লুকোচুরি/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

◇◇◇◇◇◇

 সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। পূর্ব্বগগনে পূর্ণচন্দ্র উদিত হইয়াছে। মেঘমুক্ত সুনীল অম্বরে নিশানাথ রজত শুভ্র কোমল জ্যোৎস্নায় চারিদিক আলোকিত করিতেছে। মন্দ মন্দ মলয় পবন প্রস্ফুটিত কুসুম-সৌরভ বহন করিয়া জনগণের মনে বিপুল আনন্দ দান করিতেছে।

 আমি যখন সুশীলভট্টাচার্য্যের বাড়ীতে পঁহুছিলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সুশীল আমার বাল্যবন্ধু, তাহার উপর আমার ভ্রাতুষ্পত্রের শ্বশুর। তিনি বাটীর সদর দ্বারে দণ্ডাইয়া নিমন্ত্রিত লোকগণের অভ্যর্থনা করিতেছিলেন। পৌত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে তিনি প্রচুর আয়োজন করিয়াছিলেন।

 বাড়ীতে লোকে লোকারণ্য। চারিদিকেই গোলযোগ। কোথাও নিমন্ত্রিতগণ আহার করিতে বসিয়াছেন, কোথাও বা আহারান্তে গাত্রোত্থান করিতেছেন, কোথাও আবার আহারের স্থান হইতেছে। এই প্রকার সকল স্থানেই গোলমাল। আমি একটী নিভৃত স্থান দেখিয়া বসিয়া পড়িলাম।

 মনে করিয়াছিলাম, বাড়ীতে পঁহুছিয়াই অনাথবাবুর সহিত দেখা হইবে; কিন্তু তাহা হইল না। আমি প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টাকাল চারিদিকে তাঁহার অন্বেষণের জন্য পায়চারি করিয়া বেড়াইলাম, কিন্তু তাহাতেও কোন ফল হইল না। ভাবিলাম, তাঁহারা হয়ত তখনও সেখানে উপস্থিত হন নাই।

 এই মনে করিয়া আমি সেই নিভৃতস্থানে গিয়া উপবেশন করিতেছি, এমন সময়ে অনাথবাবুকে অদূরে দেখিতে পাইলাম। আমি তখনই তাঁহার নিকট গমন করিয়া সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, আর কোন পত্রাদি তখনও পান নাই।

 সে যাহা হউক, তৃতীয় পত্র না পাওয়ায় আমার মনে এক অভূতপূর্ব আনন্দের উদয় হইল। আমি ভাবিলাম, এইবার তাহাদের ষড়যন্ত্র নিষ্ফল করিতে পারিব। এই স্থির করিয়া অনাথনাথকে লইয়া সেই স্থানে উপবেশন করিলাম।

 কিছুক্ষণ পরে সহসা এক দাসী আসিয়া অনাথনাথকে ডাকিল। সে বলিল, “বাড়ীতে বুড়িমার সাংঘাতিক অসুখ করিয়াছে। আপনাদিগকে এখনই যাইতে হইবে।”

 অনাথনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাড়ীর ভিতর খবর দিয়াছ?”

 দাসী বলিল, “আজ্ঞে হাঁ তাঁহার খাওয়া হইয়া গিয়াছে। তিনি এখনই যাইবেন।”

 অনাথনাথ আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার আন্তরিক অভিপ্রায় বুঝতে পারিলাম। বলিলাম, “যদি এই দাসী আপনার স্ত্রীর সহিত যায়, তাহা হইলে আমার বিশেষ কোন আপত্তি নাই। ইহাকে বেশ চতুর বলিয়া বোধ হইতেছে। কিন্তু আপনার সঙ্গে যাওয়াই উচিত। দাসীটী কে?

 অ। আমারই দাসী বটে; সম্প্রতি নিযুক্ত হইয়াছে। এখনও দুইমাস হয় নাই কিন্তু ইহারই মধ্যে বিমলার বড় প্রিয়পাত্রী হইয়া পড়িয়াছে।

 আ। যদি তাহা হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমার কোন আপত্তি নাই।

 এই সময়ে সুশীলবাবু তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আমাকে ও অনাথবাবুকে আহার করিতে অনুরোধ করিলেন। আমি তখন দাসীকে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিয়া সুশীলবাবুর সহিত আহার করিতে যাইলাম। অনাথনাথও আমার সঙ্গে গেলেন।

 সত্বর আহার সমাপন করিয়া আমি বাহিরে আসিলাম। অনাথনাথ তখনও ভিতরে ছিলেন; সুশীলবাবুর সহিত কথা কহিতে ব্যস্ত ছিলেন।

 আমি বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইবার মাত্র একখানি ভাল বাড়ীর গাড়ী সুশীলবাবুর বাড়ীর দরজায় লাগিল। মুহূর্ত মধ্যে একজন মহিলা তাহার ভিতরে আর একজন দাসী গাড়ীর পশ্চাতে গিয়া বসিল। চক্ষের পলক পড়িতে না পড়িতে কোচমান অশ্বে কশাঘাত করিল। ঘোড়া দুইটা ভয়ানক তেজীয়ান ছিল প্রহার খাইয়া প্রাণপণে ছুটিতে লাগিল এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেল।

 আমার ভয়ানক সন্দেহ হইল। দাসীকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, সে অনাথনাথের বাড়ীর লোক। যিনি গাড়ীর ভিতরে গিয়া বসিলেন, তিনি নিশ্চয়ই অনাথবাবুর স্ত্রী। যদি তাঁহার খুড়ীমার পীড়ার জন্যই ব্যস্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে যাঁহার জন্য তিনি এতক্ষণ বিলম্ব করিলেন, তাঁহাকে না লইয়াই বা গেলেন কেন?

 গাড়ীখানি যেরূপ বেগে যাইতেছিল, তাহাতে আমার বড় ভাল বলিয়া বোধ হইল না। কিন্তু কি করিব, অনাথনাথের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া কোন কার্য্য করিতে পারিতেছি না।

 কি করিব চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে অনাথনাথ দৌড়িয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিমলা কোথায় গেল?”

 আ। কেন, তিনি ত এই মাত্র বাড়ী গিয়াছেন। আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?

 অ। সুশীলবাবুর সহিত কথা কহিতে ছিলাম। যাহা শুনিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইয়াছি।

 আ। কি শুনিলেন?

 অ। তিনি বলিলেন, আমার শ্বশুর মহাশয় এখনও জীবিত আছেন!

 আ। তিনি কোথায় বাস করিতেছেন?

 অ। সে কথা তিনি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারিলেন না। অনুমানে বলিলেন, ফরাসডাঙ্গায় আছেন।

 আ। এ সংবাদে আপনি এত অস্থির হইতেছেন কেন?

 অ। কেন? বিমলা বোধ হয় ভয়ে সেইখানেই গিয়াছে।

 আ। আপনার স্ত্রী কি জানিতেন যে, তাঁহার পিতা জীবিত আছেন?

 অ। আমি জানিতাম, সে জানিত না। কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমার সমস্তই ভ্রম।

 আমি বলিলাম, এখন আর সময় নষ্ট করিবার প্রয়োজন নাই। আপনি হাওড়াষ্টেশনে গমন করুন। রাত্রি সাড়ে নয়টা বা সাড়ে দশটার ট্রেন পাইতে পারেন। আমি অন্যপথ দেখিতে দেখিতে যাইতেছি। আপনার স্ত্রী যেভাবে গমন করিলেন, তাহাতে তিনি যে, বাড়ী ফিরিয়া গেলেন এমন বোধ হয় না।

 অনাথনাথ কাঁদিয়াই আকুল হইলেন। আমি অনেক কষ্টে সান্ত্বনা করিয়া একখানি দ্রুতগামী গাড়ী ভাড়া করিয়া দিলাম। তিনি হাবড়া চলিয়া গেলেন। পরে আমি একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া গঙ্গাতীরে যাইলাম এবং প্রত্যেক ঘাট লক্ষ্য করিতে করিতে অগ্রসর হইলাম।

 কিছুদূর অগ্রসর হইলে পর আমি যখন রথতলার ঘাটে উপস্থিত হইলাম, তখন দেখিলাম, সেই গাড়ীখানি ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া বিপরীত দিকে যাইতেছে। ঘাটের দিকে চাহিয়া দেখি, একখানা নৌকার উপর দুইজন স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমি তখন গাড়ীর পশ্চাতে না যাইয়া ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দূর হইতে আমায় দেখিতে পাইয়া বিমলা চীৎকার করিয়া মাঝিকে নৌকা ছাড়িয়া দিতে আজ্ঞা করিলেন।

 আমি সে আদেশ অগ্রাহ্য করিয়া বজ্রগম্ভীরস্বরে মাঝিকে অপেক্ষা করিতে আদেশ করিলাম। সে আমার কথা অমান্য করিতে সাহস করিল না। আমিও সত্বর তাহাদের নিকট যাইয়া দাসীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলাম, “ছি ছি! ভদ্রমহিলা হইয়া এমন নীচ ব্যবহার ভাল দেখায় না। তোমরা এখনই নৌকা ছাড়িয়া উপরে উঠ এবং ঐ গাড়ীতে আরোহণ করিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া যাও। নচেৎ আমি এখনই তোমাদের উভয়কেই পুলিসে গ্রেপ্তার করাইয়া দিব।”

 আমার কথায় দাসী কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু বিমলা তাহার মুখ চাপিয়া ধরিলেন এবং তখনই তাহার হাত ধরিয়া সেই গাড়ীর উপর গিয়া উপবেশন করিলেন। আমি কোচবাক্সে উঠিয়া তখনই শিয়ালদহ গমন করিলাম।

 পথে অনাথনাথের সহিত দেখা হইল। তিনি হাবড়া স্টেশন হইতে অন্বেষণ করিয়া ফিরিতেছিলেন। আমি তাঁহাকে তখন সকল কথাই প্রকাশ করিলাম। পরে তাঁহাকেও গাড়ীতে তুলিয়া তাঁহাদের বাড়ীতে গমন করিলাম।