‘লোকরহস্যে’র প্রথম ও শেষ সংস্করণের পাঠভেদ

 বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় ‘লোকরহস্যে’র দুইটিমাত্র সংস্করণ হইয়াছিল। প্রথম দুই বৎসরের বঙ্গদর্শন হইতে আটটি [ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল (প্রথম ও দ্বিতীয় প্রবন্ধ), ইংরাজস্তোত্র, বাবু, গর্দ্দভ, দাম্পত্য দণ্ডবিধির আইন, বসন্ত এবং বিরহ, সুবর্ণগোলক, রামায়ণের সমালোচন] তথাকথিত হালকা রচনা লইয়া ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘লোকরহস্য’ “কাঁটালপাড়া বঙ্গদর্শন যন্ত্রে শ্রীহারাণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত” হয়। প্রথম সংস্করণের টাইটেল-পেজে “কৌতুক ও রহস্য” কথা দুইটি মুদ্রিত ছিল। পৃষ্ঠা-সংখ্যা ছিল ৯৯। ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতার “Hare Press” হইতে ‘লোকরহস্যে’র দ্বিতীয় সংস্করণ বাহির হয়। পৃষ্ঠা-সংখ্যা ১৭৪। প্রথম বারের “বিজ্ঞাপন” দ্বিতীয় সংস্করণে উদ্ধৃত হয় নাই; “রামায়ণের সমালোচন” প্রবন্ধটি পুনর্লিখিত হইয়াছে এবং বর্ষ সমালোচন, কোন “স্পেশিয়ালের” পত্র, Bransonism, হনূমদ্বাবুসংবাদ, গ্রাম্য কথা (প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা), বাঙ্গালা সাহিত্যের আদর ও New Year’s Day—এই সাতটি নূতন রচনা পরবর্তী কালের ‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘প্রচার’ হইতে সংযোজিত হইয়াছে।

 প্রথম সংস্করণের বিজ্ঞাপনটি এইরূপ ছিল—

বিজ্ঞাপন

 এই গ্রন্থে বঙ্গদর্শনের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড হইতে কয়েকটি প্রবন্ধ উদ্ধৃত হইয়া পুনর্মুদ্রিত হইল। এতৎসম্বন্ধে একটি মাত্র কথা বলা আবশ্যক। বঙ্গদেশের সাধারণ পাঠকের এইরূপ সংস্কার আছে যে, রহস্য মাত্র গালি; গালি ভিন্ন রহস্য নাই। সুতরাং তাঁহারা বিবেচনা করেন যে, এই সকল প্রবন্ধে যে কিছু ব্যঙ্গ আছে, তাহা ব্যক্তিবিশেষকে গালি দেওয়া মাত্র। এই শ্রেণীর পাঠকদিগের নিকট নিবেদন যে, তাঁহাদের জন্য এ গ্রন্থ লিখিত হয় নাই—তাঁহারা অনুগ্রহ করিয়া এ গ্রন্থ পাঠ না করিলেই আমি কৃতার্থ হইব।

 সামাজিক যে সকল দোষ, তাহাতে রহস্য লেখকের অধিকার সম্পূর্ণ। ব্যক্তিবিশেষের যে দোষ, তাহাতে রহস্য লেখকের কোন অধিকার নাই—কদাচিৎ অবস্থাবিশেষে অধিকার জন্মে; যথা, ভ্রান্ত রাজপুরুষের ভ্রান্তিজনিত কার্য্যের প্রতি, অথবা মূর্খ গ্রন্থকর্ত্তার গ্রন্থের প্রতি, রহস্য প্রযুজ্য। এ গ্রন্থের সে সকল উদ্দেশ্য নহে। এ গ্রন্থে শ্রেণীবিশেষ বা সাধারণ মনুষ্য ব্যতীত ব্যক্তিবিশেষের প্রতি কোন ইঙ্গিত নাই।

 উল্লেখযোগ্য পাঠভেদ নিয়ে দেওয়া হইল—

 পৃ. ৮, ফুটনোটের তৃতীয় লাইন, “সংস্কৃত ভাষা অসভ্য ভাষা” স্থলে “সংস্কৃত ভাষা রূঢ় ভাষা” ছিল।

 পৃ. ২২, পংক্তি ১৫, “যিনি আপনাকে অভ্রান্ত” স্থলে “যিনি আপনাকে সর্বজ্ঞ এবং অভ্রান্ত” কথা কয়টি ছিল।

 পৃ. ২৫, তৃতীয় প্যারার পর নিম্নলিখিত প্যারা দুইটি ছিল—

 তুমিই ব্রাহ্মণকুলে জন্মিয়া, ধর্ম্মশাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছিলে, সন্দেহ নাই, নহিলে নবমীতে লাউ খাইতে নাই কেন? তুমিই আলঙ্কারিক, সাহিত্যদর্পণাদি তোমারই সৃষ্টি। কিঞ্চিৎ ঘাস খাও।

 তুমি সুকবি—কাদম্বরী, বাসবদত্তা প্রভৃতি উৎকৃষ্ট, জগন্মান্য কাব্য তোমারই প্রণীত। কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় থাকিয়া, তুমিই বিদ্যাসুন্দরাদি প্রণয়ন করিয়াছিলে, সন্দেহ নাই। নহিলে এজন্মে তাহাতে তোমার এত প্রীতি কেন?

 পৃ. ২৫, শেষ প্যারার পর নিম্নলিখিত অংশটি ছিল—

 যেমন ভগবান্ কুর্ম্মরূপে, পৃষ্ঠে পৃথিবী বহন করিয়াছিলেন, কৃষ্ণরূপে অঙ্গুলিতে গিরিবহন করিয়াছিলেন, নাগরূপে মস্তকে ধরণীর ভার বহন করিতেছেন, তেমনি তুমিও পশু, পশুরূপে মলিন বস্ত্রের ভার বহন কর। অতএব তোমারও পূজা করিব—এই ঘাস গ্রহণ কর।

 তুমি বিধাতার অনুগ্রহে চতুর্ভুজ। এবং জাতিধর্ম্মবশতঃ সর্ব্বদা গোপীগণে পরিবৃত। পুচ্ছ চূড়া হইতে স্থানান্তরে গিয়াছে বটে, কিন্তু আছে। ঐ যে গর্জ্জন করিলে, ওকি বংশীরব? তুমি ভক্তের নিকট প্রকাশ করিয়া বল, আবার এ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইলে কেন?

 তুমি আবার কি কংস শিশুপালাদি অসুরের বধ করিতে আসিয়াছ? কংস এখন আর নাই— তিনি একটি “আকার” প্রাপ্ত হইয়া থালা ঘটি বাটি ইত্যাদিতে পরিণত হইয়াছেন—এবার তাহাতে উচ্ছিষ্ট অন্ন খাইয়া সুখী হও। শিশুপালের উপর তোমার রাগ আছে সন্দেহ নাই; কেন না, শিশুপাল ইঁট মারিয়া সর্ব্বদা তোমার অস্থি ভাঙ্গিয়া দেয়। কিন্তু হে মহাবল! আমার পরামর্শ শুন, তাহাদিগের শারীরিক আঘাত করিও না। তুমি যে সম্বাদ পত্রের সম্পাদক হইয়া সপ্তাহে সপ্তাহে তাহাদিগকে আপন বুদ্ধি দান করিতেছ, তাহাতেই শিশুপালের সর্ব্বনাশ হইবে।

 অথবা তুমি কি আবার একটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বাঁধাইতে অবতীর্ণ হইয়াছ? এবারকার যুদ্ধ শস্ত্রে না শাস্ত্রে?

 হে গর্দ্দভ! আমি অর্ব্বাচীন, কি বলিতে কি বলিলাম, তুমি আমার উপর রাগ করিও না। যিনি জগতের আরাধ্য, তিনি সকল ভূতেই আছেন, এজন্য আমি তোমারও পূজা করিলাম। অন্য লোকে যদি মনুষ্য পূজা করিতে পারে, তবে আমি তোমার পূজা না করি কেন? তুমি কি “Grand etre” ছাড়া?

 পৃ. ৫১, প. ২, “কোন বিলাতী সমালোচক প্রণীত” স্থলে “শ্রীমদ্ধনুমদ্বংশজ শ্রীমন্মহামর্কট প্রণীত” ছিল।

 পৃ. ৫১, প. ৩-৫, “অনেক সময়ে রচনা... গৌরবের বিষয় নহে।” এই কথা কয়টি ছিল না।

 পৃ. ৫১, প. ৭-৮, “বানরেরা বোধ হয়,...জাতিগণের পূর্ব্বপুরুষ। অনার্য্য” অংশটুকু ছিল না।

 পৃ. ৫১, প. ৯-১০, “তখন আর্য্যেরা...সভ্য ছিল।” কথা কয়টির পরিবর্ত্তে ছিল—

বানরদিগের কীর্ত্তি সম্যক্‌রূপে বর্ণনা করা, সামান্য কবিত্বের কার্য্য নহে। গ্রন্থকার যে ততদূর কবিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, এমত আমরা বলিতে পারি না; তবে তিনি যে কিয়দ্দূর কৃতকার্য্য হইয়াছেন, তাহা নিরপেক্ষ পাঠক মাত্রেই স্বীকার করিবেন।

 পৃ. ৫১, প. ১৩, “বহুবিবাহের···উৎপন্ন হইল।” কথা কয়টি ছিল না।

  প. ১৪, “অসভ্য” কথাটির স্থলে “নির্ব্বোধ” ছিল এবং “সপত্নীগর্ভজাত” কথাটি ছিল না।

 পৃ. ৫১, প. ১৫, “ভারতবর্ষীয়দিগের স্বভাবসিদ্ধ আলস্যবশতঃ” কথা কয়টির পরিবর্ত্তে “ততোধিক মূর্খ;” ছিল।

 পৃ. ৫১, প. ১৬-২৪, “ইহার সহিত মহাতেজস্বী......লক্ষ্মণ আর একটি উদাহরণ।” কথা কয়টির পরিবর্ত্তে ছিল—

তা, একাই যাউক, তাহা নহে; আপনার যুবতী ভার্য্যাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেল। “পথে নারী বিবর্জ্জিতা,” এটা সামান্য কথা। ইহাও তাহার ঘটে আসিল না। তাহাতে যাহা ঘটিবার, ঘটিল। স্ত্রীস্বভাবসুলভ চাঞ্চল্য বশতঃ সীতা রামকে ত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সঙ্গে লঙ্কায় রাজ্যভোগ করিতে গেল। নির্ব্বোধ রাম পথে২ কাঁদিয়া বেড়াইতে লাগিল। সীতা অন্তঃপুরে থাকিলে এতটা ঘটিত না। সীতা দুশ্চরিত্রা হইলেও, ঘরে থাকিত; বনে গিয়া স্বাধীনতা পাইয়াছিল, এবং অন্যের সংসর্গ সুসাধ্য হইয়াছিল, এ জন্য এমত ঘটিয়াছিল। এক্ষণে যাঁহারা স্ত্রীলোকদিগকে স্বাধীন করিবার জন্য কলহ করেন, তাঁহারা যেন এই কথাটি স্মরণ রাখেন।

 লক্ষ্মণ আর একটি গণ্ডমূর্খ।

 পৃ. ৫২, প. ২, “ভারতবর্ষীয়দিগের স্বভাবসিদ্ধ নিশ্চেষ্টতার” কথাগুলির পরিবর্ত্তে “বুদ্ধিহীনতার” কথাটি ছিল।

 পৃ. ৫২, প. ৩-৪, “অসভ্য মূর্খ” ও “অকর্ম্মা” কথাগুলির স্থলে যথাক্রমে “গণ্ডমূর্খ” “মূর্খ” কথা দুইটি ছিল।

 পৃ. ৫২, প. ৫, “অনার্য্য (বানর) জাতি” কথা কয়টির পরিবর্ত্তে “আমার বন্দনীয় পুর্ব্বপুরুষ” ছিল।

 পৃ. ৫২, প. ৬, “বর্ব্বর জাতির নৃশংসতা” কথা কয়টির পরিবর্ত্তে “মূর্খের মূর্খতা” কথা দুইটি ছিল।

 পৃ. ৫২, প. ৯, “বর্ব্বরজাতির স্বভাবসুলভ ক্রোধবশতঃ” কথা কয়টির পরিবর্ত্তে “বুদ্ধিহীনতাবশতঃ” কথাটি ছিল।

 পৃ. ৫২, প. ১১, “অসভ্য জাতির মধ্যে” কথাগুলির পরিবর্ত্তে “বুদ্ধি না থাকিলে” কথা কয়টি ছিল।

 পৃ. ৫২, প. ১৬, “ইহাতে কি···দেখা যাউক।” কথাগুলির পরিবর্ত্তে “ইহা কাহারও প্রণীত নহে।” কথা কয়টি ছিল।

 পৃ. ৫২, প. ২৮ ও পৃ. ৫৩, প. ১, “অশ্লীলতাঘটিত” কথাটির পরিবর্ত্তে উভয় স্থানেই “আদিরসঘটিত” ছিল।

 পৃ. ৫৩, প. ৯-১০, “প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে···বিশুদ্ধ সংস্কৃতে অধিকারী।” কথাগুলির পরিবর্ত্তে ছিল—

ইহা কি সামান্য মূর্খতা? এই একটি দোষেই এই গ্রন্থখানি সাধারণের পরিহার্য্য হইয়াছে।

 ভরসা করি, পাঠক সকলে এই কদর্য্য গ্রন্থখানি পড়া ত্যাগ করিবেন। আমি একখানি নূতন রামায়ণ রচনা করিয়াছি, তৎপরিবর্ত্তে তাহাই সকলে পাঠ করিতে আরম্ভ করুন। আমার প্রণীত রামায়ণ যে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হইয়াছে, তাহা বলা বাহুল্য; কেন না, আমি ত বাল্মীকির ন্যায় কবিত্ববিহীন এবং বিদ্যাবুদ্ধিশূন্য নহি। সেই কথা বলাই এ সমালোচনার উদ্দেশ্য। অলমতি বিস্তরেণ।

মঃ মঃ