লুকোচুরি/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

◇◇◇◇◇◇

 প্রাতঃকালে প্রকৃতির যে মনোহর মূর্ত্তি দেখিয়াছিলাম, অনাথনাথের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া ঠিক তাহার বিপরীত মূর্ত্তি অবলোকন করিলাম। প্রখর রৌদ্রজনিত ভয়ানক উত্তাপ, প্রজ্জ্বলিত অগ্নি-শিখা-সম উত্তপ্তপবনের উচ্ছ্বাস, জীবগণের অসহ্য কষ্ট দেখিলে স্পষ্টই অনুভূত হয় যে, প্রকৃতি এই সময়ে রুদ্রমূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে,—জীব-সংহারে নিযুক্ত হইয়াছে। প্রকৃতির এই মূর্ত্তি জীবমাত্রেরই ভয়াবহ।

 যখন আমি থানায় আসিয়া পঁহুছিলাম, তখন বেলা প্রায় এগারটা। স্নানাহার শেষ করিয়া এক নিভৃত স্থানে বসিয়া সেই কাগজখানি দেখিতে লাগিলাম। কাগজখানির একটী কোণে ‘ওঁ’ অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা। তাহারই ঠিক বিপরীত দিকে সেই শূকর চিহ্ন। মধ্যে সেই লেখা। সম্ভবতঃ কাহারও স্বাক্ষর নাই।

 ওঁকার শব্দ কাগজখানির এককোণে লেখা রহিয়াছে দেখিয়া আমি ভাবিলাম, পত্র-লেখক নিশ্চয়ই হিন্দু কিন্তু শূকর হিন্দুদিগের অস্পৃশ্য জন্তু। হিন্দুগণ কাগজপত্রে শূকর-মুর্ত্তি অঙ্কিত করেন না।

 আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। ওঁকার দেখিয়া যেমন পত্রলেখককে হিন্দু বলিয়া ভাবিয়াছিলাম, শূকর-মূর্ত্তি দেখিয়া তেমনই তাহাকে অহিন্দু বলিয়া মনে হইল। পত্র-প্রেরক কোন্ ধর্ম্মাবলম্বী জানিবার জন্য আমার ভয়ানক কৌতূহল জন্মিল। আমি কাগজখানি আরও মনোযোগ সহকারে দেখিতে লাগিলাম।

 আরও আধঘণ্টা নিস্তব্ধভাবে লক্ষ্য করিবার পর কাগজখানির অপর এক কোণে “অহিংসা পরমোধর্ম্ম” এই কয়েকটা কথা অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম। আমি তখনই বুঝিতে পারিলাম, পত্র-লেখক বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী। তাহার পর ভাবিলাম, পত্রে যাহা লেখা আছে, তাহা পড়িতে না পারিলে কোন কার্য্য হইবে না। যদিও আমি উহা না পড়িয়াই বুঝিয়াছিলাম যে, সেখানি সাবধান পত্র, তথাপি যতক্ষণ উহা পাঠ করিতে না পারিব, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না।

 এই স্থির করিয়া আমি সেই কাগজখানিতে যাহা লেখা ছিল, সেইগুলি অপর একখানি কাগজে নকল করিয়া লইলাম। এই প্রকার সাঙ্কেতিক পত্র অনেক পাঠ করিয়াছি সুতরাং চেষ্টা করিলে যে ইহাও পাঠ করিতে সমর্থ হইব, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

 লেখাগুলিকে যত প্রকারে সাজাইতে পারা যায় সেই সমস্ত উপায়েই সাজাইলাম, কিন্তু তাহাতেও উহার কোনরূপ মর্ম্মভেদ হইল না। কি করিয়া উহার অর্থ বুঝিব, কেমন করিয়া সাজাইলে উহার ঠিক অর্থ করিতে পারিব, এই প্রকার চিন্তা করিতেছি, এমন সময় দেখিলাম, পত্রের প্রত্যেক কথাই তিন অক্ষরের। আমার মনে এক নূতন উপায় উদ্ভাবিত হইল। আমি ভাবিলাম, লেখাগুলি তিন লাইন করিয়া সাজাইলে উহার অর্থবোধ হইতে পারে।

 এই প্রকার সাব্যস্ত করিয়া আমি প্রত্যেক কথায় তিনটী অক্ষর তিনটী লাইনে লিখিলাম। তাহার পরের কথাটীর তিনটী অক্ষর ঠিক পূর্ব্ব কথাটীর মত অক্ষরের পার্শ্বেই লিখিলাম। এইরূপে সমস্ত কথাগুলি সাজান হইলে পাঠ করিলাম।

“বহুদিন পরে সন্ধান পাইয়া
ছি এই পত্র প্রথম নিশানা জা
নিয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও”

 উল্লিখিত লেখাগুলি পত্রাকারে সাজাইলে “বহুদিন পরে সন্ধান পাইয়াছি। এই পত্র প্রথম নিশানা জানিয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।”

 পত্রের সাঙ্কেতিক ভাষা পাঠ করিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইলাম। যদিও না পড়িয়াই উহার মর্ম্ম অনুমানে বুঝিতে পারিয়াছিলাম, তত্রাপি এখন উহার প্রকৃত অর্থ বাহির করিতে সক্ষম হইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম।

 পত্রখানির মর্ম্মভেদ করিবার পর আমি ভাবিলাম, অনাথনাথের শ্বশুর মহাশয় নিশ্চয়ই হিন্দু। যখন তিনি বর্দ্ধমান জেলায় কৃষিকর্ম্ম করিয়া অর্থোপার্জ্জন করিতেছিলেন, সেই সময়ে আমার বিশ্বাস, তিনি কতকগুলি লোক রাখিয়া শূকরের ব্যবসায় আরম্ভ করেন। এরূপ শোনা গিয়াছে যে, বৌদ্ধ-পুরোহিতগণ এক সময়ে বাঙ্গালা পর্য্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন। যেখানে অনাথনাথের শ্বশুরের জমীদারী ছিল, হয়ত পূর্ব্বে সেইস্থানে কোন বৌদ্ধ-মঠ ছিল। অনাথনাথ যখন সেই পবিত্র স্থানে অপবিত্র অপরিষ্কৃত ও ঘৃণিত জন্তুর ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন, তখন বৌদ্ধগণ তাহা জানিতে পারিয়া ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইলেন কিন্তু ইংরাজ-রাজত্বে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তাঁহারা অনাথনাথের শ্বশুর মহাশয়ের কোন প্রকার অপকার করিতে সক্ষম না হইয়া গোপনে কার্য্য আরম্ভ করিলেন। এই কারণেই তিনি বর্দ্ধমান জেলা হইতে সহসা পলায়ন করিয়া কলিকাতায় আসিয়াছিলেন।

 এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি আবার ভাবিলাম, যদি তাহাই হয়, তবে সোণার শূকরটী কোথা হইতে, কেমন করিয়া, অনাথবাবুর স্ত্রীর হস্তে পড়িল? শূকরটী নিশ্চয়ই তিনিই প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। উহা যে স্বর্ণ নির্ম্মিত, তাহা দেখিয়া স্পষ্টই বোঝা যায় যে, উহা এইখানেই প্রস্তুত। কিন্তু যে আদর্শ দেখিয়া ঐ মূর্ত্তি গঠিত হইয়াছে, তাহা এদেশের আদর্শ নহে। এদেশের শূকরগুলি ওরূপ হৃষ্টপুষ্ট ও দেখিতে এত পরিষ্কার হয় না। এই সকল ব্যাপার চিন্তা করিয়া আমি মনে করিলাম, অনাথবাবুর শ্বশুর মহাশয় এই আদর্শমত শূকর প্রতিপালন করিতেন এবং সেই প্রকার শূকরের ব্যবসায় করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন।

 এই প্রকার নানা চিন্তায় প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমি তখন কাগজখানি রাখিয়া দিয়া অফিসের কার্য্যে মনোনিবেশ করিলাম।