লুকোচুরি/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
সূর্য্যদেব পশ্চিম গগনে ঢলিয়া পড়িয়াছেন। তাঁহার আর সে তেজ—সে দম্ভ নাই। কিছুক্ষণ পূর্ব্বে যে সকল জীব-জন্তু প্রজ্জ্বলিত অগ্নির ন্যায় তাঁহার কিরণজাল দেখিয়া ভয়ে ভয়ে কোন নিভৃতস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল, এখন তাঁহাকে হীনবল ও তেজোহীন দেখিয়া সাহস করিয়া তাহারই সম্মুখে বাহির হইল। পশ্চিমগগন নানা বর্ণে চিত্রিত হইয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। মৃদুমন্দ মলয়পবন সদ্য প্রস্ফুটিত জাতি, যুথী, বেলা, মল্লিকাদি পুষ্পবাসে স্নাত হইয়া চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। আমি অফিসের অপর কার্য্যগুলি শেষ করিয়া অনাথনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিবার বাসনায় কোন নিভৃত স্থানে বসিয়া তাঁহার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
বেলা দ্বিপ্রহরের পর জনাথনাথের সস্ত্রীক থানায় আসিবার কথা ছিল। বেলা প্রায় পাঁচটা বাজিতে চলিল, অথচ তাঁহাদের কাহারও দেখা নাই। সকল কার্য্য বন্ধ করিয়া আমি তাঁহাদের আশায় বসিয়াছিলাম, অথচ তাঁহারা আসিলেন না দেখিয়া, আমি মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইলাম এবং তখনই গাত্রোত্থান করিয়া গৃহের বাহিরে আসিয়া পায়চারি করিতে লাগিলাম।
এমন সময়ে একখানি সেকেণ্ড ক্লাসের ভাড়াটীয়া গাড়ী থানার ভিতরে প্রবেশ করিল। গাড়ীর কোচবাক্সে অনাথনাথকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, তাঁহার স্ত্রী গাড়ীর ভিতরে আছেন।
গাড়ীখানি স্থির হইলে অনাথনাথ অবতরণ করিলেন। আমি তখনই অন্দর হইতে একজন দাসীকে ডাকিয়া অনাথবাবুর স্ত্রীকে ভিতরে লইয়া যাইতে আদেশ করিলাম।
সৌভাগ্যক্রমে তখন থানায় অপর কোন লোক ছিল না। আমার কথা শুনিয়া দাসী সেই গাড়ীর নিকটে গেল এবং অনাথবাবুর স্ত্রীর হাত ধরিয়া নামাইয়া বাড়ীর ভিতর লইয়া গেল। অনাথনাথ আমারই নিকটে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
কিছুক্ষণ পরে তাঁহারা শান্ত হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এত বিলম্ব হইল কেন? কোন নূতন বিপদ উপস্থিত হইয়াছে কি?”
অনাথনাথ লজ্জিত হইয়া উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে না—আপনার আশীর্ব্বাদে আর কোন নূতন বিপদ ঘটে নাই। আমার ইচ্ছা ছিল, নিজের গাড়ীতেই আসিব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ গাড়ীখানির স্প্রীং খারাপ হইয়া যাওয়ায়, এই ভাড়াগাড়ী করিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছি। আপনি সেই পত্রের কিছু করিতে পারিলেন? বিমলা বড়ই চঞ্চল ও ভীত হইয়া পড়িয়াছে।”
আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “পত্রখানির মর্ম্মভেদ করিয়াছি। ওখানি কেবল সাবধান পত্র মাত্র। আমি একে একে সকল কথাই বলিতেছি।”
অ। এখানে কোন কথা বলিবেন না। যেখানে বলিলে বিমলা আপনার মুখের কথা শুনিতে পাইবেন, আপনাকে সেইস্থানে গিয়া বলিতে হইবে। তাহা হইলে বিমলা সুস্থ হইতে পারিবে।
আ। বেশ কথা। এই ঘরের ভিতর ঐ যে দরজা দেখিতেছেন, উহা খুলিলেই বাড়ীর অন্দর দেখিতে পাইবেন। যদি আপনার স্ত্রী ঐ ঘরের ভিতর গিয়া বসেন, তাহা হইলে তিনি অনায়াসে আমাদের সকল কথাই শুনিতে পাইবেন।
অ। ভাল, আপনি সেইরূপই বন্দোবস্ত করিয়া দিন।
আমি তখন একজন দাসীকে ডাকিয়া সমস্ত কথা বলিয়া দিলাম। সেও অনাথ বাবুর স্ত্রীকে লইয়া সেই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিল এবং তাঁহাকে একস্থানে বসিতে বলিয়া নিজে তাহার নিকট দাঁড়াইয়া রহিল।
ঐ সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া আমি অনাথবাবুকে নিকটে বসিতে বলিলাম। তিনি সম্মুখে উপবেশন করিলে আমি বলিলাম, “আপনার স্ত্রী এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের ভিতর পড়িয়াছেন। আজ হউক, কাল হউক বা দশদিন পরেই হউক, ঐ পত্র-লেখকগণ তাঁহারই উপর তাহাদের বহু দিনের আক্রোশ মিটাইবে। এ ষড়যন্ত্র সম্প্রতি হয় নাই, বহুদিনের ষড়যন্ত্র। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আপনার স্ত্রী কলিকাতায় থাকিতেন, তাহা হইলে বহুদিন পূর্ব্বে তিনিও অদৃশ্য হইয়া যাইতেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি এতদিন কানপুরে ছিলেন বলিয়াই এখনও তিনি জীবিত।
অনাথনাথ কোন কথা বলিলেন না। তাঁহার স্ত্রী সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে কিছুদূরে উপবেশন করিয়াছিলেন। আমার শেষ কথাগুলি শুনিয়া তিনি নীরবে রোদন করিতে লাগিলেন। তাহার চক্ষু দিয়া অনবরত অশ্রুপাত হইতে লাগিল দেখিয়া, আমি পুনরায় অনাথনাথের দিকে চাহিয়া বলিলাম, “এখন আমার একটী জিজ্ঞাস্য আছে।”
অনাথনাথ শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলুন?”
আ। প্রতিজ্ঞা করুন যে, আমি যাহা বলিব, ঠিক সেই মত কার্য্য করিবেন।
অ। নিশ্চয়ই। আমরা যখন আপনার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছি, তখন আপনার কথা মতই কার্য্য করিব। আমাদের কি আর উদ্ধারের কোন উপায় নাই?
আ। উপায় নাই এমন কথা বলিবেন না। তবে আমার পরামর্শমত কার্য্য করা চাই। এখন আমি যেরূপ বুঝিয়াছি, তাহা বলিতেছি। আপনার শ্বশুর মহাশয় বর্দ্ধমানে যেখানে কৃষিকার্য্য করিতেন, সেখানে বহুদিন পূর্ব্বে একটী বৌদ্ধ মঠ ছিল। আপনার স্ত্রী কখনও সেখানে গিয়াছিলেন?
অনাথনাথ একবার বিমলার নিকটে গমন করিয়া ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন এবং তখনই আবার আপনার স্থানে আসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে হাঁ—বিমলা একবার সেখানে গিয়াছিলেন। তাঁহার মুখে শুনিলাম, আপনি যথার্থই অনুমান করিয়াছেন?”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি কেমন করিয়া জানিলেন যে, সেখানে বৌদ্ধদিগের মঠ ছিল?”
অ। বিমলা আমার শ্বশুর মহাশয়ের মুখেই শুনিয়াছিলেন। এমন কি, বৌদ্ধরা সেই জন্য যে তাঁহার উপর বিরক্ত হইয়াছিল, সে কথাও তিনি কন্যার নিকট বলিয়াছিলেন।
আ। তবে ঐ সকল কথা পূর্বে বলেন নাই কেন, তাহা হইলে আমাকে এত কষ্ট পাইতে হইত না।
অ। আমার অপরাধ নাই, আমি নিজেই জানিতাম না। আপনি ঐ কথা না বলিলে হয়ত আমি আর কখনও উহা জানিতে পারিতাম না।
আ। আর সে কথায় কাজ নাই। এখন যাহা বলিতেছি শুনুন। আপনার শ্বশুর মহাশয়ের উপর বৌদ্ধগণ বাস্তবিকই রাগান্বিত হইয়াছিল। কিন্তু কেন? তিনি যে ঐ জমী খাজনা লইয়া বা ক্রয় করিয়া চাষ বাস করিতেছিলেন বলিয়া তাহারা ক্রুদ্ধ হইয়াছিল তাহা নহে, আপনার শ্বশুর আর একটা ভয়ানক অন্যায় কার্য্য করিয়াছিলেন।
অ। কি অন্যায় কার্য্য মহাশয়?
আ। তিনি শূকরের ব্যবসায় করিতেন।
অনাথনাথ আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন?”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “যেরূপেই জানিতে পারি, আপনি বলুন, আমার অনুমান সত্য কি না?
অ। আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য কিন্তু আমি আশ্চর্য্য হইয়াছি যে, আপনি কেমন করিয়া তাহা জানিতে পারিলেন। তিনি শূকরের ব্যবসায় করিতেন, এ কথা আমিও জানিতাম না। একদিন একখানা পত্র পাঠ করিয়া জানিতে পারিলাম যে, তিনি ঐ প্রকার কার্য্য করিতেন।
আ। সেই জন্যই তাঁহার পুত্রদ্বয় ও তিনি অদৃশ্য হইয়াছেন এবং কন্যাও কোন্দিন অন্তর্দ্ধান হইবেন বলা যায় না। সোনার শূকরটী তিনি ইচ্ছা করিয়াই প্রস্তুত করাইয়াছিলেন।
অ। কারণ কি? বিমলাকে দিবার জন্য?
আ। না—না; ঐ প্রকার শূকর এদেশে জন্মায় না। তাঁহার ইচ্ছা ছিল; ঐ রকম শূকরের ব্যবসায় করেন। উহা এদেশে প্রস্তুত বটে কিন্তু কোন বিখ্যাত ইংরাজ-কারিগরের দ্বারা গঠিত।
অ। পত্রখানির অর্থ কি? কেমন করিয়া উহার অর্থ বোধ হইল?
আমি যেমন করিয়া সাজাইয়া উহার অর্থ উপলব্ধি করিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে দেখাইয়া দিলাম।
তিনি আমার কার্য্যে সন্তুষ্ট হইলেন। আমি বলিলাম, আরও দুইবার এই প্রকার পত্র পাইবেন। তাহার পর আপনার স্ত্রীর সমূহ বিপদ, এখন তত ভয়ের কারণ নাই।
অনাথনাথ কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলেন না। তাঁহাকে অত্যন্ত বিমর্ষ বলিয়া বোধ হইল। তাঁহার স্ত্রীও বিষণ্ণবদনে অবনতমস্তকে বসিয়া রহিলেন।
কিছুক্ষণ পরে অনাথনাথ বলিলেন, “কল্য আমাদিগকে একস্থানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইতে হইবে। যদি অনুমতি হয়, যাইতে পারি। না যাইলে ভাল দেখায় না।”
আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। পরদিন আমারও একটা নিমন্ত্রণ ছিল। শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোথায় যাইতে হইবে?”
অ। অনেক দূর—শ্যামবাজারে।
আ। শ্যামবাজারে? কোথায়? সুশীলভট্টাচার্য্যের বাড়ীতে কি?
অনাথনাথ স্তম্ভিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে? মানুষ না দেবতা?”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “না বাপু, আমি সামান্য মানুষ। তবে সেখানে আমারও কাল নিমন্ত্রণ আছে বলিয়াই ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছি। যদি সুশীলবাবুর বাড়ীতে হয়, আর যদি আপনি সঙ্গে থাকেন, তাহা হইলে উনি স্বচ্ছন্দে যাইতে পারেন। যখন আমি সেখানে যাইতেছি, আর আপনি যখন উহাঁর সঙ্গে সঙ্গেই থাকিবেন, তখন ভয়ের বিশেষ কোন কারণ নাই।”
আমার কথা শেষ হইলে অনাথনাথ গাত্রোখান করিলেন। তাহার স্ত্রীও সেই সময় দাসীর সহিত বাহিরে আসিয়া অগ্রেই গাড়ীতে আরোহণ করিলেন। অনাথনাথ তাঁহার পরে গিয়া কোচবাক্সে উঠিলেন।
কোচমান এতক্ষণ ঘোড়া দুইটীকে কতকগুলি ঘাস খাইতে দিয়াছিল। সে যখন দেখিল, আরোহীগণ গাড়ীতে উঠিয়াছে, তখন অবশিষ্ট ঘাসগুলি তুলিয়া একটী থলিয়ার ভিতর রাখিল।
ঘাসগুলি থলিয়ার ভিতর রাখিতে গিয়া একখানি কাগজে তাহার হস্ত স্পর্শ হইল। সে চমকিত হইয়া কাগজখানি বাহির করিল এবং সকলের সমক্ষে ফেলিয়া দিল। আমি নিকটেই ছিলাম, কাগজখানি তুলিয়া লইয়া দেখিলাম, সেই শূকরমূর্ত্তি চিহ্নিত দ্বিতীয় সাবধান পত্র। কিন্তু সে পত্রে আর সাঙ্কেতিক কোন কথা ছিল না। পত্রখানি হস্তে লইয়া আমি অনাথনাথের নিকট গমন করিলাম এবং তাহার হস্তে প্রদান করিয়া বলিলাম, “এই দ্বিতীয় সাবধানপত্র। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কেমন করিয়া পুলিসের ভিতর ভাড়াটীয়া গাড়ীর থলিয়ার মধ্যে পত্রখানি আসিল। আমি জানি, কোচমান নিকটে না থাকিলেও একজন কনষ্টেবল এই গাড়ীর নিকটে দণ্ডায়মান ছিল।”
অনাথনাথ তখন কোচমানকে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। সে ব্যক্তি স্তম্ভিত হইয়া বলিল, “না মহাশয়, আমি এই কাগজের কথা কিছুই জানি না।”
আমিও কনষ্টেবলকে জিজ্ঞাসা করিলাম। সে ঈষৎ হাসিল মাত্র, কিন্তু মুখে কোন কথা বলিল না। আমি সে হাসির মর্ম্ম বুঝিতে পারিলাম; তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। অনাথনাথ ও তাহার স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের দিকে চাহিতে লাগিলেন কিন্তু সাহস করিয়া আমাকে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করিতে পারিলেন না।
আমি তখন তাঁহাদিগকে অতি সাবধানে গৃহে যাইতে আদেশ করিয়া বিদায় দিলাম। বলিলাম, “কল্য সন্ধ্যার পর শ্যামবাজারে সুশীলবাবুর বাড়ীতে দেখা হইবে। তবে যদি তাহার পূর্ব্বে আর কোন পত্র পান, তাহা হইলে সে পত্র তখনই আমার নিকট পাঠাইয়া দিতে বিলম্ব করিবেন না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আপনাদের যেন আর কোন কষ্ট না হয়।”