লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/প্রেমে-সঙ্কট
পঞ্চবিংশতি পরিচ্ছেদ।
প্রেমে-সঙ্কট।
এই সময়ে সুরেশ বাসা পরিবর্ত্তন করিলেন। তিনি যে রূপ শ্রেণীর লোকের সহিত বাস করিতেছিলেন,—এবার যে বাড়ীতে গেলেন তথায় তাহাপেক্ষা উচ্চ কথঞ্চিৎ শ্রেণীর ভদ্রলোক সকল বাস করিতেন। তবে ইহাঁরা পোষাক পরিচ্ছদে যে রূপ ভদ্র পরিচিত বলিয়া সে রূপ বোধ হইতেন,—প্রকৃত পক্ষে তাঁহারা ছিলেন না। লণ্ডনের ডিটেক্টিভ পুলিস্ কর্ম্মচারীগণ ইহাঁদের প্রতি সর্ব্বদাই বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেন। সহরের কোন স্থানে কোন চুরি জুয়াচুরি হইলে কখনও কখনও এই সকল লোকের মধ্যে কেহ কেহ ধৃত হইতেন।
পূর্ব্বের বাড়ীতে যে রূপ কতকগুলি স্ত্রীলোক ছিল, এখানেও কতকগুলি সেই রূপ ছিল। সতীত্ব বলিয়া যে এ সংসারে কিছু পদার্থ আছে তাহা তাহারা জনিত না, ভাবিতও না। পয়সা ও মদের জন্য ইহারা না পারিত এ রূপ কাজও সংসারে ছিল না। সুরেশ ইহাদের বড়ই প্রিয়পাত্র হইলেন। তাঁহার নিকট ইহারা ভারতবর্ষের গল্প শুনিতে বড়ই ভাল বাসিত,—সুরেশও কতক সত্য কতক মিথ্যা ইহাদিগকে নানা গল্প শুনাইতেন।
যাহার শরীরে বল আছে ও হৃদয়ে সাহস আছে ইংরাজ রমণীগণ তাহাকে বড় ভালবাসেন। সুরেশের শরীরে অসীম বল ছিল;—সাহসে সুরেশের সমতুল্য পাওয়া যাইত না। ইংরাজের মধ্যে অল্প লোকই ছিল যে তাঁহার সহিত আঁটিয়া উঠিত,—এ কারণেও ঐ সকল ইংরাজ-মহিলা তাঁহাকে বড় ভালবাসিত। কিন্তু ইহাদের মধ্যে একজন তাঁহাকে বড়ই ভালবাসিতে আরম্ভ করিল। সে তাঁহাপেক্ষা অনেক বয়োজ্যেষ্ঠা, এবং বিবাহিতা,—তাহার স্বামী ছুতোরের কাজ করিত। প্রথম হইতেই সে সুরেশকে বড়ই যত্ন করিতে আরম্ভ করিয়াছিল,—তাহার হৃদয় যে তাঁহার প্রেমে পূর্ণ হইয়াছে সুরেশ ইহা কতক কতক বুঝিতেও পারিয়াছিলেন,—এক দিন এই রমণী স্পষ্টই নিজ হৃদয় ভাব সুরেশের নিকট জ্ঞাপন করিল। সুরেশ তাহাকে অনেক বুঝাইলেন, কিন্তু সে তাঁহার জন্য পাগল;—কোন কথাতেই কর্ণপাত করিল না; প্রত্যহই তাহার ভালবাসার বেগ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল,—সে ক্রমে অতি প্রকাশ্যভাবে সুরেশের প্রতি প্রেম প্রকাশ করিতে লাগিল;—এমন কি সুরেশ দেখিলেন যে ডাইভোর্স আদালতে হয়ত তাঁহাকে বাইতে হয়। রমণী এমনই কাণ্ড করিতে লাগিল যে এ কথা তাঁহার স্বামীর কর্ণগোচর হওয়া আর অসম্ভব রহিল না, তাহা হইলে সুরেশের যে সমূহ বিপদ হইবার সম্ভাবনা তাহা সুরেশেও বেশ বুঝিলেন,—তিনি কত অনুনয় বিনয় করিলেন কিন্তু রমণী তাঁহার কোন কথাতেই কর্ণপাত করিল না। সুরেশ অতি কষ্টে তাঁহার হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করিতে লাগিলেন;—বিশেষতঃ তাঁহার এ সময়ে কোন কাজ না থাকায় দুই প্রহরে যখন সকলে কাজে যাইত, তখন তাঁহাকে গৃহে থাকিতে হইত। এ সময়ে তাহাকে নির্জ্জনে পাইয়া রমণী তাঁহাকে অনেক অনুনয় বিনয় করিত,—অনেক সাধ্যসাধনা করিত,—কখন কখন উন্মত্তের ন্যায় তাঁহাকে আলিঙ্গন করিতে আসিত,—সুরেশ এ মহা সঙ্কটে পড়িয়া কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।
এক দিন রাত্রে সুরেশ তাঁহার নিজ ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ মধ্যে বসিয়া এক মনে একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছেন,—এ রূপ সময়ে একটী অর্দ্ধ উলঙ্গী রমণী নিঃশব্দে তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিল, নিঃশব্দে তাঁহার নিকটে আসিয়া সহসা ফুঁ দিয়া আলো নিবাইয়া দিল। সুরেশ চমকিত হইয়া পশ্চাতে চাহিলেন, কিন্তু কে তাঁহাকে এই সময়ে সবলে জড়াইয়া ধরিয়া আলিঙ্গন করিল,—তাহার ওষ্ঠে পুনঃ পুনঃ চুম্বন করিতে লাগিল;—সুরেশ কথা কহিতে গেলে হাত দিয়া মুখ চাপিয়া ধরিল। সুরেশ অতি কষ্টে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?” রমণী উত্তর করিল, “নিষ্ঠুর, যাহাকে তুমি পাগল করেছ?’’
সুরেশের বুঝিতে বাকি রহিল না। তিনি এ রমণীকে জ্ঞাতসারে এ রূপ অভিসারে আসিতে কখনও উৎসাহিত করেন নাই। ইহাতে তাঁহার সমূহ বিপদের আশঙ্কা আছে। তিনি ভীত হইয়া বলিলেন, “আপনি কি করিয়াছেন! এত রাত্রে আমার নিকট কেন আসিয়াছেন। আপনার স্বামী জানিতে পারিলে আপনাকে ও আমাকে উভয়কেই বিপদে পড়িতে হইবে।
বিপদ! বিপদাপন্ন বুঝি না। তুমি আমাকে পাগল করিয়াছ। আমি মরি, আমাকে রক্ষা কর।
এই বলিয়া রমণী কাঁদিয়া উঠিল। ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল। সুরেশ মহাবিপদে পড়িলেন,—কি করিবেন, কিছু স্থির করিতে পারিবেন না।
তখন রমণী বলিল। “আমার স্বামী বাড়ী নাই, রাত্রে আসিবে না। তার জন্য কোন ভাবনা নাই। বল তুমি আমায় ভালবাস, তা হলেই আমি সন্তুষ্ট হব। তোমাকে না পেলে আমি প্রাণ রাখিব না।
সুরেশ। ‘‘এ রকম কথা বলিবেন না। এ রূপ কথা বলা শোনা দুই পাপ। আমায় ক্ষমা করুন।
রমণী তাহার কথায় কর্ণপাত করিল না। সহসা তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে সোয়াইয়া ফেলিল, তাহার হৃদয়ের উপর শুইয়া পড়িল। সুরেশ তাহার হস্ত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য উঠিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এই সময়ে সৌভাগ্যক্রমে পার্শ্বের প্রকোষ্ঠ হইতে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল “কি মহাশয় এখনও নিদ্রা যান নাই।’’ সুরেশ বলিলেন, “না—তারই আয়োজন করিতেছি।” পার্শ্বের গৃহে লোক জাগিয়া আছে দেখিয়া রমণীও সুরেশকে ছাড়িয়া দিল। বলিল “একটী বিদায় চুম্বন দাও আমি চলিয়া যাই।’’ সুরেশ কি করেন, তিনি রমণীয় হস্ত হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য অগত্যা সম্মত হইলেন। তখন সেই রমণী নিশব্দে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল।
জীবনে সুরেশ এরূপ বিপদে আর কখন পড়েন নাই। তিনি এই রমণীর হস্ত হইতে কিরূপে রক্ষা পাইবেন। প্রথমে তিনি ভাবিলেন যে তাহার বন্ধু সম্বাদপত্র বিক্রেতা বালকের সহিত এ বিষয়ে পরামর্শ করিবেন, কিন্তু তৎপর মুহূর্ত্তেই ভাবিলেন, রমণী হৃদয়কে দমন করিতে না পারিয়া তাঁহাকে ভালবাসিয়াছে, কেহ সে কথা জানে না, তাঁহাকে বিশ্বাস করিয়া সে তাঁহার নিকট হৃদয় ভাব প্রকাশ করিয়াছে, এরূপ স্থলে তাহার কথা পরকে বলা নিতান্তই অন্যায় হইবে। সুরেশ এ কথা নিজের মনে মনেই রাখিলেন, কাহাকেও প্রকাশ করিলেন না। তবে এ বিষয়ে কি করা কর্ত্তব্য তাহাও মনে স্থির করিতে লাগিলেন।
অবশেষে তিনি স্থির করিলেন যে তিনি এ বাড়ীতে আর বাস করিবেন না। তার পর ভাবিলেন অন্য কোন বাড়ীতে থাকিলেও রমণী তাঁহাকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারে, তাহাই তিনি ভাবিলেন যে তিনি অন্ততঃ মাস কয়েকের জন্য লণ্ডনেই থাকিবেন না। সুরেশ যখন যাহা মনে স্থির করিতেন, তাহা সম্পন্ন করিতে কাল বিলম্ব করিতেন না। লণ্ডন ত্যাগ করিতে তিনি মনে মনে যে স্থির করিলেন, অমনি তাহারই আয়োজনে নিযুক্ত হইলেন। তিন চারিদিন যাইতে না যাইতে তিনি লণ্ডন সহর পরিত্যাগ করিয়া বিলাতের পল্লিগ্রাম ভ্রমণে বহির্গত হইলেন।