটিয়া উঠে। ক্রমে ক্রমে নগরের অনেক যুবা এই অভিনব মতের অনুরাগী হইলেন। যদিও তাঁহাদের বাহ্যিক ভাবের বড় বৈলক্ষণ্য হইল না, কিন্তু আন্তরিক ভাবের প্রভূত পরিবর্ত্তন হইল। নূতন সম্প্রদায়ের আন্তরিক ভাব যে এককালে সাধারণের অগোচর ছিল এমনও নহে, নগরের অনেক প্রধান বংশোদ্ভূত যুবকগণ ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়াছিলেন এবং রাজা তাঁহাদিগকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও আদর করিতেন এই বলিয়া কোনও গোলযোগ উপস্থিত হইত না।”

 শ্রীশচন্দ্র কেবল পূর্ব্বোক্ত ধর্ম্মসংস্কারার্থী যুৱকদলকে আদর শ্রদ্ধা করিতেন তাহা নহে, তিনি নিজে রাজবাটীতে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করিয়া পরব্রহ্মের উপাসনা প্রচারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ক্ষিতীশবংশাবলি-চরিতকার আর এক স্থানে লিখিতেছেন:—

 তিনি (শ্রীশচন্দ্র। ১৮৪৪ খৃঃ অন্ধে এ প্রদেশস্থ তিন ব্যক্তিকে ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়া রাজা রামমোহন রায়ের স্থাপিত কলিকাতার তদানীন্তন ব্রাহ্ম সমাজের প্রণীত ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণের নিয়ম-পত্রে তাহাদের স্বাক্ষর করাইলেন এবং ব্রাহ্মধর্ম্ম বিস্তার করণার্থ একজন বেদবিৎ উপদেষ্টাকে পাঠাইতে তৎকালীন উক্ত-সমাজাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরকে পত্র লিখিলেন। তিনি সহসা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত না পাইয়া হাজারি লাল নামে একজন ব্রাহ্মধর্ম্ম-প্রচারককে পাঠাইয়া দিলেন। হাজারি একে শূদ্রজাতি তাহাতে আবার খেদবেত্তা ছিলেন না, একারণ রাজা নিজে সাতিশয় ক্ষুণ্ণমনা হইলেন। তৎকালে রাজার নিকট ভাটপাড়া-নিবাসী গোবিন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ নামে একজন পণ্ডিত ছিলেন; তিনি বেদান্ত ও ন্যায় প্রভৃতি শাস্ত্রে সবিশেষ ব্যুৎপন্ন কিন্তু লোকনিন্দা-ভয়ে প্রকাশ্যরূপে বেদান্ত-ধর্ম্ম প্রচারে সন্মত ছিলেন না; সুতরাং রাজা হাজারিকে তৎক্ষণাৎ বিদায় না করিয়া রাজধাটীতে তাহার বাসস্থান নির্দ্দিষ্টি করিয়া দিলেন।

 “দুই তিন দিবস পরে রাজা কোনও প্রয়োজনানুরোধে মুরশিদাবাদে গমন করিলেন; এবং হাজারি ও ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি ব্রাহ্মধর্ম্মপ্রচারের ভার অর্পণ করিয়া গেলেন। রাজা মাসাবধি মুরশিদাবাদে অবস্থান করেন; এইকাল মধ্যে কৃষ্ণনগরে প্রায় চল্লিশ জন যুব ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিত হইলেন; এবং জ্যৈষ্ঠ কি আষাঢ় মাসে দুই বুধবারে সকলে একত্রিত হইয়া পরব্রহ্মের উপাসনা করিলেন। রাজ শূদ্রজাতীয় হাজারি সমাজের উপাচার্য্যের কার্য্য সম্পাদন করিতেছেন শুনিয়া সাতিশয় বিরক্ত হইলেন এবং বাটী প্রত্যাগত হইয়া ব্রাহ্মদিগকে রাজবাটীতে সমাজ করিতে নিষেধ করিলেন। ব্রাহ্মগণ আমিনবাজারে একটী ক্ষুদ্র বাটী ভাড়া করিয়া তন্মধ্যে সমাজ সংস্থাপন করিলেন; এবং আপাততঃ ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য্যেয় কার্য্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। অল্পদিন মধ্যেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বেদবেত্ত ব্রাহ্মণ উপাচার্য্য প্রেরণ করিলেন।

 “ব্রাহ্মগণের শ্রেণী যেমন বর্দ্ধিত হইতে লাগিল, নগরমধ্যে এ বিষয়ের আন্দোলন তেমনি বাড়িয়া উঠিল। তাঁহারা বারনগরনিবাসী শ্রীযুক্ত বামনদাস মুখোপাধ্যায়কে সহায় করিয়া গোঁয়াড়িতে এক ধর্ম্মসভা প্রতিষ্ঠিত করিলেন; এবং ব্রাহ্মদিগের অনিষ্টসাধনে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলেন। কিন্তু মহারাজ ব্রাহ্মগণের স্বপক্ষ থাকাতে ব্রাহ্মধর্ম্মের উন্নতি ব্যতীত অবনতি হইল না। কিছুদিন পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আনুকূল্যে ও ব্রাহ্মগণের প্রযত্নে ১৭৬৯ শকে (১৮৪৭ খৃঃ অব্দে) বর্ত্তমান সমাজ-মন্দির নির্ম্মিত হইল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গৃহ নির্ম্মাণার্থ এক সহস্র টাকা দান করেন।”

 পাঠকগণ দেখিতেছেন কলিকাতার অনুকরণে কৃষ্ণনগরে যে কেবল ব্রাহ্মধর্ম্মের অন্দোলন উঠিয়াছিল তাহা নহে, ধর্ম্মসভাও স্থাপিত হইয়াছিল; এবং প্রধান প্রধান ধনিগণ তাহার সারথি-স্বরূপ হইয়া নব্যদলের শাসনে বদ্ধ-পরিকর হইয়াছিলেন। মহারাজ শ্রীশচন্দ্র এই উভয়দলের মধ্যে দণ্ডায়মান; সমগ্র হিন্দুসমাজ এবং নবদ্বীপের পণ্ডিতমণ্ডলী তাহার পশ্চাতে, সুতরাং তিনি পুর্ণমাত্রায় নবোত্থিত বেদান্তধর্ম্মের মুখপাত্র হইতে পারিলেন না; কিন্তু উৎসাহদান, অনুরাগ, আদর, শ্রদ্ধা প্রভৃতির দ্বারা যতদূর হয় করিতে লাগিলেন। কেবল তাহা নহে, তিনি নবদ্বীপ হইতে বড় বড় পণ্ডিতদিগকে আনাইয়া তাহাদের সহিত বিচার উপস্থিত করিলেন—“কেন আপনারা বেদ-বিহিত বেদান্ত ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিবেন না?” ফল কি হইল তাহা উক্ত গ্রন্থকার সংক্ষেপে এইরূপ বর্ণন করিয়াছেন,—  “বুদ্ধিমান ও বিদ্বান পণ্ডিতগণের মধ্যে যাহারা সরলচিত্ত তাঁহারা মহারাজের অভিপ্রায় শাস্ত্রসন্মত ও সর্ব্বজন-হিতকর বলিয়া স্বীকার করিলেন; কিন্তু দেশাচার ভয়ে জনসমাজে আপনাদের মত প্রকাশ করিতে বা তদনুযায়ী ব্যবস্থা দিতে সাহস করিতে পারিলেন না।”

 অনেকে হয় ত স্বভাবতঃ মনে করিবেন যে লাহিড়ী মহাশয় কৃষ্ণনগরে পদার্পণ করিয়াই ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বেদান্তধর্ম্মাবলম্বী সংস্কারকদলের অগ্রণী হইলেন। কিন্তু তাহা নহে। ১৮৪৫ সালে, উমেশচন্দ্র সরকারের আন্দোলন উঠিলে, কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ একদিকে আপনার ধর্ম্মকে বেদান্তধর্ম্ম ও বেদকে অভ্রান্ত ঈশ্বর-বাণী বলিয়া ঘোষণা করিতে লাগিলেন, এবং অপর দিকে খ্রীষ্টীয়ধর্ম্মের প্রতি কটুক্তি বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। এই উভয় কার্য্য-নীতিই সত্যানুরাগী ডিরোজিও-শিষাদলের চক্ষে নিন্দনীয় বোধ হইয়াছিল। লাহিড়ী মহাশয় ব্রাহ্মধর্ম্মাবলম্বিগণের মুখে বেদের অভ্রান্ততাবাদ কপটতা বলিয়া অনুভব করিতে লাগিলেন; এবং খ্রীষ্টীয়ধর্ম্মের নিন্দা অনুদারতা বলিয়া প্রতীতি করিলেন; সুতরাং তিনি বেদান্তধর্ম্মীদিগের সহিত সংযুক্ত হইলেন না। সংযুক্ত হওয়া দূরে থাক্ তাহাদের পত্রিকা “তত্ত্ববোধিনী” লইতেও স্বীকৃত হইলেন না; এবং তাহাদের মন্দিরের নির্মাণকার্য্যে বিশেষ সহায়তা করিলেন না। কেন তিনি ইহাদের প্রতি চটিয়াছিলেন তাহার কারণ উক্ত সময়ে ভক্তিভাজন রাজনারায়ণ বসু মহাশয়কে লিখিত পত্রের নিম্নলিখিত অংশ হইতে জানা যাইবে।

 ১৮৪৬ সালের ২৪ জুলাই কৃষ্ণনগর হইতে তিনি কলিকাতাতে রাজনারায়ণ বসু মহাশয়কে পত্র লিখিতেছেন। রাজনারায়ণ বাবু তখন হিন্দুকালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া ঐ বর্ষের প্রারম্ভে ব্রাহ্মধর্ম্মে বা তদানীন্তন বেদান্তধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের ভবনে গতায়াত করিতেছেন; এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে উপনিষদের ইংরাজী অনুবাদ কার্য্যে অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয়ের সহকারী হইবেন, এইরূপ প্রস্তাব চলিতেছে। রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ ডিরোজিও শিষ্যদলের সহিত পূর্ব্ব হইতেই, যে রাজনারায়ণ বাবুর আলাপ পরিচয় ও আত্মীয়তা জন্মিয়ছিল তাহার প্রমাণ এই পত্রে পাওয়া যাইতেছে।

My DEAR RAJNARAIN,
 I cannot think much of the Vedantic movements here or elsewhere. The followers of Vedanta temporize. They do not believe that the religion is from God, but will not say so to their countrymen, who believe otherwise. Now, in my humble opinion, we should never preach doctrines as true, in which we have no faith ourselves. I know that the subversion of idolatry is a consummation devoutly to be wished for, but I do not desire it by employing-wrong means. I do not allow the principle that means justify the end. Let us follow the right path assured that it will ultimately promote the welfare of, mankind. It can never do otherwise.

 I wish to request the Secretary of the Tuttobodhini Sabha to discontinue sending me the Society's paper (Patrika), as a person cannot subscribe to it who is not a member of the Society. * * * I fear also that there is a spirit of hostility entertained by the Society against Christianity which is not creditable. Our desire should be to see truth triumph. Let the votaries of all religions appeal to the reason of their fellow-creatures and let him who has truth on his side prevail.”

 যে সরল সত্য-প্রিয়তার ও উদারতার নিদর্শন লাহিড়ী মহাশয়ের জীবনে আমরা উত্তরকালে দেখিয়াছি, তাহা এই যৌবনের প্রথমোদ্যমেও দেখিতেছি। ব্রাহ্মসমাজের লোক যতদিন মুখে বলিয়া কার্য্যে তাহা না করিতেন, ততদিন তিনি ইহার সঙ্গে যোগ দেন নাই,—উৎসাহ দিতেন, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে প্রতি ও শ্রদ্ধা করিতেন, কিন্তু তাহাদের সহিত একীভূত হইতেন না। পরে উন্নতিশীল ব্রাহ্মদল দেখা দিলে তাহাদের সহিত যোগ দিয়াছিলেন।

 লাহিড়ী মহাশয় নবোদিত ব্রাহ্মধর্ম্মের সহিত যোগ দিলেন না বটে কিন্তু তাঁহার আবির্ভাবে ও তাঁহার সংশ্রবে কৃষ্ণনগরের শিক্ষিত যুবকদলের মধ্যে এক নবভাবের অবির্ভাব হইল। তিনি শিক্ষাগুরু ডিরোজিওর নিকটে যে যে মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া আসিয়াছিলেন, তন্মধ্যে একটা প্রধান মন্ত্র এই ছিল যে, মানবের চিন্তা ও কার্য্যকে স্বাধীন রাখিতে হইবে। হিন্দু কালেজ কমিটী কালেজের ছাত্রদিগকে ডফ্‌ ও ডিএলট্রির বক্তৃতা শুনিতে যাইতে নিষেধ করিলে ডিরোজিও তাহার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। সেই ভাব তাঁহার শিষ্যদলের মনে চিরদিন পূর্ণমাত্রায় কার্য্য করিয়াছে। তাঁহারা চিরদিন মানবের স্বাধীনতাকে পবিত্র পদার্থ মনে করিয়া আসিয়াছেন; কোনও কারণেই তাহাতে হস্তার্পণ করিতে প্রবৃত্ত হন নাই। লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবনের পূর্ণ উৎসাহের মধ্যে সেই ভাব পূর্ণমাত্রায় কার্য্য করিতেছিল। তিনি শিক্ষকরূপে বালকদিগের মধ্যে বসিতেন বটে, কিন্তু অনেক সময়ে তাহাদের সহিত বয়স্যের ন্যায় ব্যবহার করিতেন। স্বীয় গুরু ডিরোজিওর ন্যায় কোনও একটা বিষয়ে তর্ক্ক তুলিয়া স্বাধীন ও অসংকুচিত ভাবে তাহাদিগকে স্বীয় স্বীয় মত ব্যক্ত করিতে দিতেন। নিজে পুর্ব্বপক্ষ লইয়া তাহাদিগকে উত্তরপক্ষ অবলম্বন করিতে উৎসাহিত করিতেন। কেবল যে মানবের চিন্তার স্বাধীনতাকে আদর করিতেন বলিয়া এইরূপ করিতেন, তাহা নহে, চিরজীবন তাঁহার এপ্রকার বাল-সুলভ বিনয় ছিল যে, জীবনের শেষদিন পর্য্যন্ত তিনি মনে করিতেন বালকের নিকটেও কিছু শিখিবার আছে। আমরা বয়সে তাঁহার পুত্রের সমান, অথচ অনেক সময় আমাদের একটী সামান্য মত বা উক্তি এরূপ সন্ত্রমের সহিত শুনিতেন যে আমাদের কথা কহিতে লজ্জা হইত। পূর্ব্বপুরুষগণ উপদেশ দিয়া গিয়াছেন, “বালাদপি সুভাষিতং গ্রাহ্যং” ভাল কথা বালকের মুখ হইতেও শুনিতে হইবে। লাহিড়ী মহাশয় কাজে তাহাই করিতেন। কোনও একটা প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়া কোন বালক কি বলে, তাহা মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করিতেন; এবং কাহারও মুখে কোনও একটা ভাল কথা শুনিলে আনন্দিত হইয়া উঠিতেন। “একথা তুমি কোথায় পাইলে? এরূপ কথা তোমাকে কে শুনাইল!” বলিয়া তাহাকে অস্থির করিরা তুলিতেন। যদি শুনিতেন যে সে নিজগৃহে গুরুজনের মুখে শুনিয়াছে, অমনি বলিতেন “হবে না, কিরূপ বংশের ছেলে।” চিরদিন বংশ-মর্য্যাদার প্রতি তাঁহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল যাহা হউক এইরূপ স্বাধীন বিচারের ভাব প্রবর্ত্তিত হওয়াতে কৃষ্ণনগরের শিক্ষিত যুবকদলের মধ্যে এক নবভাব দেখা দিল। তাহারা স্বাধীন ভাবে সমুদয় সামাজিক বিষয়ের বিচারে প্রবৃত্ত হইল।

 এই সময়ে কিছুদিন ধরিয়া কৃষ্ণনগরে একটা বিষয়ের বিচার চলিতেছিল— তাহা বিধবা-বিবাহ। অনেকের সংস্কার আছে, পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ই সর্ব্ব-প্রথমে বঙ্গসমাজে বিধবা-বিবাহের বিচার উপস্থিত করেন। কিন্তু বোধ হয় তাহা ঠিক নহে। ১৮০২ সাল হইতে রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ ডিরোজিও শিষ্যগণ যে “বেঙ্গল স্পেক্টেটার” নামক কাগজ বাহির করিতে আরম্ভ করেন, তাহাতে তাঁহারা বিধবা-বিবাহের বৈধতা বিষয়ে বিচার উপস্থিত করেন, কয়েক মাস ধরিয়া ঐ পত্রে উক্ত বিচার চলিয়াছিল। এমন কি “নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে” ইত্যাদি যে পরাশর বচনের উপরে ভিত্তি স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় বঙ্গীয় পণ্ডিত-মণ্ডলীর সহিত তর্ক্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, তাহা সর্ব্বপ্রথমে উক্ত পত্রে বিচারের মধ্যে উদ্ধৃত করা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার এই পণ্ডিতদ্বয় পশ্চাতে থাকিয়া ঐ সকল বচন উদ্ধৃত করিয়া লেখকদিগের হস্তে দিয়াছিলেন কি না বলিতে পারি না। তাহার কোনও প্রকাশ নাই। তবে উক্ত পণ্ডিতদ্বয়ের সহিত নব্যবঙ্গের নেতৃবৃন্দের যে বিশেষ আত্মীয়তা ছিল, তাহা জ্ঞাত আছি। স্বর্গীয় রাজনারায়ণ বসু মহাশয় তাঁহার স্বহস্তলিখিত একখানি জীবনচরিত রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাতে দেখিতেছি যে ১৮৪৩ সালে একবার রামগোপাল ঘোষ মহাশয় স্বীয় “লোটাস” নামক জাহাজে করিয়া কতিপয় বন্ধুসহ গঙ্গা পরিভ্রমণ করিতে বাহির হইয়াছিলেন। রাজনারায়ণ বাবু ও পণ্ডিতবর মদনমোহন তর্কালঙ্কার সেই কতিপয় বন্ধুর মধ্যে ছিলেন। অতএব বিধবা-বিবাহ বিষয়ক বচন উদ্ধৃত করিয়া বেঙ্গল স্পেকটেটারে লেখকগণের সাহায্য করা পণ্ডিতদ্বয়ের পক্ষে কিছুই বিচিত্র নহে।

 তবেই দেখা যাইতেছে বিধবা-বিবাহ প্রবর্ত্তিত করা যে কর্ত্তব্য এই বিশ্বাস ১৮৪৩ সাল হইতে চক্রবর্ত্তী ফ্যাকশনের সভ্যগণের সকলের মনে বদ্ধমূল হইয়াছিল। তাঁহারা দশজনে একত্র হইলেই সে বিষয়ে আলোচনা করিতেন, উৎসাহের সহিত সেই মত প্রচার করিতেন, চারিদিকে তাহা লইয়া তর্ক বিতর্ক করিতেন। ক্রমে এই মত কৃষ্ণনগরেও যায়।

 রাজা শ্রীশচন্দ্র নিজে নবদ্বীপের পণ্ডিতমণ্ডলীর সহিত বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে বিচার করিতে প্রবৃত্ত হন। এরূপ আশা হইয়াছিল যে পণ্ডিতগণকে লওয়াইয়া তিনি কাজে কিছু করিলেও করিতে পারেন। যে কারণে তিনি সে বিষয়ে নিরুদ্যম হন, তাহার বিবরণ নিয়ে প্রদত্ত হইতেছে। ক্ষিতীশবংশাবলি চরিতকার মহারাজ শ্রীশচন্দ্রের কার্য্যকলাপের উল্লেখ করিতে গিয়া বলিতেছেনঃ—

 “রাজা বেদানুমোদিত পরব্রহ্মের আরাধনা প্রচলিত করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়াছিলেন, তথাপি বিধবা কামিনীদিগের অবস্থা একদিনের নিমিত্তও বিস্মৃত হন নাই। তিনি এই স্থির করিয়াছিলেন যে, এপ্রদেশে বিধবা-বিৱাহ প্রচলিত করা শাস্ত্রের সহায়তায় যতদূর হইবেক, কেবল যুক্তি অবলম্বন করিলে ততদূর হইবেক না; একারণ, যদ্যপিও এদেশস্থ পণ্ডিতগণ বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রানুমোদিত স্বীকার করিয়াও তাহার ব্যবস্থা দিতে অসম্মত হন, তথাপি রাজা এই ব্যবস্থা পাইবার নিমিত্ত বিবিধ কৌশল অবলম্বন করেন। অবশেষে নবদ্বীপস্থ কয়েকজন পণ্ডিত পুরস্কার লাভাশয়ে ব্যবস্থা দিতে সন্মত হন। ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ হইতেছে, এমন সময়ে, নগরস্থ নব্যসম্প্রদায় সহসা এখানকার কালেজগৃলে এক সভা করিয়া স্বদেশের প্রচলিত রীতি নীতির বহুবিধ নিন্দাবাদ করণান্তর বিধবা-বিবাহ প্রচলিত করিতে যথাসাধ্য যত্ন করিবেন এইরূপ প্রতিজ্ঞা প্রকাশ করিলেন। ইহাতে বিরুদ্ধবাদিগণ, নবমতাবলম্বীরা কালেজে একত্র হইয়া স্বহস্তে গোঁহত্যা করিয়া, তাহার মাংস ভোজন ও মদিরা পান করিয়াছেন, এইরূপ অপবাদ সর্ব্বত্র রটনা করিয়া দিলেন। এই অমূলক কথা দূর ও অদুরবর্ত্তী নানা স্থানে আন্দোলিত হইতে লাগিল। প্রথমে বীরনগরবাসী বামনদাস মুখোপাধ্যায় আপন স্বসম্পৰ্কীয় বালকগণের কালেজে যাওয়া রহিত করিলেন; এবং দুই তিন দিনের মধ্যে অনেক ভদ্রলোক তাঁহার দৃষ্টান্তের অনুগামী হইলেন। কালেজে এরূপ সভা করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন বলিয়া, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কালেজের অধ্যক্ষ তিরস্কৃত হইলেন। মহারাজ, যাহাতে কালেজের হানি না হয়, তদ্বিষয়ে সাতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন। কিছুদিন পরেই উপরোক্ত জনরবের মূল বৃত্তান্ত প্রচারিত হইল, এবং যে সকল বালক কালেজ পরিত্যাগ করিয়াছিল, তাহারা পুনরায় কালেজে প্রবেশ করিল, কিন্তু নগর মধ্যে এক বিষম দলাদলি হইয়া উঠিল। যাহা হউক, মহারাজার আনুকুল্য প্রযুক্ত নব্যদল সবল থাকিল, এবং দুই তিন বৎসরের মধ্যে সমস্ত গোল তিরোহিত হইল। রাজা যে ব্যবস্থা লইবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন, তাহা এই গোলযোগে বিফল হইয়া গেল”।

 ঐ কালেজগৃহের সভার পূর্ব্বে আর একটা ঘটনা ঘটিয়াছিল যাহাতে লাহিড়ী মহাশয়ের শিষ্যদলের ঐ গোখাদক অপবাদ প্রবল হয়। সে ঘটনাটার বিবরণ দেওয়ান কার্ত্তিকের চন্দ্র রায় মহাশয়ের লিখিত আত্মজীবন-চরিত হইতে উদ্ধৃত হইতেছে —

 “কলিকাতা হইতে বাবু কালীকৃষ্ণ মিত্র নামক আমাদের একজন সুবিজ্ঞ সুহৃদ্বয় কৃষ্ণনগরে আসিলেন। তদীয় প্রত্যর্থে তাঁহাকে লইয়া বাবু রামতনু লাহিড়ী, শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ী, কালীচরণ লাহিড়ী, আরিণীচরণ রায়, বামাচরণ চৌধুরি প্রভৃতি দশ বার জন আত্মীয় ও আমি কৃষ্ণনগরের দেড়ক্রোশ পূর্ব্ব-দক্ষিণ আনন্দবাগ নামে উপবনে বনভোজন করিতে যাইলাম। তথা হইতে প্রত্যাগমনকালে নৌকায় নৌকায় আমাদের মধ্যে বিধবা-বিবাহের প্রস্তাব হইল। অনেকেই ইহার অনুকুল প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করিতে সম্মত হইলেন, কিন্তু কার্য্যকালে সকলেই স্থির-প্রতিজ্ঞ থাকিবেন, ইহা আমার বিশ্বাস হইল না। কয়েক দিবস পরে কৃষ্ণনগর কালেজগৃহে এবিষয়ের জন্য একটী সভা হইল। সভ্যগণের মধ্যে অধিকাংশ কালেজের ও স্কুলের ছাত্র।”

 “ষে দিবস আমরা আনন্দবাগে বনভোজন করি, তাহার পরদিন কোনও হিংস্ৰক ও দুরাচারী লোক আমার গ্রামস্থ অনেকের নিকট ব্যক্ত করিল যে, আমাদের বাটীর সন্নিহিত কোন স্থানে একটা গো-বৎসের মস্তক কতকগুলি ইষ্টকে আচ্ছাদিত রহিয়াছে ও মাথাটা দেখিয়াই বোধ হয় যেন তাহা অস্ত্র দ্বারা ছেদিত হইয়াছে। কিঞ্চিৎ পরে রটনা করিল যে কোনও ব্যক্তির এক গো-বৎস পাওয়া যাইতেছে না। পরদিবস কৃষ্ণনগরে কোন স্থানে বন্ধুলোকের সমাগম দেখিয়া গো-বৎস বৃত্তান্ত আরও কিঞ্চিৎ রঞ্জিত করিয়া কহিল যে, কেহ কেহ বলিতেছে যে, আনন্দবাগের বনভোজন জন্য এই গো-হত্যাটী হইয়াছে। নগর মধ্যে এই বিষয়ের তুমুল আন্দোলন হইতে লাগিল।”

 আমি কৃষ্ণনগরের সেকালের লোকের মুখে গুনিয়াছি ঐ গো-বৎস হত্যা বৃত্তান্তটা আনন্দবাগের বনভোজনের সহিত সংযুক্ত করিবার আরও একটা কারণ ছিল। যুবকদল বাস্তবিক একটা খাসী মরিয়াছিলেন, এবং তাহার দেহটা একটা বৃক্ষে ঝুলাইয়া রাখিয়াছিলেন। একজন লোক দূর হইতে দোদুল্যমান প্রাণিদেহটা দেখিয়া আসে ও নগরমধ্যে গো-বৎস হত্যা বিবরণ প্রচার করে, তারপর দেওয়ানজীর উল্লিখিত পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তি তাহাতে সাক্ষ্যযোগ করে। উভয় সাক্ষো মিলাতে, লোকের বিশ্বাস জন্মিতে আর বিলম্ব হইল না। সকলেই, অনুমান করিতে পারেন, ইহাতে যুবকদলে প্রতি কি ঘোর নির্য্যাতন উপস্থিত হইল।

 অনুমান করি পূর্ব্বোক্ত গোহত্যার আন্দোলন ও বিধবা-বিবাহের সভা ১৮৫০ সালের অবসানে বা ১৮৫১ সালের প্রারস্তে ঘটিয়া থাকিবে এবং সেই আন্দোলনেই লাহিড়ী মহাশয়ের কৃষ্ণনগর বাস ক্লেশকর করিয়া তুলে। একদিকে সামাজিক নির্য্যাতন অপরদিকে বৃদ্ধ পিতা ও আত্মীয় স্বজনের মানসিক অশাস্তি এই উভয়বিধ কারণে তাঁহার চিত্তকে উদ্বিগ্ন করিল। ১৮৪৮ কি ১৮৪৯ সালে তাঁহার যে প্রথম পুত্রটা জন্মিয়াছিল, সেটী এই সময়ে একটা দুৰ্ঘটনা ঘটিয়া মারা গেল। ঘুমাইতে ঘুমাইতে খাট হইতে পড়িয়া মস্তকে আঘাত লাগিয়াছিল। ৩৪ দিবস নানা প্রকার চিকিৎসাতেও জ্ঞান হয় নাই; শেষে তাহার প্রাণ যায়। তাহাতে আত্মীয় স্বজন বিধাতার অভিসম্পাত বলিয়া তাঁহার বালিকা পত্নীকে অস্থির করিয়া তুলেন। এই সকল কারণে ১৮৫১ সালের মার্চ্চমাসে বদলীর প্রার্থনা করিয়া তিনি বৰ্দ্ধমানে বদলী হইয়া যান। পরবর্ত্তী এপ্রিলমাসে দেড়শত টাকা বেতনে হেডমাষ্টার হইয়া বৰ্দ্ধমানে গমন করেন। তাঁহার প্রিয় বন্ধু রসিককৃষ্ণ মল্লিক তখন বৰ্দ্ধমানে ডেপুটী কালেক্টরী কাজ করিতেছিলেন, তাহাও তাঁহার বৰ্দ্ধমানে বদলী হইবার অন্ততম কারণ হইয়া থাকিবে।

 যখন কৃষ্ণনগরে পূর্ব্বোক্ত ঘটনা সকল ঘটিতেছিল, তখন কলিকাতাতে একটা নুতন কার্য্যের সূত্রপাত হইতেছিল। এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতি ও গবর্ণর জেনেরালের মন্ত্রিসভার অন্ততম সভ্য মহাত্মা ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন্‌ বা বেথুন এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্ত্তিত করিবার জন্য প্রয়াস পাইতেছিলেন। বীটন সাহেব ইংলণ্ডের স্যালফোর্ড নামক স্থান-নিবাসী কর্ণেল জন ড্রিঙ্কওয়াটারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। কর্ণেল ডিস্কওয়াটার জিব্রাণ্টার দুর্গের অবরোধের ইতিবৃত্ত লিখিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। বীটন যৌবনে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়া র্যাংলারের সন্মানিত পদ অধিকার করেন। তৎপরে আইন অধ্যয়ন করিয়া পার্লিরামেণ্টের কাউন্সেলের পদ প্রাপ্ত হন। এই পদ হইতে তিনি গবর্ণর জেনেরালের ব্যবস্থা-সচিবরূপে এদেশে প্রেরিত হন। তিনি বড় মাতৃভক্ত লোক ছিলেন; এবং এইরূপ কথিত আছে যে, মাতৃভক্তিই তাঁহার স্ত্রীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভারতীয় নারীগণের উন্নতি সাধনের ইচ্ছা সমুৎপন্ন করিয়াছিল।

 তিনি এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াই তাঁহার স্বভাব-সুলভ সদাশয়তার দ্বারা প্রণোদিত হইয়া, এদেশীয়দিগের কল্যাণ সাধনে নিযুক্ত হইলেন। এই সময়ে স্বৰ্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রভৃতি পণ্ডিতগণের সহিত তাঁহার পরিচয় ও আত্মীয়তা জন্মে। এই পণ্ডিতদ্বয়ের সাহায্যে ও দেশের ভদ্রলোকদিগের দ্বারা উৎসাহিত হইয়া তিনি স্ত্রীশিক্ষার উন্নতি বিধানে প্রবৃত্ত হন। ১৮৪৯ সালের ৭ই মে দিবসে তন্নাম-প্রসিদ্ধ বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বাটন এই কার্য্যে দেহ মনঃপ্রাণ নিয়োগ করেন; হেয়ার যেমন বালকদিগের শিক্ষা লইয়া মাতিয়াছিলেন, বীটন তেমনি বালিকাদিগের শিক্ষা লইয়া একেবারে মাতিয়া যান। তিনি সর্ব্বদাই তাঁহার নব-প্রতিষ্ঠিত স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিতেন; আসিবার সময় বালিকাদিগের জন্য নানা উপহার লইয়া আসিতেন; মধ্যে মধ্যে বালিকাদিগকে নিজ ভবনে লইয়া গিয়া মূল্যবান উপহার সামগ্রী দিয়া গৃহে প্রেরণ করিতেন; কখন কখনও চারি পায়ে ঘোড়া হইয়া শিশু বালিকাদিগকে পৃষ্ঠে তুলিয়া খেলা করিতেন। বলিতে কি যে সকল উদারমতি মানব-হিতৈষী ইংরাজ পুরুষের নাম এদেশে চিরস্মরণীয় হইয়াছে, এই মহাত্মা তাহাদের মধ্যে একজন। তিনি নিজের নাম বঙ্গবাসীদিগের স্মৃতি ফলকে অবিনশ্বর অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ সামাজিক ইতিবৃত্তে ইহাঁর নাম চিরদিন উজ্জ্বল তারকার ন্যায় জ্বলিবে।

 কিন্তু ১৮৪৯ সালে মহাত্মা বাটন বালিকা-বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করিলেন বলিয়া এরূপ কেহ মনে করিবেন না যে, বঙ্গদেশে তাহাই স্ত্রীশিক্ষার প্রথম প্রচলন। বহুকাল পূর্ব্ব হইতে এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত করিবার চেষ্টা চলিতেছিল। তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দিতেছিঃ—

 ১৮১৭ সালে স্কুল সোসাইটী স্থাপিত হওয়া অবধি এই প্রশ্ন উঠে যে বালকদিগের ন্যায় বালিকাদিগকেও শিক্ষা দেওয়া হইবে কি না? এই বিষয় লইয়া সভ্যগণের মধ্যে মতভেদ উপস্থিত হয়। রাধাকান্ত দেব উক্ত সোসাইটির অন্ততর সম্পাদক ছিলেন। তিনি স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন; এবং স্কুল সোসাইটীর অধীনস্থ কোন কোনও পাঠশালাতে বালকদিগের সহিত বালিকাদিগকেও শিক্ষা দিবার রীতি প্রবর্ত্তিত করেন। সম্বৎসর পরে তাঁহার ভবনে স্কুল সোসাইটীর পাঠশালা সকলের বালকদিগের যখন পরীক্ষা ও পারিভোষিক বিতরণ হইত, তখন বালকদিগের সহিত বালিকারাও আসিয়া পুরস্কার লইয়া যাইত।

 এইরূপ কয়েক বৎসর যায়। কিন্তু বালকদিগের সহিত বালিকাদিগকে শিক্ষা দেওয়া অনেক সভ্যের অভিপ্রেত হইল না। এই বিষয়ে যে বিচার উপস্থিত হইল, তাহার ফলস্বরূপ ১৮১৯ সালে বাপ্তিস্ত মিশন সোসাইটীর একজন সভ্য ভারতীয় নারীগণের দুর্দ্দশা ও শিক্ষার আবশ্যকতা প্রদর্শন করিয়া এক নিবেদন-পত্র বাহির করিলেন। সেই নিবেদন-পত্রের দ্বারা উত্তেজিত হইয়া Mr. Lawson and Pearce's Seminary নামক তৎকাল-প্রসিদ্ধ বিদ্যালয়ের মহিলাগণ একত্র হইয়া ভারতে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের জন্য এক সভা স্থাপন করিলেন; তাহার নাম হইল—"Female Juvenile Society”। এই সভার মহিলা সভ্যগণ কলিকাতার নানাস্থানে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। রাধাকান্ত দেব ইহাদের উৎসাহ-দাতা হইলেন; এবং নিজে “স্ত্রীশিক্ষা বিধারক” নামে একখানি পুস্তিক রচনা করিয়া তাঁহাদের হস্তে অর্পণ করিলেন। এইরূপে কয়েক বৎসর কার্য্য চলিল। ১৮২১ সালে স্কুল সোসাইটীর কতিপয় মহিলা-সভ্যের প্ররোচনায় ইংলণ্ডের British and Foreign School Society-র সভ্যগণ কিছু অর্থ সংগ্রহ করিয়া কুমারী কুক (Miss Cooke) নাম্নী এক শিক্ষিতা মহিলাকে এদেশে প্রেরণ করিলেন। কুমারী কুক ১৮২১ সালে নবেম্বর মাসে এদেশে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু তিনি আসিয়া দেখিলেন যে স্কুল সোসাইটীর সভ্যগণের মধ্যে মতভেদ উপস্থিত হওয়াতে উক্ত সভ্য তাহার ভরণ পোষণের ভার গ্রহণে অসমর্থ। এই বিপদে চার্চ মিশনারি সোসাইটীর সভ্যগণ অগ্রসর হইয়া কুমারী কুকের ভার গ্রহণ করিলেন। উক্ত মিশনের অধীন থাকিয়া তিনি উৎসাহের সহিত স্বীয় অবলম্বিত কার্য্য-সাধনে প্রবৃত্ত হইলেন।

 তিনি কার্য্যারম্ভ করিবার অগ্রে বাঙ্গালী ভাষা শিক্ষাতে মনোনিবেশ করিলেন। যখন মনোযোগ সহকারে বাঙ্গালী ভাষা শিক্ষা করিতেছেন, তখন একদিন শিশুদের বাঙ্গালা গুনিবার জন্য স্কুল সোসাইটীর স্থাপিত কোনও পাঠশালাতে গিয়া দেখেন একটী বালিকা পাঠশালার দ্বারে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে, গুরুমহাশয় তাহাকে বালকদিগের সহিত পড়িতে দিবেন না। অনুসন্ধানে জানিলেন সে বালিকাটার ভ্রাতা ঐ পাঠশালে পড়ে, শিশু বালিকাটা স্বীয় ভ্রাতার সহিত পড়িবার জন্য গুরু মহাশয়কে মাসাধিক কাল বিরক্ত করিতেছে। কুমারী কুক সেই বালিকার মাতার ও পাড়ার অপরাপর মহিলাদিগের সহিত দেখা করিলেন। অনেক কথোপকথনের পর সেই পাড়াতে বালিকাবিদ্যালয় খোলা স্থির হইল। অল্পদিনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ১০টা ৰিদ্যালয় স্থাপিত হইল এবং ন্যূনাধিক ২৭৭টা বালিকা শিক্ষা করিতে লাগিল। কুমারী কুক দুই বৎসর এই ভাবে কাজ করিলেন। অবশেষে তিনি (Mr. Wilson) উইলসন নামক একজন মিশনারি সাহেবের সহিত প্ররিণীত হইলেন। বিবাহের পরেও তিনি স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে রত রহিলেন বটে, কিন্তু আর পূর্ব্বের ন্যায় সময় দিতে পারিতেন না। এই অভাব দূর করিবার জন্য কলিকাতার কতিপয় ভদ্র ইংরাজ-মহিলা সমবেত হইয়া তদানীন্তন গবর্ণর জেনেরাল লর্ড আমহার্ষ্টের পত্নী লেডী আমহার্ষ্টকে আপনাদের অধিনেত্রী করিয়া স্ত্রীশিক্ষার উন্নতি-বিধানার্থ বেঙ্গাল লেডীস্ সোসাইটী (Bengal Ladies' Society) নামে এক সভা স্থাপন করিলেন। এই সভার মহিলাসভ্যগণের উৎসাহে ও যত্নে নানা স্থানে বালিকা-বিদ্যালয় সকল স্থাপিত হইতে লাগিল। অল্পকালের মধ্যেই ইহার সহরের মধ্যস্থলে একটা প্রশস্ত স্কুলগৃহ নির্ম্মাণ করিবার সংকল্প করিলেন। কিছুকাল পরে মহিলাগণ মহাসমারোহে গৃহের ভিত্তি স্থাপন পূর্ব্বক গৃহনির্ম্মাণে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ গৃহ নির্ম্মাণকার্য্যের সাহায্যার্থ রাজা বৈদ্যনাথ বিংশতি সহস্র মুদ্রাদান করিয়াছিলেন। ইহাতেই প্রমাণ, স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলন বিষয়ে মহিলাগণ এদেশীয় অনেক ভদ্রলোকের উৎসাহ ও আনুকুল্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

 বেঙ্গল লেডীস সোসাইটী বহুবৎসর জীবিত থাকিয়া কার্য্য করিয়াছিল। এমন কি ১৮৩৪ সালে এডাম সাহেব বঙ্গদেশের শিক্ষার অবস্থা বিষয়ে যে রিপোর্ট প্রদান করেন, তাহাতে কলিকাতা ব্যতীত শ্রীরামপুর, বৰ্দ্ধমান, কালনা, কাটোয়া, কৃষ্ণনগর, ঢাকা, বাখরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, মুরশিদাবাদ ও বীরভূম, প্রভৃতি স্থানে ১৯টা বালিকাবিদ্যালয় ও প্রায় ৪৫০টা বালিকার উল্লেখ দেখা যায়; এবং ঐ সকল বিদ্যালয়ের অনেকগুলি লেডিস সোসাইটীর সভ্য মহোদয়াগণের উৎসাহে স্থাপিত বলিয়া উল্লিখিত হয়। কিন্তু এই সকল বালিকা-বিদ্যালয়ের অধিকাংশ খ্রীষ্টীয় মহিলাদিগের স্থাপিত ও খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম প্রচার কার্য্যের অঙ্গীভূত ছিল।

 সাম্প্রদায়িক-ধর্ম্ম-শিক্ষাবিহীন শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন ধীটন্‌ সাহেব সর্ব্বপ্রথমে করেন। সে কার্য্যের প্রতিষ্ঠা ১৮৪৯ সালে হয়; তাহার বিবরণ অগ্রে দিয়াছি, বীটনের বালিকাবিদ্যালয় স্থাপিত হইলেই ৰাৱাসত, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি মফঃস্বলের ও অনেক স্থানে ৰালিকা-বিদ্যালয় স্থাপিত হইতে লাগিল।

 এই স্ত্রী-শিক্ষার প্রচলন লইয়া কলিকাতার হিন্দুসমাজে মহা আন্দোলন উপস্থিত হইল। মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্ত্রী-শিক্ষার বৈধতা প্রমাণ করিবার জন্য যে কেবল গ্রন্থ রচনা করিলেন তাহা নহে, স্বীয় কন্যাকে নবপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিয়া দিলেন। তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবন-সুহৃদগণ স্বীয় স্বীয় ভবনের বালিকাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইতে লাগিলেন। স্ত্রীশিক্ষা লইয়া সমাজ মধ্যে নানা আলোচনা উপস্থিত হইল। “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ” মহানির্ব্বাণ তন্ত্রের এই বচনালঙ্কৃত নবপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের গাড়ি যখন রাজপথে বাহির হইত, তখন লোকে হা করিয়া তাকাইয়া থাকিত ও নানা কথা কহিত; এবং সুকুমারমতি শিশু বালিকাদিগকে উদ্দেশ্ করিয়া কত অভদ্র কথাই কহিত। লোকে বলিতে লাগিল—”এইবার কলির বাকি যা ছিল হইয়া গেল! মেয়েগুলো কেতাব ধরলে আর কিছু বাকি থাকিবে না।” নাটুকে রামনারায়ণ রসিকতা করিয়া বাবুদের মজলিসে বলিতে লাগিলেন;—“বাপরে বাপ মেয়েছেলেকে লেখা পড়া শেখালে কি আর রক্ষা আছে! এক “আন” শিখাইয়াই রক্ষা নাই! চাল আন, ডাল আন, কাপড় আন, করিয়া অস্থির করে, অন্য অক্ষরগুলো শেখালে কি আর রক্ষা আছে!” লোকে শুনিয়া হা হা করিয়া এক গাল হাসিতে লাগিল। বঙ্গের রসিক কবি ঈশ্বর গুপ্তও ভবিষ্যদ্বাণী করিলেনঃ—

“যত ছুড়ীগুলো তুড়ী মেরে কেতাব হাতে নিচ্চে যবে,
এ বি শিখে, বিবী সেজে, বিলাতী বোল কবেই কবে;
আর কিছু দিন থাকরে ভাই! পাবেই পাবে দেখতে পাবে,
আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী, গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।”

 বীটনের বালিকাবিদ্যালয় স্থাপিত হওয়াতে যেমন সমাজমধ্যে সমাজ সংস্কারের আন্দোলন উপস্থিত হইল এবং বীটন দেশীয় শিক্ষিতদলের প্রিয় হইলেন, তেমনি রাজনীতি বিষয়ে এক মহা আন্দোলন উঠিল তাহাতে তিনি তাঁহার স্বদেশীয়গণের অপ্রিয় হইয়া পড়িলেন। এই আন্দোলন অনেক পরিমাণে পরবর্ত্তী সময়ের ইলবার্টরিলের আন্দোলনের অনুরূপ ছিল। ঐ আন্দোলনের প্রকৃতি বুঝিবার নিমিত্ত পূর্ব্ব ইতিবৃত্তের কিঞ্চিৎ উল্লেখ আবশ্যক।

 ১৭৬৫ সাল হইতে বাঙ্গাল, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী কার্য্যর ভার ইংরাজদিগের প্রতি অর্পিত হইলে, বহু বৎসর ধরিয়া ফৌজদারি কার্য‌্যের ভার মুসলমান নবাবের হস্তেই ছিল। ইহাতে রাজকার্য্যের সুশৃঙ্খলা না হইয়া ঘোর বিশৃঙ্খলাই উপস্থিত হয়। ক্রমে সে নিয়ম রহিত হইয়া বিচারকার্য্যের সুশৃঙ্খলা বিধানের জন্য কলিকাতাতে সুপ্রিমকোর্ট স্থাপিত হয়; এবং দেওয়ানী আদালতের ন্যায় নানা স্থানে ফৌজদারী আদালত স্থাপিত হয়। মফস্বলে কোম্পানির ফৌজদারী আদালত স্থাপিত হইল বটে, কিন্তু মফস্বলবাসী ইংরাজগণকে তাহার অধীন করা হইল না। তাহারা নামত সুপ্রিমকোর্টের এলাকাধীন রহিলেন; কিন্তু, কার্য্যতঃ নিরঙ্কুশ হইয়া রহিলেন; কিন্তু কার্যতঃ নিরঙ্কুশ হইয়া রহিলেন। ইহার ফল হইলে সকলেই তাহা অবগত আছেন। মফস্বলবাসী ইংরাজগণের অত্যাচার প্রজাকুলের অসহ্য হইয়া উঠিতে লাগিল। নদীয়া, যশোহর প্রভৃতি জিলাতে নীলকরগণ যথেচ্ছাচারী দুর্দ্দাস্ত রাজার ন্যায় হইয়া উঠিলেন। অথচ সে অত্যাচার নিবারণের উপায় রহিল না। অত্যাচারী ইংরাজগণ আপনাদিগকে কোম্পানির ফৌজদারী আদালতের বাহিরে রাখিয়া, সুপ্রিমকোর্টের দোহাই দিয়া, স্বচ্ছন্দে বিহার করিতে লাগিলেন। ১৮৪৯ সালের পূর্ব্বে এই সকল অত্যাচার এতই অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল যে ইংরাজ কর্ম্মচারীদিগের ও কোম্পানীর কর্তৃপক্ষের মধ্যে অনেকে এই অনিষ্টকর নিয়ম রহিত করিবার জন্য নূতন রাজবিধি প্রণয়নের পরামর্শ দিতে লাগিলেন। তদনুসারে তৎকালীন ব্যবস্থা-সচিব বীটন সাহেব চারিখানি আইনের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিলেন। তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইঃ—

 1. Draft of an Act abolishing exemption from the jurisdiction of the East India Company's criminal courts.

 2. Draft of an Act declaring the privileges of Her Majesty's European subjects.

 3. Draft of an Act for the protection pf judicial officers.' 4. Draft of an Act for trial by jury in the Company's courts.

 পাঠকগণ দেখিতে পাইতেছেন তদানীন্তন ইংরাজগণ যে কেবল এদেশবাসী অসহায় কৃষ্ণবর্ণ প্রজাকুলের প্রতিই অত্যাচার করিতেন তাহা নহে। তাহাদের অত্যাচার হইতে কোম্পানির জুডিশিয়াল অফিসারদিগকেও বাঁচান আবশ্যক হইয়াছিল।  যাহা হউক এই চারিট আইনের পাণ্ডুলিপি গবর্ণর জেনারেলের ব্যবস্থাপক সভাতে উপস্থিত হইবা মাত্র এদেশবাসী ইংরাজগণ ইহাদের (Black Acts) “কালা আইন” নাম দিয়া, তদ্বিরুদ্ধে ঘোরতর আন্দোলন উপস্থিত করিলেন। তাহাদের সম্পাদিত সংবাদ-পত্র সকলে ঐ চার আইন প্রণেতাদিগের প্রতি অভদ্র গালাগালি বর্ষণ চলিতে লাগিল। বাটন তাঁহাদের উপহাস, বিদ্রুপ ও আক্রোশের লক্ষ্যস্থলে পড়িলেন। ইংরাজগণ কলিকাতাতে এক মহাসভা করিয়া পার্লিয়ামেণ্টের নিকট আবেদন করা স্থির করিলেন; এবং এদেশে ও ইংলণ্ডে ঐ আন্দোলন চালাইবার জন্য কতিপয় দিবসের মধ্যে ছয়ত্রিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করিলেন।

 আন্দোলনে দেশ কাঁপিয়া যাইতে লাগিল। এদেশীয়দিগের পক্ষ হইয়া বলিবার কেহই ছিল না। তাহাদের পক্ষ গুছাইয়া বলিতে পারে এমন সংবাদ পত্রই ছিল না। এদেশীয়গণ নীরবে বাদ-বিতণ্ডা শুনিতে লাগিলেন; এবং সদাশয় রাজপুরুষগণের মুখাপেক্ষা করিয়া রহিলেন। কেবল একমাত্র রামগোপাল ঘোষ উক্ত আইন গুলির পক্ষ হইয়া লেখনী ধারণ করিলেন। তাহার বিবরণ রামগোপালের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিতে দেওয়া গিয়াছে।

 অবশেষে আন্দোলনকারী ইংরাজগণের অভীষ্টই পূর্ণ হইল। ইংলণ্ডের কর্তৃপক্ষের আদেশে কালা আইন গুলি ব্যবস্থাপক সভা হইতে অন্তর্হিত হইল। মফস্বলবাসী ইংরাজগণ আরও নিরঙ্কুশ হইয়া উঠিলেন। নীলকরদিগের অত্যাচারে শত শত প্রজার প্রাণ পিষিয়া যাইতে লাগিল।

 অতিরিক্ত শ্রম, অতিরিক্ত চিন্তা ও এই সকল আন্দোলন জনিত উত্তেজনাতে মহাত্মা বাটনের আয়ু সংকীর্ণ করিয়া আনিল। তিনি ১৮৫১ সালের ১২ই আগষ্ট ভবধাম পরিত্যাগ করিলেন। কলিকাতা লোয়ার সার্কুলার রোডস্থ নুতন সমাধিক্ষেত্রে তাঁহার দেহ সমাহিত রহিয়াছে।

 কালা আইনের বিরোধী ইংরাজগণ জয়যুক্ত হইলেন; যে আন্দোলনের ঝড় উঠিয়াছিল তাহা থামিয়া গেল; মহামতি বীটন পরলোক গমন করিলেন; কিন্তু দেশীয় শিক্ষিতদলের মনে একটা গভীর অসন্তোষ থাকিয়া গেল। একতা ও আন্দোলনের দ্বারা কি হয় তাহা তাঁহারা চক্ষের উপরে দেখিলেন। ইংরাজগণ তাঁহাদের চীৎকার-ধ্বনিতে কিরূপে ভুবন কাঁপাইয়া তুলিলেন, কিরূপে দেখিতে দেখিতে শত শত ব্যক্তি একত্র হইলেন, কিরূপে দেখিতে দেখিতে ৩৬ হাজার টাকা তুলিলেন, এ সমুদয় যেন ছায়াবাজীর ন্যায় তাঁহাদের নয়নের সম্মুখে অনুষ্ঠিত হইল। রামগোপাল ঘোষ ইংরাজদিগের অবলম্বিত নীতির প্রতিবাদ করাতে এগ্রি-হর্টিকলচুরাল সোসাইটীতে কিরূপে তাঁহাকে অপমানিত হইতে হইল তাহাও সকলে অবগত আছেন। অনেকে সেই অপমানে আপনাদিগকে অপমানিত বোধ করিলেন। এই সকল কারণে শিক্ষিত দলের মধ্যে রাজনীতির আন্দোলনের জন্য সম্মিলিত হইবার বাসনা প্রবল হইল। তাঁহারা বুঝিলেন স্বদেশের হিতের জন্য সমবেত হওয়া আবশ্যক। সে সময়ে দেশীয় শিক্ষিত দলের মধ্যে দুইটা সভা ছিল; প্রথমটা দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত Bengal Landholders' Association বা বঙ্গদেশীয় জমিদার সভা। কলিকাতার অনেক ধনী ব্যক্তি ইহার সভ্য ছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথ বাবুর মৃত্যুর পর ইহা এক প্রকার মৃত্যু দশায় পড়িয়াছিল। দ্বিতীয় সভাটীর উল্লেখ অগ্রেই করিয়াছি, তাহা জর্জ টমসনের প্রতিষ্ঠিত নব্যবঙ্গের “ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটী”। এইরূপ প্রশ্ন উঠিল, উভয় সভাকে মিলিত করা যায় কি না? রামগোপাল ঘোষ, দিগম্বর মিত্র, প্রভৃতি কতিপয় ব্যক্তির উদ্যোগে ও উৎসাহে অবশেষে ঐ সম্মিলন কার্য্য সমাধা হইল। ১৮৫১ সালের ৩১ অক্টোবর এক সাধারণ সভা আহূত হইয়া, উক্ত উভয় সভা সম্মিলিত করিয়া বর্তমান “ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশন” স্থাপিত হইল। তাহার প্রথম কমিটীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই জানা যাইবে ঐ সভার উদ্যোগকারিগণ কিরূপ সকল শ্রেণীর শিক্ষিত ব্যক্তিদিগকে সমবেত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। উক্ত সভার প্রথম কমিটীভূক্ত ব্যক্তিগণের নামের তালিকা নিম্নে দিতেছিঃ—

রাজা রাধাকান্ত দেব—সভাপতি।
রাজা কালীকৃষ্ণ দেব—সহ সভাপতি।
রাজা সত্যশরণ ঘোষাল।
বাবু হরকুমার ঠাকুর।
বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর।
বাবু রমানাথ ঠাকুর।
বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।
বাবু আশুতোষ দেব।
বাবু হরিমোহন সেন।
বাবু রামগোপাল ঘোষ।

বাবু উমেশচন্দ্র দত্ত—(রামবাগান)।
বাবু কৃষ্ণকিশোর ঘোষ।
বাবু জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়।
বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র।
বাবু শম্ভুনাথ পণ্ডিত।
বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর—সম্পাদক।
বাবু দিগম্বর মিত্র—সহ সম্পাদক।

 ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশনের প্রতিষ্ঠা এই যুগের একটা প্রধান ঘটনা। সভাটী স্থাপিত হইবামাত্র ইহার শক্তি সকলেই অনুভব করিতে লাগিলেন। ইংরাজ রাজপুরুষগণ দেথলেন দেশীয় সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ আপনাদের অভাব গবর্ণমেণ্টের গোচর করিবার জন্য এবং দেশীয়গণের স্বত্ব ও অধিকার রক্ষা করিবার জন্য বদ্ধ-পরিকর হইয়াছেন। এদেশীয়দিগের প্রতি তাঁহাদের যে উপেক্ষার ভাব ছিল তাহা তিরোহিত হইতে লাগিল। দেশের লোকেও জানিল, তাঁহাদের হইয়া বলিবার জন্য লোক দাঁড়াইয়াছে। সুতরাং সকল শ্রেণীর লোকের দৃষ্টি এই নব-প্রতিষ্ঠিত সভার দিকে আকৃষ্ট হইল। লোকে আশার নয়নে ইহাকে দেখিতে লাগিল। এ কথা এখানে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে যে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশন সে সময়ে সে আশা প্রচুর পরিমাণে পূর্ণ করিয়াছেন। যখন দেশের লোকের হইয়া বলিবার কেহই ছিল না, তখন তাঁহারাই একমাত্র মুখমাত্র ছিলেন। লোকের হইয়া বলিবার ও তাহাদিগকে সর্ব্ববিধ রাজকীয় অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহারাই একমাত্র শক্তি ছিলেন। সুতরাং এই সভার প্রতিষ্ঠা সর্ব্বশ্রেণীর মনে হর্ষ ও আশার সঞ্চার করিল।

 ১৮৫১ সালের এপ্রিল মাসে লাহিড়ী মহাশয় বর্দ্ধমানে গেলেন বটে, কিন্তু সেখানেও বহুদিন সুস্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁহার উপবীত পরিত্যাগের গোলোযোগ উপস্থিত হইল। তাঁহার উপবীত পরিত্যাগ সম্বন্ধে দুই প্রকার কিম্বদন্তী প্রচলিত আছে। প্রথম,— তিনি কৃষ্ণনগরের বাটীতে তাঁহার জননীর সাম্বৎসরিক শ্রাদ্ধ ক্রিয়া সম্পন্ন করিতেছিলেন, এমন সময় একটা বালক দূরে দাঁড়াইয়া বলিতেছিল,— “এদিকে ত বলা হয় কিছু মানি না, ওদিকে শ্রাদ্ধ কর্ত্তে বসা হয়েছে, পৈতাটী বেশ ঝুলচে, বামনাই দেখান হচ্ছে।” এই বাক্যগুলি লাহিড়ী মহাশয়ের কর্ণগোচর হইলে তিনি মর্ম্মাস্তিক লজ্জা পাইলেন। ঐ বালকের ৰাক্যগুলি তাহার অন্তরে শেলসম বিদ্ধ হইল। বাক্য ও কার্য্যের একতা যাহার জীবনের মহামন্ত্র ছিল, তাহার পক্ষে এই ব্যঙ্গোক্তি কি ক্লেশকর হইবার সম্ভাবনা! এই ঘটনা হইতেই উপবীত পরিত্যাগের সংকল্প তাঁহার মনে উপস্থিত হয়।

 দ্বিতীয়;—১৮৫১ সালের পূজার ছুটীর সময় লাহিড়ী মহাশয় নৌকাযোগে কতিপয় বন্ধুসহ গাজিপুরে গমন করিতেছিলেন। তাঁহার প্রিয়বন্ধু রামগোপাল ঘোষ তখন গাজিপুরে বাস করিতেছিলেন। তাঁহার নিমন্ত্রণে, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্যই, তাঁহারা গমন করিতেছিলেন। পথিমধ্যে নৌকার মাল্লাদিগের দ্বারাই পাকাদি কার্য্য করাইয়া আহারাদি চলিতেছিল। একদিন সহচরদিগের মধ্যে একজন কৌতুক করিয়া বলিলেন—“এদিকে ত মাল্লাদের হাতে খাইতেছি, অথচ পৈতাটা রাখিয়া ব্রহ্মণ্য দেখাইতেছি, কি ভণ্ডামীই করিতেছি!” বাক্যগুলি কৌতুকচ্ছলে কথিত হইল বটে, কিন্তু তাহা লাহিড়ী মহাশরের চিত্তে বিষম গ্লানি উপস্থিত করিল। তিনি তৎপূর্ব্বে আপনার উপবীতটী নৌকার ছত্রীতে ঝুলাইয়া রাখিয়াছিলেন; তাহা আর গ্রহণ করিলেন না।

 উভয় বিবরণের মধ্যে কোনও বিবাদ দৃষ্ট হইতেছে না। ইহা সম্ভব যে গাজিপুর যাত্রার পূর্ব্বে তিনি জননীর সাম্বৎসরিক শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করিবার জন্য কৃষ্ণনগরে গমন করেন। সেখানে পূর্ব্বোক্ত বালকটীর বিদ্রুপোক্তি শুনিতে পান। তাহা হইতেই উপবীত পরিত্যাগের সংকল্প তাঁহার অন্তরে, উদিত হয়। তৎপরে গাজিপুর যাত্রাকালের ঘটনাটী ঘটে তাহাতে সেই সংকল্পকে দৃঢ়ীভূত করে। এরূপ একটা গুরুতর পরিবর্তন যে একদিনে ঘটিয়াছিল, তাহা মনে হয় না। তাই জীবনের অনেক দিনের সংগ্রামের ফল। আরও অনেকের জীবনে এই প্রকার ভাবেই এইরূপ পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে। সুতরাং ইহার জীবনেও সেই প্রকার ঘটিয়া থাকিবে তাহাতে আর বিচিত্র কি?

 যাহা হউক তিনি যখন উপবীত পরিত্যাগ করিয়া বৰ্দ্ধমানে প্রতিনিবৃত্ত লইলেন, তখন এই ব্যাপার লইয়া তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হইল। হিন্দুসমাজের লোকে দলবদ্ধ হইয়া তাঁহার ধোপা নাপিত বন্ধ করিল; দাসদাসীগণ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র নবকুমার তখন শিশু, তৎপূর্ব্ব চৈত্র মাসে কলিকাতা সহরে তাহার জন্ম হইয়াছিল। সেই শিশুপুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংসারের সমুদয় কার্য্য নির্ব্বাহের ভার তাঁহার বালিকা পত্নীর উপরে পড়িয়া গেল। যিনি অপরের ক্লেশ একটু সহিতে পারিতেন না, সেই লাহিড়ী মহাশয় যে স্বীয় পত্নীর ক্লেশ দেখিয়া অস্থির হইয়া উঠিবেন, তাহাতে আশ্চর্য্য কি? তিনি জল বহা, কাঠ কাটা, বাজার করা প্রভৃতি ভূত্যের সমুদয় কাজ নিজেই নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাতে এক দিনের জন্য ক্লান্তি বোধ করিতেন না; অথবা লোকের প্রতি বিরক্তি বা বিদ্বেষ প্রকাশ করিতেন না। শ্রমের অন্ন মুখেই আহার করিতেন; এবং অহরহ স্বকর্ত্তব্য সাধনে মনোযোগী থাকিতেন। কিন্তু লোকের নির্য্যাতনের সমুদয় ভার বিশেষ ভাবে তাঁহার পত্নীর উপরেই পড়িত। পাড়ার অজ্ঞ স্ত্রীলোকদিগের অবজ্ঞাসূচক বাক্যে ও আত্মীয় স্বজনের আর্ত্তনদে তিনি অস্থির হইয়া উঠিতেন। তাঁহার মনস্তাপ দেখিয়া লাহিড়ী মহাশয় ক্ষুণ্নচিত্তে বাস করিতে লাগিলেন।

 লাহিড়ী মহাশয় ঘরে বাহিরে যেন প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে বাস করিতে লাগিলেন। ওদিকে কৃষ্ণনগরে এই উপবীত-ত্যাগের কথা প্রচারিত হইয়া সেখানেও মহা আন্দোলন উপস্থিত করিল। সেখানে সমাজের লোক রামতনু বাবুকে হাতের কাছে না পাইয়া তাহার বৃদ্ধ পিতা সাধু রামকৃষ্ণকে উত্যক্ত করিয়া তুলিল। বিনা অপরাধে তাঁহাকেও অনেক নির্য্যাতন সহ করিতে হইল। তাঁহার স্বভাব-নিহিত ধর্ম্মানুরাগবশতঃ তিনি উগ্রভাব ধারণ করিলেন না; পুত্রকে শাস্তি দিবার পরামর্শ করিলেন না; বা তাঁহার প্রতি বল-প্রয়োগের অভিসন্ধি করিলেন না; কিন্তু মরমে মরিয়া মৌনী হইয়া রহিলেন। বহুদিন পরে লাহিড়ী মহাশয় যখন আমাদের নিকট তাঁহার পিতার এই সময়কার ভাবের বর্ণনা করিতেন, তখন দর দর ধারে দুই চক্ষে জলধারা বহিত। বস্তুতঃ বলিতে কি আমরা তাহাতে একসঙ্গে পিতৃভক্তি ও নিজের বিশ্বাসানুসারে কার্য্য করিবার সাহস উভয় যে প্রকার সম্মিলিত দেখিয়াছি, তাহা জীবনে ভুলিবার নহে।

 বৰ্দ্ধমানের আন্দোলন বশতঃই হউক অথবা শিক্ষাবিভাগের বন্দোবস্ত বশতঃই হউক এক বৎসরের অধিক কাল তিনি বৰ্দ্ধমানে থাকেন নাই। ১৮৫২ সালে তিনি বালি-উত্তরপাড়ার ইংরাজী স্কুলের হেড মাষ্টার হইয়া আসিলেন।

 উত্তর পাড়াতে আসিয়া তাঁহার সামাজিক নির্ষ্যাতনের ক্লেশের কিঞ্চিৎ লাঘব হইল। তাঁহার কলিকাতাবাসী বন্ধুগণ নানা প্রকারে তাঁহাকে সাহায্য করিতে লাগিলেন। ইঁহাদের মধ্যে স্বৰ্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ-যোগ্য। বিদ্যাসাগর মহাশয় আজ পাচক ব্রাহ্মণ পাঠাইলেন; কাল পলাইয়া গেল। তিনি আবার পাচক যোগাড় করিয়া পাঠাইলেন। ভৃত্যের পর ভূত্য পলাইতে লাগিল; বিদ্যাসাগর মহাশয় আবার পাঠাইতে লাগিলেন। এতদ্ভিন্ন গার্হস্থ্য সামগ্রী সকল কলিকাতাতে ক্রয় করিয়া নৌকাযোগে প্রেরণ করিতেন; বন্ধুকে কোনও অভাব অনুভব করিতে দিতেন না। এইরূপে লাহিড়ী মহাশয়ের দিন এক প্রকার কাটিয়া যাইত। উপবীত পরিত্যাগ করিয়া তিনি যখন নির্য্যাতন ভোগ করিতেছিলেন তখন হিন্দুসমাজের আত্মীয় স্বজনের কথা দূরে থাকুক, তাঁহার শিক্ষিত বন্ধুদিগের মধ্যে ও অনেকে তাঁহাকে পুনরায় উপবীত গ্রহণের জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি সেরূপ পরামর্শের প্রতি কোনও দিন কর্ণপাত করেন নাই।

 লাহিড়ী মহাশয় যখন উত্তরপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক রূপে প্রতিষ্ঠিত, তখন কলিকাতা সমাজের নব অভ্যূদয়ের দিন। তখন চারিদিকে ইংরাজী শিক্ষা ও স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার হইতেছে; ব্রাহ্মসমাজ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমায় দত্ত মহাশয়দ্বয়ের নেতৃত্বাধীনে উদীয়মান শক্তিরূপে উঠিতেছে এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত বর্ত্তমান গদ্য সাহিত্যের সূত্রপাত করিতেছেন। ১৮৪৭ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “বেতাল পঞ্চবিংশতি” নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাহাতে সুললিত বাঙ্গালা গদ্য রচনার সূত্রপাত হয়। তৎপরে তিনি ১৮৪৮ সালে “বাঙ্গালার ইতিহাস,” ১৮৫৭ সালে “জীবনচরিত’ ও ১৮৫১ সালে “বোধোদয়” মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন। ১৮৫১ সালে ও ১৮৫২ সালে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রণীত “বাহ্য বস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার” নামক গ্রন্থদ্বয় প্রকাশিত হয়। পূর্ব্বোক্ত গ্রন্থ সকল প্রচার দ্বারা বাঙ্গালা গদ্যের এক নবযুগের অবতারণা হইল। বিশেষতঃ “বাহ বস্তুর” প্রচার যুবকদলের মধ্যে এক নব ভাবকে উদ্দীপ্ত করে। ইহার প্ররোচনাতে, অনেকে নিরামিষ ভোজন, আরম্ভ করেন; এবং সামাজিক নীতি ও চরিত্র সম্বন্ধে এক অভূতপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন উপস্থিত হয়।

 বাস্তবিক অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় এই সময়ে বঙ্গসমাজের নেতৃগণের মধ্যে একজন প্রধান পুরুষ ছিলেন।

অক্ষয় কুমার দত্ত।

 ইং ১৮২০ সালের ১লা শ্রাবণ দিবসে নবদ্বীপের সন্নিহিত চুপী নামক গ্রামে অক্ষয়কুমারের জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম পীতাম্বর দত্ত। ইঁহার পিতা বিষয় কর্ম্মোপলক্ষে কলিকাতার দক্ষিণ উপনগরবর্ত্তী খিদিরপুর নামক স্থানে বাস করিতেন। অক্ষয়কুমার সপ্তম বর্ষ বয়সে গুরুমহাশয়ের পাঠশালাতে বিদ্যারম্ভ করেন। তৎপরে দশম বর্ষ বয়ঃক্রম কালে ইঁনি খিদিরপুরে নীত হন। সেখানে ইঁহার পিতা ও পিতৃব্যপুত্রগণ তৎকালপ্রচলিত রীতি অনুসারে ইঁহাকে পারসী ভাষাতে সুশিক্ষিত করিবার প্রয়াস পান। কিন্তু শিশু অক্ষয়কুমার সে বিষয়ে অমনোযোগী হইয়া ইংরাজী শিক্ষার জন্য অত্যধিক ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ইহাতে তাঁহার অভিভাবকগণ প্রথমে কতিপয় ইংরাজী ভাষাভিজ্ঞ আত্মীয়কে অনুরোধ উপরোধ করিয়া উক্ত ভাষা শিক্ষা বিষয়ে তাঁহার সহায়তা করিতে প্রবৃত্ত করিলেন। তাহাতে তিনি আশানুরূপ শিক্ষা করিতে না পারিয়া দুঃখিত হইলেন। অমূল্য সময় চলিয়া যাইতে লাগিল, অথচ পাঠে অল্পই উন্নতি দৃষ্ট হইতে লাগিল। অবশেষে বালক অক্ষয়কুমার ইংরাজী বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইবার জন্য ছিঁড়িয়া পড়িলেন; এবং খিদিরপুরে খ্রীষ্টীয় মিশনারিদিগের একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপিত হইলে, গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা না করিয়াই, তাহাতে গিয়া ভর্ত্তি হইলেন। ইহাতে তাঁহার অভিভাবকগণ উৎকণ্ঠিত হইয়া তাঁহাকে কলিকাতাতে রাখিয়া গৌরমোহন আঢ্যের প্রতিষ্ঠিত “ওরিএণ্টাল সেমিনারি” নামক স্কুলে ভর্ত্তি করিবার বন্দোবস্ত করিলেন। তখন তাঁহার বয়ঃক্রম ১৬ বৎসর হইবে।

 স্কুলে পদার্পণ করিয়াই দত্তজ মহাশয় শিক্ষা বিষয়ে আশ্চর্য অভিনিবেশ প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। তাঁহার জ্ঞানের বুভুক্ষ যেন কিছুতেই মিটত না। স্কুলের পাঠ্যগ্রন্থ ভিন্ন যেখানে যে কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় হাতে পাইতেন, অতৃপ্ত ক্ষুধার সহিত তাহার উপরে পড়িতেন, এবং তাহাকে অধিগত না করিয়া নিবৃত্ত হইতেন না।

 পরিতাপের বিষয় এই, অচিরকালের মধ্যে পিতৃবিয়োগ হওয়াতে ইহাকে লেখা পড়া ছাড়িতে হইল। আড়াই বৎসর কি তিন বৎসরের অধিক কাল বিদ্যালয়ে থাকিতে পারেন নাই। তৎপরে একদিকে যেমন আরাধ্যা জননীদেবীর ভরণপোষণার্থে অর্থোপার্জ্জন চেষ্টা ও তজ্জনিত দারিদ্র্যের সহিত সংগ্রাম, অপর দিকে বন্ধু-বান্ধবের নিকট পুস্তকাদি সংগ্রহ করিয়া জ্ঞানোপার্জ্জন 
স্বর্গীয় অক্ষয়কুমার দত্ত।
চেষ্টা, দুই এক সঙ্গে চলিল। বাস্তবিক কিরূপ ক্লেশে দিন যাপন করিয়া তিনি জ্ঞানোপার্জ্জন করিয়াছিলেন তাহা স্মরণ করিলে বিস্মিত হইতে হয়। এই সময়ে তিনি যে যে বিষয় শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন তন্মধ্যে সংস্কৃত ভাষা একটা। তিনি একাগ্রতার সহিত কতিপয় পণ্ডিতের নিকট পাঠ করিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন।

 তৎপরে কিছুদিন বহু দারিদ্র্যভোগ করিয়া ১৮৪০ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা কর্তৃক স্থাপিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালাতে ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষকতা কার্য্য লাভ করেন। কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া তত্ত্ববোধিনী-সভার অধিবেশনে লইয়া যান এবং তাঁহারই উৎসাহে তিনি উক্ত সভার সভ্যশ্রেণীভুক্ত হইয়াছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় শিক্ষকরূপে তিনি প্রথম মাসে ৮৲ তৃতীয় মাসে ১০৲ ও তৎপরে ১৪৲ টাকা করিয়া মাসিক বেতন পাইতেন। তদনন্তর ১৮৪৩ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হইলে ইনি তাহার সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই তত্ত্ববোধিনীর সংশ্রবই তাঁহার সর্ববিধ উন্নতির মূল কারণ হইল। এতদ্বারা এক দিকে যেমন তাঁহার আয় বৃদ্ধি হইল, অপর দিকে তেমনি প্রশস্ত জ্ঞানের দ্বার তাহার নিকটে উন্মুক্ত হইল। এই সময়ে তিনি কিছুদিন মেডিকেল কালেজে অতিরিক্ত ছাত্ররূপে অধ্যয়ন করিয়া উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ববিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, প্রাকৃতিকবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে অনেক জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন। তদ্ভিন্ন তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার সাহায্যে ভূরি ভূরি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়া পাঠ করিতে লাগিলেন। তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদন ভার গ্রহণ করাতে যে মানুষ যে কার্যোর উপযোগী যেন তাহার হস্তে সেই কার্য্যই আসিল। তিনি পদোন্নতিও ধনাগমের বাসনা পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিজের ও দেশীয়গণের জ্ঞানোন্নতি সাধনে দেহ মন নিয়োগ করিলেন। তত্ত্ববোধিনী বঙ্গদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা হইয়া দাঁড়াইল। তৎপূর্ব্বে বঙ্গসাহিত্যের, বিশেষতঃদেশীয় সংবাদপত্র সকলের অবস্থা কি ছিল, এবং অক্ষয়কুমার দত্ত সেই সাহিত্য-জগতে কি পরিবর্ত্তন ঘটাইয়াছিলেন তাহা স্মরণ করিলে, তাঁহাকে দেশের মহোপকারী বন্ধু না বলিয়া থাকা যায় না। “রসরাজ”, “যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল” প্রভৃতি অশ্লীলভাষী কাগজগুলি ছাড়িয়া দিলেও “প্রভাকর” ও “ভাস্করের” ন্যায় ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজের জন্য লিখিত পত্র সকলেও এমন সকল ব্রীড়াজনক বিষয় বাহির হইত, বাহা ভদ্রলোকে ভদ্রলোকের নিকট পাঠ করিতে পারিত না। এই কারণে রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি ডিরোজিওর শিষ্যগণ ঘৃণাতে দেশীয় সংবাদপত্র স্পর্শও করিতেন না। কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী যখন দেখা দিল, তখন তাঁহারা পুলকিত হইয়া উঠিলেন। রামগোপাল ঘোষ একদিন লাহিড়ী মহাশয়কে বলিলেন—“রামতনু! রামতনু! বাঙ্গালা ভাষায় গম্ভীর ভাবের রচনা দেখেছ? এই দেখ,” বলিয়া তত্ত্ববোধিনী পাঠ করিতে দিলেন।

 ১৮৪৩ সাল হইতে ১৮৫৫ সাল পর্য্যন্ত অক্ষয় বাবু দক্ষতা সহকারে তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদন কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। ইতিমধ্যে অর্থোপার্জ্জনের কত উপায় তাহার হস্তের নিকট আসিয়াছে, তিনি তাঁহার প্রতি দৃকপাতও করেন নাই। এই কার্য্যে তিনি এমনি নিমগ্ন ছিলেন যে, এক এক দিন জ্ঞানালোচনাতে ও তত্ত্ববোধিনীর প্রবন্ধ লিখিতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া যাইত, তিনি তাহা অনুভবও করিতে পারিতেন না।

 এই কালের মধ্যে অক্ষয় বাবু আর একটী মহৎ কার্য্য সম্পাদন করিয়াছিলেন, যে জন্য তাঁহার নাম ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্তে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম্ম অগ্রে বেদান্তধর্ম্ম ছিল। ব্রাহ্মগণ বেদের অভ্রান্ততাতে বিশ্বাস করিতেন। অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় এই উভয়ের প্রতিবাদ করিয়া বিচার উপস্থিত করেন। প্রধানতঃ তাঁহারই প্ররোচনাতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় বিষয়ে গভীর চিন্তায় ও শাস্ত্রানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন। তাঁহার প্রকৃতি অগ্রে বর্ণন করিয়াছি, তিনি সহজে স্বীয় অবলম্বিত কোনও মত বা কার্য্যপ্রণালী পরিবর্ত্তন করিতেন না। শীঘ্র কিছু অবলম্বন করিতেন না, করিলে শীঘ্র ছাড়িতেন না। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে, ঈশ্বরালোকে, বহু পরীক্ষার পর কর্তব্য নির্ণয় করিতেন; এবং একবার যাহা নির্ণীত হইত তাহা হইতে সহজে বিচলিত হইতেন না। সুতরাং তাহাকে বেদান্তধর্ম্ম ও বেদের অভ্রান্ততা হইতে বিচলিত করিতে অক্ষয় বাবুকে বহু প্রয়াস পাইতে হইয়াছিল। ১৮৫০ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় বহু অনুসন্ধান ও চিন্তার পর অক্ষয় বাবুর অবলম্বিত মত যুক্তিসিদ্ধ জানিয়া, বেদান্তবাদ ও বেদের অভ্রান্ততা বাদ পরিত্যাগ করিলেন। তাঁহার সাহায্যে “ব্রাহ্মধর্ম্ম” নামক গ্রন্থ সংকলিত হইল; ইহা চিরদিন মহর্ষির ধর্ম্মজীবনের পরিণত ফল স্বরূপ বিদ্যমান রহিয়াছে। যে ১৮৫২ সালের কথা কহিতেছি, তখনও এই মহা পরিবর্ত্তন ব্রাহ্মসমাজকে ও সমগ্র বঙ্গদেশকে আন্দোলিত করিতেছে। তখনও দত্তজ মহাশয় স্বীয় মতের জয় দেখিয়া মহোৎসাহে উদার, আধ্যাত্মিক, একেশ্বরবাদের মহানিনাদে তত্ত্ববোধিনীর প্রবন্ধ সকলকে পূর্ণ করিতেছেন।

 ইহার পরেও অক্ষয় বাবু কয়েক বৎসর কার্যাক্ষেত্রে দণ্ডায়মান ছিলেন। মধ্যে নর্ম্মাল বিদ্যালয় স্থাপিত হইলে কিছুদিনের জন্য তাহার শিক্ষকতা করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার প্রিয় তত্ত্ববোধিনীর সংশ্রব একেবারে পরিত্যাগ করেন নাই। অবশেষে ১৮৫৫ সালের আষাঢ় মাসে সন্ধ্যার পর এক দিন ব্রাহ্মসমাজের উপাসনাতে উপস্থিত আছেন, এমন সময়ে হঠাৎ মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া যান। তখন অনেক যত্নে তাঁহার চৈতন্য সম্পাদিত হইল বটে, কিন্তু দুই দিবস পরে একদিন তত্ত্ববোধিনীর প্রবন্ধ লিখিতেছেন এমন সময়ে মস্তিষ্কের এক প্রকার অভূতপূর্ব্ব জ্বালা হওয়ায় লেখনী ত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। তদবধি সে লেখনী আর ধারণ করিতে পারেন নাই।

 আশ্চর্য্য জ্ঞানপূহা! আশ্চর্য্য কার্য্যশক্তি! ইহার পরে এক প্রকার জীবন্মৃত অবস্থাতে থাকিয়াও তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। অধিক কি তাঁহার “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” নামক সুবিখ্যাত ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ এই অবস্থাতেই সংকলিত। তাঁহার মুখে শুনিয়াছি তিনি প্রাতঃকালে, সুস্নিগ্ধ সময়ে শয্যাতে শয়ন করিয়া কোনও দিন এক ঘণ্টা কোনও দিন দেড় ঘণ্টা করিয়া মুখে মুখে বলিতেন, এবং কেহ লিখিয়া লইত, এইরূপ করিয়া এ সকল মহাগ্রন্থ সংকলিত হইয়াছিল।

 জীবনের অবসান কালে তিনি বালি গ্রামের গঙ্গাতীরবর্ত্তী এক উদ্যানবাটীতে থাকিয়া এইরূপে গ্রন্থ রচনা করিতেন; এবং অবশিষ্ট কাল উদ্ভিদতত্ত্বের আলোচনা ও সমাগত ব্যক্তিদিগের সহিত জ্ঞানানুশীলনে কাটাইতেন। সেখানে বাঙ্গালা ১২৯৩ বা ইং ১৮৮৬ সালের ১৪ই জ্যৈষ্ঠ তাঁহার দেহান্ত হয়।

 এদিকে যে ১৮৫২ সালে লাহিড়ী মহাশয় উত্তরপাড়াতে প্রতিষ্ঠিত হইলেন, সেই সময়ে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিএশনের স্থাপন, বঙ্গসাহিত্যের বিকাশ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার অভ্যুদ্যয় ও ব্রাহ্মসমাজের মত-বিপ্লব কেবলমাত্র এই সকলই যে বঙ্গসমাজকে আন্দোলিত করিতেছিল তাহা নহে, আর একটা বিশেষ কারণে তখন কলিকাতা সমাজে ঘোর আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল। তাঁহার কিঞ্চিৎ বিবরণ ও যে শক্তিশালী পুরুষ তাঁহার নেতা হইয়াছিলেন, তাঁহার জীবনেরও কিঞ্চিৎ বিবরণ দেওয়া আবশ্যক বোধ হইতেছে।  হীরা বুলবুল নামে এক প্রসিদ্ধ বারাঙ্গনা তখন কলিকাতা সহরে বাস করিত। ঐ হীরা বুলবুল একজন পশ্চিম দেশীয় স্ত্রীলোক ছিল। হীরা সহরের অনেক ধনী ও পদস্থ লোকের সহিত সংসৃষ্ট হইয়াছিল। অনুমান করি ১৮৫২ সালের শেষে বা ১৮৫৩ সালের প্রারম্ভে হীরা আপনার একটী পুত্রকে (নিজ গর্ভজাত কি পালিত তাহা জানি না,) তদানীন্তন হিন্দুকালেজে ভর্ত্তি করিবার জন্য পাঠায়। ইহাতে বারাঙ্গনার পুত্রকে হিন্দুসন্তান বলিয়া কলেজে ভর্ত্তি করা হইবে কি না, এই বিচার উঠে। এরূপ শুনিতে পাই, তাহাকে ভর্ত্তি করা হইবে কি না এই বিষয় লইয়া তদনীন্তন এডুকেশন কাউন্সিল ও হিন্দুকালেজের ম্যানেজিং কমিটীর মধ্যে মতভেদ ঘটে। সেই মতভেদ সত্ত্বেও বালকটিকে ভর্ত্তি করাতে সহরের দেশীয় হিন্দু ভদ্রলোকদিগের মধ্যে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হয়। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দত্ত-পরিবারের সুবিখ্যাত বংশধর রাজেন্দ্র দত্ত মহাশয় সেই আন্দোলনের সারথি হইয়া, এই ১৮৫৩ সালের শেষে বা ১৮৫৪ সালের প্রারম্ভে, হিন্দু মেট্ৰপলিটান কালেজ নামে এক কালেজ স্থাপন করেন। সিন্দুরীয়াপটীস্থ সুপ্রসিদ্ধ গোপাল মল্লিকের বিশাল প্রাসাদে এই কালেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতঃপূর্ব্বে কাপ্তেন ডি, এল, (রিচার্ডস এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতি মহামতি (বাটন) বেথুন সাহেবের সহিত বিবাদ করিয়া গবর্ণমেণ্টের শিক্ষা বিভাগ হইতে অবসৃত হইয়াছিলেন। রাজেন্দ্র বাবু তাঁহাকে ঐ কালেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করিলেন।

 কাপ্তেন সাহেব বঙ্গদেশীর সৈন্যবিভাগের কর্ণেল ডি, টি, রিচার্ডসনের পুত্র। তিনি ১৮১৯ সালে বঙ্গদেশীয় সৈন্যবিভাগে প্রবেশ করেন। ১৮২২ সালে তিনি একখানি কবিতাপুস্তক প্রকাশ করেন এবং কবিত্বখ্যাতি লাভ করেন। ১৮২৪ সালে স্বাস্থ্যের জন্য ইংলণ্ডে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া তৎপর বৎসর আর একখানি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন; তাহাতে দেশ বিদেশে তাঁহার সুখ্যাতি বাহির হয়। ১৮২৯ সালে বিলাতে থাকিয়া তিনি মাসিক পত্রিকাদি সম্পাদন দ্বারা আরও খ্যাতি লাভ করেন। তৎপরে এদেশে আগমন করেন। ১৮৩৬ সালে তিনি হিন্দুকালেজের সাহিত্যাধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। এই সময়ে ভারতীয় যুবকগণের পাঠোপযোগী কয়েকখানি কাব্য গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়া প্রকাশ করেন। সে সময়ে যাঁহারা তাঁহার নিকট ইংরাজী সাহিত্য পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা আর সে কথা জীবনে ভুলিবেন না। কিন্তু কাপ্তেন সাহেবের স্বভাৰ চরিত্র সম্বন্ধে লোকে নানা কথা কহিত। এমন কি কখনও কখনও সেই বিষয় লইয়া কালেজের 
স্বর্গীয় রাজেন্দ্র দত্ত।
ছাত্রেরাও উপহাস বিদ্রুপ করিত। কাপ্তেন সাহেবের আর একটা দোষ ছিল, তিনি বড় বাবু ছিলেন; আয় ব্যয়ের সমতার প্রতি কখনও দৃষ্টি রাখিতেন না। ইহার ফল স্বরূপ ঋণজালে জড়িত হইয়া পড়িয়াছিলেন। এই কারণে এডুকেশন কাউন্সিলের সভাপতি মহাত্মা বেথুনের সহিত তাঁহার বিবাদ উপস্থিত হয়। বেথুন তাঁহাকে সাবধান হইতে পরামর্শ দেন, কাপ্তেন সাহেব তাহাতে বিরক্ত হইয়া কর্ম্ম পরিত্যাগ করেন।

 যাহা হউক কাপ্তেন সাহেবকে অধ্যক্ষ করিয়া মহা সমারোহে হিন্দু মেট্ৰপলিটান কালেজের কার্যারম্ভ হয়। এই কালেজ কয়েক বৎসর মাত্র জীবিত ছিল; কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালে ইহা কলিকাতাস্থ হিন্দুসমাজকে প্রবলরূপে আন্দোলিত করিয়াছিল। স্বৰ্গীয় কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি পূর্ব্ববর্ত্তী সময়ের অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি ইহার ছাত্রদলে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। যে রাজেন্দ্র দত্ত বা কলিকাতাবাসীর সুপরিচিত “রাজা বাবু” এই কার্যের প্রধান সারথি ছিলেন, তাঁহার জীবনচরিত সংক্ষেপে বিরক্ত হইল।

রাজেন্দ্র দত্ত

 রাজেন্দ্র দত্ত সুপ্রসিদ্ধ অক্রুর দত্তের পরিবারে ১৮১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই ইহার পিতা পার্ব্বতীচরণ দত্তের পরলোক হওয়াতে তাঁহার জ্যেষ্ঠতাত দুর্গাচরণ দত্ত তাঁহার অভিভাবক হন। দুর্গাচরণ দত্ত মহাশয় তাঁহাকে সর্ব্বাগ্রে ড্রমণ্ড সাহেবের স্থাপিত সুপ্রসিদ্ধ একাডেমিতে তর্ত্তি করিয়া দেন। সেখানে কিছুদিন পড়িয়া তিনি হিন্দুকালেজে যান। সেখানে গিয়া রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি সমাধ্যায়ী ডিরোজিও শিষ্যদলের সহিত তাঁহার পরিচয় ও আত্মীয়তা জন্মে। হিন্দুকালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া তিনি কিছুদিন মেডিকেল কালেজের অতিরিক্ত ছাত্ররূপে সেখানকার উপদেশাদি শ্রবণ করেন। সেই সময় হইতেই ইহার চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি বিশেষ অনুরাগ দৃষ্ট হয়; এবং বোধ হয় মনে মনে এই সংকল্পও জন্মে যে চিকিৎসার দ্বারা লোকের দুঃখহরণরূপ পরোপকারব্রতে আপনাকে অর্পণ করিবেন। বিষয়কার্যো প্রবৃত্ত হইয়া কিছুদিন সওদাগর আফিসে বেনীয়ানের কাজ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু স্বীয় অভীষ্ট কর্ত্তব্যপথ হইতে কিছুতেই ইহাকে বিচলিত করিতে পারে নাই। এই সময়ে পরলোকগত সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের সহিত সমবেত হইয়া স্বীয় ভবনে একটী এলোপ্যাথিক ঔষধালয় স্থাপন করিয়া দীন দরিদ্রের চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণ আরম্ভ করেন। সে সময়ের লোকেরা বলেন এই কার্য্য দ্বারা তিনি সহরে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার বহুলপ্রচার করিয়াছিলেন।

 এই কার্য্যে ব্যাপৃত থাকিতে থাকিতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার দিকে তাঁহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। এই সময়ে কয়েকজন সুবিখ্যাত ইউরোপীয় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এদেশে আসিলেন। তন্মধ্যে Dr Tonnere অধিকতর প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। রাজা বাবু Dr. Tonnereকে সহরে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিরাছিলেন। তাঁহার তত্ত্বাবধানাধীনে একটী হোমিওপ্যাথিক হাস্‌পাতাল স্থাপন করিয়া বিধিমতে হোমিওপ্যাথির প্রচারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় এই হাসপাতালটী বহুদিন স্থায়ী হয় নাই। কিন্তু রাজা বাবু তাহাতে ভগ্নেোদ্যম হন নাই। শুনিতে পাই তাঁহারই চেষ্টাতে ও তদানীন্তন গভর্ণর জেনেরালের সহায়তায় Dr. Tonnore কলিকাতা সহরের প্রথম হেলথ অফিসার নিযুক্ত হন।

 হোমিওপ্যাথির চর্চা করিতে গিয়া তাঁহার মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হইয়াছিল যে, এই চিকিৎসা প্রণালী দ্বারা তিনি দরিদ্রজনের বিশেষ উপকার করিতে পরিবেন। এ সংস্কার চিরদিন তাঁহার হৃদয়ে বদ্ধমূল ছিল এবং মৃত্যুর সময় পর্য্যন্ত তিনি সেই বিশ্বাস অনুসারে কার্যা করিয়াছেন।

 যে কারণে ও যেরূপে তিনি মেট্ৰপলিটান কালেজ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে অগ্রসর হইরাছিলেন, তাহা অগ্রেই বর্ণনা করিয়াছি। বলা বাহুল্য সেজন্য তাঁহাকে অনেক অর্থের ক্ষতি স্বীকার করিতে হইরাছিল। হিন্দু মেট্ৰপলিটান কালেজ প্রতিষ্ঠার অল্পদিন পরেই, গভর্ণমেণ্ট এই নিয়ম স্থাপন করেন যে হিন্দুকালেজের স্কুল বিভাগে হিন্দুসস্তান ভিন্ন অন্যে প্রবেশ করিতে পারিবে না। কিন্তু কালেজবিভাগের দ্বার সর্বশ্রেণীর জন্য উন্মুক্ত থাকিবে। তদনন্তর হিন্দু মেট্ৰপলিটান কলেজের স্বতন্ত্র সত্তার কারণ চলিয়া যায় এবং তাহা কয়েক বৎসর থাকিয়াই বিলুপ্ত হয়।

 রাজা বাবু শেষ দশায় Dr. Beriegnyকে সহায় করিয়া হোমিওপ্যাথির প্রচারে ও পরোপকারে প্রাণ-মন নিয়োগ করিয়াছিলেন। দিনে নিশীথে রোগশয্যার পার্শ্বে যাইবার জন্য কেহ ডাকিলেই তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হইতেন; এবং দিনের পর দিন বিনা ভিজিটে, অনেক সময় নিজ ব্যয়ে গিয়া রোগীর চিকিৎসা করিতেন। আমি অনেক বার তাঁহার গাড়িতে, তাঁহার সঙ্গে রোগী দেখিতে গিয়াছি ও তিনি কিরূপ একাগ্রতার সহিত চিকিৎসা করিতেন তাহা দেখিয়াছি। রোগীকে বাঁচাইবার জন্য সে ব্যগ্রতা, পরিবার পরিজনের সঙ্গে সেই সমদুঃখসুখতা আর দেখিব না। এইরূপ পরোপকার ব্রতে রত থাকিতে থাকিতে ১৮৮৯ সালের জুন মাসে তিনি ভবধাম পরিত্যাগ করেন।

 আর একটী বিষয়ের উল্লেখ করিলেই বর্ত্তমান পরিচ্ছেদের অবসান হয়। সেটা ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টারদিগের ১৮৫৪ সালের শিক্ষাসম্বন্ধীয় পত্র। উক্ত সালে ইংলণ্ড হইতে এদেশে এক আদেশ পত্র আসে। এরূপ শুনা যায় ঐ আদেশ পত্র রচনা বিষয়ে সুপ্রসিদ্ধ জন ষ্টয়ার্ট মিলের হস্ত ছিল। ঐ পত্রে ডাইরেক্টারগণ ভারতীয় প্রজাকূলের শিক্ষাবিধানকে তাঁহাদের অবশ্য-প্রতিপাল্য কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দ্দেশ করেন; এবং এদেশে শিক্ষা-বিস্তারের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত উপায় সকল অবলম্বন করিতে পরামর্শ দেন। (১) শিক্ষাবিভাগ নামে রাজকার্য্যের একটা স্বতন্ত্র বিভাগ সংগঠন; (২) প্রাদেশিক রাজধানী সকলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন; (৩) স্থানে স্থানে নর্ম্ম্যালস্কুল স্থাপন; (৪) তৎকালীন গভর্ণমেণ্ট-স্থাপিত স্কুল ও কালেজগুলির সংরক্ষণ ও তাহাদের সংখ্যা বৰ্দ্ধন; (৫) মিডলস্কুল নামে কতকগুলি নুতন শ্রেণীর স্কুল স্থাপন; (৬) বাঙ্গালা শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন ও বাঙ্গালা শিক্ষার উন্নতিবিধান; (৭) প্রজাদিগের স্থাপিত বিদ্যালয়ে সাহায্য-দান প্রথা প্রবর্ত্তন। ১৮৫৮ সালে ভারতরাজ্য মহারাণীর হস্তে আসিলে যখন ষ্টেট সেক্রেটারির পদ স্বল্প হইল, তখন ডিরেক্টারগণের অবলম্বিত পূর্ব্বোক্ত প্রণালীকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই উভয় পত্রকে এদেশীয় শিক্ষাকার্য্যের মৃদু ভিত্তি, বলিয়া গণনা করা যাইতে পারে।

 ১৮৫৫ সাল হইতেই নব-প্রতিষ্ঠিত প্রণালীর ফল দৃষ্ট হইতে লাগিল। ১৮৫৫-৫৬ সালে একজন ডিরেক্টারের অধীনে শিক্ষা বিভাগ নামে রাজকার্য্যের এক বিভাগ সংগঠন কয় হইল; স্কুল সকল পরিদর্শনের জন্য একদল ইন্‌স্পেক্টর নিযুক্ত হইলেন; স্থানে স্থানে শিক্ষক প্রস্তুত করিবার জন্য নর্ম্মাল বিদ্যালয় সকল স্থাপিত হইল; গভর্ণমেণ্টের অর্থসাহায্য পাইয়া নানাস্থানে নবপ্রতিষ্ঠিত ইংরাজী স্কুল সকল দেখা দিতে লাগিল; এবং গ্রামে গ্রামে মিডল স্কুল ও বাঙ্গালা স্কুল সকল স্থাপিত হইতে লাগিল।

 এই সকল পরিবর্ত্তনের মধ্যে লাহিড়ী মহাশয় উত্তরপাড়া স্কুলে একাগ্রতার সহিত স্বকর্ত্তব্য সাধন করিতে প্রবৃত্ত রহিলেন। সে সময়ে যাঁহারা তাঁহার ছাত্র ছিলেন, তাঁহাদের অনেকের মুখে শুনিয়াছি যে তাঁহার পাঠনার রীতি বড় চমৎকার ছিল। তিনি বৎসরের মধ্যে পাঠ্যগ্রন্থের সমগ্র পড়াইয়া উঠিতে পারিতেন না। কিন্তু যেটুকু পড়াইতেন, সে টুকুতে ছাত্রগণকে এরূপ ব্যুৎপন্ন করিয়া দিতেন, যে তাহার গুণে পরীক্ষাকালে ছাত্রগণ সন্তোষজনক ফল লাভ করিত। ফলতঃ জ্ঞাতব্য বিষয় যোগান অপেক্ষ জ্ঞান-স্পৃহা উদ্দীপ্ত করার দিকে তাঁহার অধিক যত্ন ছিল। বিশেষতঃ যখন ধর্ম্ম বা নীতি বিষয়ে কিছু উপদেশ দিবার অবসর আসিত, তখন তিনি উৎসাহে আত্মহারা হইয়া যাইতেন। নীতির উপদেশটী ছাত্রগণের মনে মুদ্রিত করিবার জন্য বিধিমতে চেষ্টা করিতেন। তিনি যাহা বলিতেন তাহার পশ্চাতে তাঁহার প্রেম ও উৎসাহ-পূর্ণ হৃদয় এবং সর্ব্বোপরি তাঁহার জ্বলন্ত সত্যনিষ্ঠা-পূর্ণ জীবন থাকিত, সুতরাং তাঁহার উপদেশ আগুনের গোলার ন্যায় ছাত্রগণের হৃদয়ে পড়িয়া সুমহৎ আকাঙ্ক্ষার উদয় করিত। এই সময়ে যাঁহারা তাঁহার নিকটে পাঠ করিয়াছিলেন, তাঁহারা সেদিনের কথা কখনই ভুলিতে পারেন নাই।

 লাহিড়ী মহাশয় ১৮৫২ সাল হইতে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত উত্তরপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাজ করিয়াছিলেন। এইখানে অবস্থানকালে তাঁহার লীলাবতী ও ইন্দুমতী নামে দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করে। ১৮৫৪ সালে লীলাবতী ভূমিষ্ঠা হয়, ১৮৫৬ সালে ইন্দুমতীর জন্ম হয়। এখানে ষে অল্পকাল ছিলেন তন্মধ্যে তিনি ছাত্রগণের কিরূপ শ্রদ্ধা ভক্তি আকর্ষণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহার নিদর্শন নিম্নে প্রদত্ত হইতেছে। ঐ স্কুলে তাঁহার স্মৃতি চিরজাগ্রত রাখিবার জন্য তাঁহার অনুরক্ত ছাত্রগণ বহুবৎসর পরে উক্ত স্কুলগৃহে যে প্রস্তরফলক স্থাপন করিয়াছেন, তাহা উদ্ধৃত করিয়া দেওয়া যাইতেছে।

“This Tablet to the Memory of

BABU RAMTONOO LAHIRI

Is put up by his surviving Utterpara School pupils
As a token of the Love, gratituee, and veneration
That he inspired in them, while Head Master of the
Utterpara School, from 1852 to 1856, by his Loving.
Care for them, by his sound method of instruction,
Which aimed less at the mere importation knowledge
Than at that supreme end of all education,
The healthy stimulation of the intellect, the emotions,
And the will of the pupil, and, above all
By the example of the noble life that he led.”
Born December 1818; Died, August 1898.

 লাহিড়ী মহাশয়ের শিক্ষকতা কিরূপ ফলদায়ক হইয়াছিল উক্ত প্রস্তরফলকই তাহার প্রমাণ।