লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/উপসংহার

অষ্টত্রিংশ পরিচ্ছেদ।


উপসংহার।

 এই বিস্ময়কর ও বিচিত্র ঘটনাপূর্ণ জীবনীতে আমাদিগের বলিবার বিশেষ কিছুই নাই,—বিশেষতঃ চিরপ্রসিদ্ধ ভীরু কাপুরুষ বাঙ্গালীজাতির মধ্যে এরূপ কয়জন দেখা যায়? সুবিখ্যাত নাথেরয় যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াই তিনি পদাতি সৈন্যদলের প্রথম লেফ্‌টেন্যাণ্ট পদলাভ করিয়া অবধি কেবল যে নানা যুদ্ধবিগ্রহেই নিযুক্ত ছিলেন, তাহা নহে, সঙ্গে সঙ্গে নিজ বৈষয়িক বিষয়েও ক্রমে উন্নতি লাভ করিতে লাগিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ এক্ষণে সুরেশচন্দ্র রায়ো-ডি জেনিরো নগরীমধ্যে সুকুমারমতি পুত্রকন্যা পরিবৃত একজন বর্দ্ধিষ্ণু ব্যক্তি। তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্রের বয়ঃক্রম এক্ষণে প্রায় আট বৎসর। সামাজিক ও আর্থিক, কোন বিষয়েই তাঁহার অভিযোগের বা অসন্তোষের বিশেষ কোন কারণই নাই। চতুর্দ্দশ বৎসর বয়ঃক্রম হইতে সুরেশচন্দ্র সংসার সমুদ্রের ভীষণ তরঙ্গ ও প্রবাসে ওতপ্রোত হইয়া এক্ষণে সুখ,সম্পদ, যশ ও ঐশ্বর্য্যের তৃপ্তিভোগ করিতেছেন। কুজ্‌ঝটিকা ও প্রবল বাত্যায় অবসানে স্থিররায়ু ও নির্ম্মল গগন অথবা মহাবিপ্লবের পর শান্তির অবস্থা সদৃশ সুরেশচন্দ্র আজ বিমল আনন্দ ও অতুল ঐশর্য্যরাশির মধ্যে অবস্থিত। কিন্তু এস্থলে আমাদিগকে বিশেষ দুঃখের সহিত বলিতে হইল যে, লেফ্‌টেন্যাণ্ট-সুরেশ সম্বন্ধে আমরা অনেক অসন্ধান করিয়াছি, পত্রাদিও লিখিয়াছি, কিন্তু এ পর্য্যন্ত তাহার কোন উত্তর পাই নাই। যে সকল পত্র আমরা তাঁহাকে লিখিয়াছিলাম, তৎসমুদায় পুনরায় আমাদিগের নিকট ফিরিয়া আসিয়াছে, কিন্তু ইহার অর্থ কি, তাই আমরা বলিতে বা অনুমান করিতেও পারি নাই, তথাপি আমাদিগের বিশ্বাস যে, তিনি এখনও ব্রেজিল দেশীয় সেনানী মধ্যে অলঙ্কার রূপে অবস্থান করিতেছেন এবং অধিকতর পদমর্য্যাদা লাভ করিয়া থাকিবেন। এস্থলে ইহাও আমাদিগের বক্তব্য যে, ব্রেজিলদেশীয় প্রথম লেফ্‌টেন্যাণ্টের পদ নিতান্ত সামান্য বা নগন্য নহে, কেন না রেজিমেণ্টের উহা দ্বিতীয় পদ।

 আমরা এস্থলে মিঃ পুনাণ্ডো লিমস নামক সুরেশের একজন স্থানীয় বন্ধুর একখানি পত্র উদ্ধৃত করিলাম। এই পত্রখানি পাঠ করিলে বেশ বুঝা যাইবে যে, সুরেশ কিরূপ বীরকীর্ত্তি লাভ করিয়াছেন, এবং শত্রুগণ যে বাঙ্গালীকে কুৎসা করিয়া থাকে—ঘৃণা করিয়া থাকে, তাহাও বিদূরিত হইবে। সুরেশের বীরত্ব ও সময় নিপুণতা দেখিলে বাঙ্গালী যে জগতে নিন্দিত ও ঘৃণিত তাহার অপনোদন হইবে। বিলাতের সুবিখ্যাত প্রাচীন ও ক্ষমতাশালী, বাঙ্গালী-বৈরি ‘টাইমস্ নামক পত্রও স্বীকার করিয়াছেন যে, যে বাঙ্গালী জাতি এক সময়ে—এক যুগমধ্যে সুরেশ বিশ্বাস, জগদীশ বসু এবং অতুল চট্টোপাধ্যায় প্রসব করিতে পারে, সে জাতিকে কিছুতেই ঘৃণা করা যাইতে পারে না।

 উল্লিখিত মিঃ পুনাণ্ডো লিমস, ১৮৯৪ খৃঃ অব্দে মার্চ্চ মাসে সুরেশচন্দ্রের পিতাকে এই পত্র লিখেন,—তিনি ব্রেজিলের একজন সম্ভ্রান্ত অধিবাসী, সুতরাং তাঁহার লেখনী-প্রসূত কথাগুলি যে অতীব মূল্যবান তদ্বিষয়ে সংশয় নাই বলিয়াই আমরা সে পত্র এস্থলে উদ্ধৃত করিলাম।


পত্র।

রাইয়ো-ডি-জেনিরো, ১২ই মার্চ্চ ১৮৯৪।


 আপনি ইতিপূর্ব্বে বোধ করি, নিশ্চয় জানিয়া থাকিবেন যে, আপনার পুত্র ব্রেজিল গবর্ণমেণ্টের সামরিক বিভাগের কর্ম্মচারী। ব্রেজিলের পদাতি সৈন্যদলের তিনি প্রথম লেফ্‌টেন্যাণ্ট; সম্প্রতি নাথেরয়ের (Nitheroy) যুদ্ধে স্বীয় অদম্য বীর্য্য, উৎসাহ ও রণকুশলতায় তিনি বিপুল যশস্বী হইয়াছেন। সেই সুবিখ্যাত ভীষণ যুদ্ধের রজনীতে শত্রুগণ ছয়ঘণ্টাকাল অবিরত উক্ত নগরীতে গোলাবর্ষণ করিলে আমাদিগের পরমবন্ধু আপনার পুত্র সৌভাগ্যবশতঃ সেইস্থলে স্বীয় সেনাদলের সহিত উপস্থিত থাকায় ৫০ জন সৈনিক সমভিব্যাহারে তিনি শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করিবার জন্য প্রেরিত হয়েন। শত্রুপক্ষীয়গণ শীঘ্রই তাঁহাকে চিনতে পারিয়াছিল, এবং তৎপক্ষ হইতে তাঁহার কর্ণে এইমাত্র শ্রুত হইল যে “কে আসিতেছে”। তন্মুহূর্ত্তেই তাহার প্রত্যুত্তর হইল, ‘‘সাধারণ তন্ত্রের বীর সৈন্যগণ”। পুনরায় শত্রুপক্ষ কহিল, “হয় আত্মসমর্পণ কর অথবা মৃত্যু নিশ্চয়।’’

 তদুত্তরে তিনি কহিলেন, “সাধারণ তন্ত্রের বীরসৈনিকগণ কখন আত্মসমর্পণ করে না।” অনন্তর তিনি স্বীয় সৈন্যগণকে উদ্দেশ করিয়া শত্রুগণের দিকে অধিকতর বেগে ধাবমান হইবার জন্য আদেশ করিলেন। শত্রুগণ তাহাদিগের কামান লইয়া তাঁহার গতি রোধ করিবার জন্য অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। সুরেশচন্দ্র দণ্ডায়মান হইলেন এবং স্বীয় সৈনিকদিগের প্রতি চাহিয়া বলিলেন, ‘‘সঙ্গীগণ,—শত্রুদিগের রিভলভার-কামান আছে এবং উহা আমাদিগের অতি নিকটে স্থাপিত। আমাদিগের প্রিয়ভূমি ব্রেজিলের বীরপুত্রগণের হৃদয় মৃত্যুকে ভয় করে না, এবং তোমরাও দেখিবে যে, পবিত্র ভূমি হিন্দুস্থানের সন্তান কেমন করিয়া পাঁচ মিনিটকাল মধ্যে উহা অধিকার করিয়া লইবে, অতএব প্রস্তুত হও।” অন্যরা কয়েকবার আনন্দসূচক ‘‘হুরে”-ধ্বনি করতঃ স্বীয় সহচরবর্গকে অনুসরণ করিতে বলিয়া ভীমবেগে সেই শত্রুর কামানের মুখে তিনি অগ্রসর হইলেন। প্রবেশমাত্র বাস্তবিকই তিনি কামানগুলি অধিকার করিয়া লইয়াছিলেন, পরে ভীষণ কাটাকাটি আরম্ভ হইল এবং পরিশেষে তিনিই জয়লাভ করিলেন।

 বিগত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ অবধি তিনি (সুরেশ) আমাদিগের কাছে ছিলেন; কারণ তিনি আমাদিগের পরিবারবর্গের বিশের আত্মীয়। তিনি এক দিন আমাকে বলিয়াছিলেন যে, গতানু হইলে আমি যেন এই মর্ম্মে কলিকাতায় একখানি পত্র লিখি যে, তিনি যেখানে গিয়াছেন সেইখানেই যশস্বী হইয়াছেন, এবং যেন তাঁহার পুত্র তাঁহার কীর্ত্তি ও যশের কাহিনী জানিতে পারে এবং পিতার উপযুক্ত পুত্র হইয়া তৎপথ অনুসরণ করিতে যত্ন পায়। তিনি নব বিবাহিত পত্নী ও ১৬ মাসের একটী পুত্রকে আমাদিগের নিকট রাখিয়া গিয়াছেন এবং তাহারা যত দিন জীবিত থাকিবে তাবৎ তাহারা আমার পরম আদরের ধন হইবে। ইহাদিগের জীবিকা নির্ব্বাহোপযোগী যথেষ্ট বিষয়-বিভব তিনি রাখিয়া গিয়াছেন এবং আমারও অনেকগুলি বাড়ী আছে, বিপুল সম্পত্তি আছে এবং তৎসমুদয় তাহাদিগের আশাতিরিক্ত।

 সমাজে সুরেশচন্দ্র অতি বীর প্রকৃতির লোক, আচার ব্যবহারে অতি সভ্য, এবং সুপণ্ডিত। তাঁহার মস্তিষ্ক নূতন নূতন ভাবে পূর্ণ এবং সর্ব্বদাই বিজ্ঞানচর্চ্চায় রত। বিপদ্‌কালে তিনি নির্ভীক, এদিকে দর্শনশাস্ত্রে বিশেষ অনুরক্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি এতই সুপণ্ডিত যে, এক সপ্তাহের মধ্যে আমার পরিবারের পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটী পদ একেবারে আরোগ্য করিয়াছেন। কোন ডাক্তারেই তাঁহাকে আরোগ্য করিতে পারে নাই। এই চিকিৎসা প্রণালীকে তিনি দৈহিক-তাড়িত কহেন। তিনি আমার পত্নীকে কোন ঔষধ সেবন করান নাই; তাহার শরীরে কেবলমাত্র স্বীয় হস্তের অঙ্গুলি চালনা মাত্রেই তাহাকে আরোগ্য করেন।”